শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

কিশোর গ্যাং রুখতে হবে

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

কিশোর গ্যাং রুখতে হবে

কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য সীমা অতিক্রম করেছে। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন-জখমের ঘটনা খবরের শিরোনাম হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা রীতিমতো জিম্মি। ঘটেছে একাধিক হত্যাকান্ড। মূলত গ্যাং সংস্কৃতি পাশ্চাত্য সমাজে দেখা গেলেও আমাদের দেশে কিশোর গ্যাং বৃদ্ধির অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। রাজনীতিতে থাকা বড়ভাই-ছোটভাই সংস্কৃতিকে ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে ক্ষমতা আর আধিপত্য বজায় রাখছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তাই আইন বা পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে বন্ধ করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে সমাজের ভিতর থেকেই বিপথগামী কিশোরদের সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্যাং কালচারের এই বিস্তার দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হুমকি। যারা জাতির ভবিষ্যৎ বলে পরিগণিত হয়, তাদের মধ্যেই যদি প্রায় সব ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তাহলে জাতির আগামী দিনগুলো যে অন্ধকারের অতলে ডুবে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি চুরি, ডাকাতি, মাদক কারবার ইত্যাদি ভয়ংকর অপরাধ কিশোর গ্যাংয়ের দ্বারা অবলীলায় সংঘটিত হচ্ছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্র মতে, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে দুই শতাধিক খুন হয়েছে। এ সময়ে অন্যান্য অপরাধ কী পরিমাণে হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। কিশোর গ্যাং কালচারের পেছনে রয়েছে নানা কারণ। যেমন গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশই দরিদ্র ও স্কুল থেকে ঝরেপড়া ছাত্র। এসব কিশোর প্রযুক্তিকেন্দ্রিক জীবন ও বিনোদন, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, পারিবারিক বন্ধন আলগা হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মাদকের নেশায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। পরে এরা সমবয়সী অন্য কিশোরদের সঙ্গে মিলে অন্য একটি গ্রুপ তৈরি করে। এরপর কয়েকজন মিলে তৈরি করে একটা গ্যাং। এটা প্রজন্মগত সমস্যা।

উদ্বেগের বিষয় হলো, নেশার টাকা জোগাড় করতে ছোটখাটো অপরাধে জড়ানো কিশোর অপরাধীরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠছে ভয়ংকর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। ভাড়াটে হিসেবে তারা এখন মানুষ হত্যার মতো অপরাধেও যুক্ত হচ্ছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। পরবর্তী প্রজন্মকে অপরাধমুক্ত রাখতে হলে কিশোর অপরাধের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। তা না হলে দিন দিন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সমাজকাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাফিয়াকেন্দ্রিক রাজনীতির ফলাফল হলো ‘কিশোর গ্যাং’। রাজনীতি যখন ক্ষমতা প্রদর্শন এবং অর্থ উপার্জনের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে, তখন ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য একটা বাহিনী গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়ে। এই বাহিনী দিয়েই এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, চাঁদাবাজি, মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া আর যে কারণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো- পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষার শোচনীয় ঘাটতি। পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ পরিবার ও সমাজকে আগে যে সুরক্ষা দিতো, সেই সুরক্ষা এখন নেই। কারণ, ওই মূল্যবোধই নিঃশেষ হয়ে গেছে। পরিবারে এসব শিক্ষার যে সুযোগ ছিল তাও নেই। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ যে কোনো অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। এ সাহায্য থেকে বঞ্চিত এখনকার কিশোররা। পরিবার হলো সব শিক্ষার ভিত্তিভূমি। শিশু-কিশোরের লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব পালন করে মাতা-পিতা বা অভিভাবক। আজকাল অধিকাংশ মাতা-পিতা ও অভিভাবক এ দায়িত্ব পালন করে না। সন্তান-সন্ততি কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, খেয়াল করে না। বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে মাদকাসক্তি কিশোর-যুবকদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। জুয়াও তাদের গিলে খাচ্ছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততাও ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যাচ্ছে। শিশু-কিশোর-যুবকদের বাঁচাতে, দেশ বাঁচাতে, জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে এখনই সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিথিল পারিবারিক বন্ধন, মা-বাবার সন্তানকে সময় না দেওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনসহ উন্নত প্রযুক্তি উপকরণের নাগাল পাওয়া, সঙ্গদোষ ইত্যাদি কারণে কিশোরদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া কিশোরদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা দেওয়া, যৌক্তিকতা বিচার না করেই সব আবদার পূরণ করা এবং সন্তান কী করছে সে বিষয় পর্যবেক্ষণ না করায় অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে এবং কেউ তাদের অসৎ কাজে ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। এজন্য সবার আগে পরিবার তথা মা-বাবাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা কী করে, কার সঙ্গে সময় কাটায়- এসব খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানদের অযৌক্তিক আবদার পূরণ করার আগে ভাবতে হবে। কিশোর অপরাধ দমনে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক পোষকতা পরিহার করতে হবে, অর্থনীতিকে সব বিত্তের মানুষের কল্যাণদায়ী করে তুলতে হবে। বেকারত্ব দূর করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর