১. মানুষ কি এখন আর মাটির গন্ধ শুনতে পায়? সেই গন্ধ, যে গন্ধে মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধনের মতো কেমন যেন আপন করে নেওয়া খুব চেনা একটা আঁতুড় ঘরের অনুভূতি ছিল, মনে হতো এই মাটির গন্ধের ভিতর যেন নিজের মনটাই ডুবে আছে। সবাই বলে, আয়নায় নিজের মুখ দেখা যায়, আর আমি বলি, মাটির গন্ধে নিজের ভিতর-বাহির সবটাই দেখা যেত। এক দিন এমন ছিল মাটির সেই গন্ধ মানুষের শরীরে এসে মিশে যেত, পরম আনন্দ ছড়িয়ে পড়ত মানুষের চোখে-মুখে। সবাই বলত, আহা, এমনও কি মানুষ হয়, মানুষ তো নয় যেন মাটির মানুষ।
মাটির মানুষ মানে খুব সহজ-সরল একটা মানুষ, যাকে দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যেত, মনের আগুন পুড়ে নিমেষেই ছাই হয়ে যেত। বেশভূষা খুব সাধারণ, বগলে পুরনো দিনের কালো রঙের লম্বা ছাতাটা আঁকড়ে ধরে থাকা, ফুরফুরে মন, মনে হতো সুখ নিজেই সুখ পেতে মানুষটার পেছনে ছুটছে, অথচ মানুষটার ভিতরের পরম তৃপ্তিকে ধরতে পারছে না। খুব অদ্ভুত একটা বিষয়, সেই মাটির মানুষটা সুখ কি জানে না, অথচ সুখ তার দেহজুড়ে, মনজুড়ে। সুখ সেটা নয়, যেটা মানুষ চায়, সুখ সেটা যেটা মানুষের ভিতর থাকে, অথচ মানুষ কখনো সুখকে খোঁজে না।
সেই মাটির মানুষগুলো কেমন করে যেন হারিয়ে গেল। এখনো নগরের পর নগর পেরিয়ে, জনপদের পর জনপদ মাড়িয়ে মাটির খোঁজ হয়তো মেলে, অথচ সেই মাটিতে আর গন্ধ নাই, আবেগ নাই, অনুভূতি নাই, মাটির গন্ধ নাকে টেনে নেওয়ার সাহস, স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস নাই, কারণ এখন মাটির চেয়ে মানুষ বেশি, অথচ মানুষের মতো মানুষটাই নাই। জীবনটাই এখন একটা খেলা, কেউ কেউ পর্দার আড়ালের খেলোয়াড়, বাকি সবাই খেলনা। এই খেলাটা খুব জটিল, যেখানে মানুষ প্রতিদিন বিক্রি হয়ে যায়, অথচ মানুষ মনে করে সে কিনতেই জানে, বিক্রি হতে জানে না। এটাই খেলা, যার শুরু আর শেষ দুটোই ভয়ংকর। এই খেলায় জয়, পরাজয় নেই, আছে ভিতরে ভিতরে পতন, আছে নির্মম পরিণতি।এখন মানুষ সুখের পিছে ছুটে, অথচ সুখ ধরা দেয় না কাউকেও। মানুষ এখন মনে করে পয়সা দিয়ে সুখ কিনবে, অথচ মানুষ ভুলে যায় সুখ কিনতে গিয়ে সেই সুখের কাছে বিক্রি হয়ে যায়।
আহা, যদি আবার মাটির গন্ধটা শরীরে মেখে নিজের ভিতরের মানুষটাকে চিনে নিয়ে নতুন করে জন্ম নিতাম! ভাবা যায় অনেক কিছুই, কল্পনার ফানুস উড়িয়ে মাটি থেকে ওপরে উঠতে উঠতে ওঠা যায় অনেক ওপরে, কিন্তু যা হারিয়ে যায় তা কি আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়?
২. একটা লেখা প্রায় দেখি, লেখাটা অনেকটা এমন ‘গাছের শেকড় পচে গেলে প্রথমে কে জানে, শেকড় না মাটি? সবচেয়ে দূরের ডালটিতে বসে ভেবে মরছে-সবুজ পাতাটি।’ খুব অদ্ভুত একটা দর্শন আছে এখানে, যেখানