রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

অর্থনীতির হৃৎপিন্ডে রক্তক্ষরণ চলছে

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

অর্থনীতির হৃৎপিন্ডে রক্তক্ষরণ চলছে

দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাত হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপি-। এই হৃৎপিন্ডে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই হৃৎপিন্ডে যদি রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক না থাকে তাহলে সে দেশের অর্থনীতি ভালো চলবে না। আমাদের দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না। এটা আমরা সবাই কমবেশি বুঝতে পারি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ঋণমানে আমাদের অবনতি হয়েছে।  এখন শুধু বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ বললেই চলে না। বিশ্বের অনেকগুলো ক্রেডিট রেটিং সংস্থা রয়েছে। তাদের কথাও শুনতে হয়। রেটিং ভালো না হলে কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে না। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ভালো চলছে না। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- মানিক মুনতাসির

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাত প্রসঙ্গে আপনার মূল্যায়ন কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল অডিটিং প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হচ্ছে না। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোর যে হিসাব নিরীক্ষণ করা হয় সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের অর্থনীতির ভাবমূর্তিও ঠিক নেই। ব্যাংক খাতের ঋণ অবলোপন মানেই ঋণগ্রহীতা বা ঋণখেলাপির দায়মুক্তি নয়। অবলোপ বা রাইট অফ করা ঋণগুলো হয়তো ব্যাংকের হিসাবনিকাশের খাতা থেকে বাদ যায়, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এটা ঋণখেলাপিকে দায়মুক্তি দেবে। ব্যাংক ও আর্থিক খাত হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপি-। এই হৃৎপিন্ডে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই হৃৎপিন্ডে যদি রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক না থাকে তাহলে সে দেশের দেশের অর্থনীতি ভালো চলবে না। আমাদের দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না। এটা আমরা সবাই কমবেশি বুঝতে পারি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ঋণমানে আমাদের অবনতি হয়েছে। এখন শুধু বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ বললেই চলে না। বিশ্বের অনেকগুলো ক্রেডিট রেটিং সংস্থা রয়েছে। তাদের কথাও শুনতে হয়।  রেটিং ভালো না হলে কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যটা কেমন চলছে সেটা কিন্তু অনেকটাই নির্ভর করে খেলাপি ঋণের ওপর। এখানে কী পরিমাণ ঋণ মওকুফ করা হয়েছে সেটাও আসবে। অথচ সেটা দায়মুক্তির মতোই হয়ে গেছে। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। সে হিসাব ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালান্স সিট থেকে বাদ দিচ্ছে। কিন্তু ঋণটা তো জনগণের কাঁধেই বর্তাচ্ছে। জনগণকে এটা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর্থিক খাত অন্যান্য দশটি খাতের মতো নয়। কেননা এখানে আমানতকারীদের আমানত রয়েছে। তাদের প্রতি ব্যাংকগুলোর দায়বদ্ধতা রয়েছে। যেহেতু খেলাপি ঋণ এখন অনেক বেশি। আবার ব্যাংকগুলোর আমানতও কিছুটা কমছে। এ ছাড়া আমি তো আগেও বলেছি- আমাদের দেশের আর্থিক খাত ভালো চলছে না। আবার দেখেন আমাদের আর্থিক খাত যে ওঠানামা হয়েছে; এটাও আমরা সবাই জানি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অর্থনীতির পরিসংখ্যানগত সমস্যা বা এর বিশ্বাসযোগ্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : যে কোনো পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা আমি অতীতেও বলেছি। ফলে পরিসংখ্যানের সঠিকতা থাকতে হবে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বিরাট একটা দায়িত্ব রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের জন্য আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার। ব্যাংক খাতের সঙ্গে জনগণের আমানত জড়িত থাকে। স্বার্থ থাকে। এখানে স্পন্সর ডাইরেক্টরদের নিয়ে কথা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ কেলেঙ্কারি বা খেলাপি হয়ে যাওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কী হচ্ছে-একই পরিচালক বছরের পর বছর বোর্ডে থেকে যাচ্ছেন। তারা ইচ্ছামতো ঋণ নিচ্ছেন। আবার তা পরিশোধও করছেন না। ব্যাংক খাতের কেন এমন দুরবস্থা হলো। এটা তো এক দিনে হয়নি। এটার জন্য সেন্ট্রাল ব্যাংক কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। ঋণখেলাপিরা নানাভাবে খুবই প্রভাবশালী। তারা রাজনৈতিক প্রভাবও খাটান।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যাংকিং খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : বিভিন্ন সময় ব্যাংক খাতের সংস্কার হয়েছে। তবে এসব সংস্কার সঠিক ছিল না। একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে আমিও ছিলাম। তখন আমরা ৬০-৭০ জনকে ব্যাংক থেকে অপসারণ করেছিলাম। আরও কয়েকজন ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ তারা অন্যায় করেছিলেন। বড় ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের স্ক্যাম হয়েছে। হচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের আস্থা উঠে যায়নি। কারণ গ্রাহকরা বিশ্বাস করে ব্যাংক বসে গেলে সরকার তাদের টাকা ফেরত দেবে। যারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেন তারা ফেরত না দেওয়ার জন্যই ঋণ নেন। কারণ তারা খুবই প্রভাবশালী। একসময় অনিয়ম করলে বিচার হতো। এখন তা হয় না। একজন পরিচালক বছরের পর বছর ব্যাংকের পরিচালক। আবার একই পরিবারের অনেক সদস্য আজীবন ব্যাংকের পরিচালক। এসব নিয়মনীতির সংস্কার হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ছিল ভুল সংস্কার।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যাংকগুলোর অডিট কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : বাংলাদেশের বাস্তবতায় ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেওয়ার বাস্তবতা আছে। সম্প্রতি যেসব ঋণ অবলোপন করা হয়েছে সেগুলো তো হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা ঋণখেলাপিকে দায়মুক্তি দেয় না। এখন হয়তো সেটাকে সেভাবে ভাবা হচ্ছে যে, অবলোপন মানেই দায়মুক্তিও। এজন্য ব্যাংকগুলোর ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল অডিট কার্যক্রমে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সুদহার বেঁধে দেওয়া ও সামগ্রিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক আচরণ প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : একটা সময় ব্যাংকে রোডম্যাপ ছিল, কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সেগুলো সব চলে গেছে। এখন আবারও কেন সেই বিধিবিধানের কথা বলা হচ্ছে, ঋণখেলাপির সংজ্ঞা আরও আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। রোডম্যাপ যে করা হচ্ছে, সেই রোডম্যাপ দিয়ে আমরা কতদূর আসলাম, কী কারণে সেখান থেকে বিচ্যুত হলাম, কখন হলাম তার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। তার যৌক্তিক কারণ না বুঝে আবারও রোডম্যাপ করলে কোনো কাজ হবে না। সুদহার বেঁধে দেওয়ার বিষয় নিয়ে খুবই আলোচনা হচ্ছিল। এই সুদহার এক জায়গায় বেঁধে দেওয়া হবে কি না, সেটা ৬ বা ৯ শতাংশ হবে ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে নাকি সম্পূর্ণ উদার করে দেওয়া হবে, ঋণ ও আমানতের চাহিদা অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ হবে ইত্যাদি। এটা একসময় করা হয়েছিল, তখন এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছিল এর পক্ষে-বিপক্ষে। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলেছিল এটা (সুদহার) উদারীকরণ করা হোক। সেই উদারীকরণ করার পরে নয়ছয়ে আবারও বেঁধে দেওয়া হলো। অনেক দিন ধরে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, উচিত ছিল তার আগেই ছেড়ে দেওয়া। আবার যখন সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া হলো তখন আগের সব যুক্তি আমরা ভুলে গেছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আর্থিক খাতের সংস্কারের বেলায় আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ মানা হয় কি না-এ প্রসঙ্গে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : শুধু আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝে না। একবারে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে যেগুলো ছোট ছোট ব্যাংক, যারা নাজুক অবস্থায় আছে, যারা আমানত পায় না, তারা তো গ্রাহককে আমানতের জন্য বেশি সুদহার দিয়ে আকৃষ্ট করতে চাইবে। যারা খুব নিরাপদ ঋণগ্রহীতা না, রিস্কি ঋণগ্রহীতা, তাদের ঋণ দিয়ে আপাতত বেঁচে থাকতে চাইবে। সেখানেও সমস্যা তৈরি হবে। এটার আপাতত একটা সীমা থাকা দরকার। কারণ ঋণের সুদহারে যদি ঊর্ধ্বসীমা না থাকে তাহলে ওই ঋণগ্রহীতারা যারা ঋণ নিচ্ছেন তারা হয় খুব ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নেবেন অথবা যারা মনে করেন ঋণ নিচ্ছি আর ফেরত দেব না তাদের কাছে তো সুদের হার কোনো বিষয় না। আমাদের বাস্তবতায় ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেওয়ার বাস্তবতা আছে। কিন্তু এই বাস্তবতা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বোঝে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : তিন বছর আগে যে ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালীদের, সেই ব্যাংকগুলো যে খুব বেশি আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি এটা ঠিক। ১ হাজার কোটি টাকার আমানতও অনেকে সংগ্রহ করতে পারেনি বা নেই। এভাবে তারা টিকে থাকতে পারবে না। এখন প্রশ্ন উঠেছে- ওই ব্যাংকগুলো আবার একত্রিত করা হোক বা কমিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এই ব্যাংকগুলোকে যখন অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তখন বহুবার আমরা বলেছি বাংলাদেশের মার্কেটে এত বেশি জায়গা নেই। এটা এতদিন পর বুঝতে পারল কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়েছিল বলে মনে করল তারা।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কি কমে যাচ্ছে আর্থিক খাতের প্রতি?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : দেখুন এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, আস্থা কিংবা বিশ্বাস উঠে গেলে তো ব্যাংক খাতই ধসে পড়ে যাবে। তবে যে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের দিক থেকে বড় সেগুলোতে বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। তারপরও এগুলোতে আমানত কমেনি। তার মানে এগুলোতে আমানতকারীরা কোন ব্যাংকে কেলেঙ্কারি হচ্ছে সেটা দেখেন না। একটা অলিখিত নিয়ম দেখেন আমানতকারী যে, ব্যাংকে টাকা রেখেছি সরকার আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আছে তারা রক্ষা করবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শোনা যাচ্ছে সরকার কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করবে। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : এখন ব্যাংককে রক্ষা করতে হয়। কারণ আমাদের মতো দেশে দু-একটা ব্যাংক উঠে গেলে আমানতকারীর বিরাট ক্ষতি হবে ও ব্যাংকের ওপর থেকে আস্থা চলে যাবে। এতে পুরো ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো না কোনোভাবে ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করা হয়। তবে এটা সব সময় টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সেটা করাও ঠিক হবে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাকে ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন সব সময়।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর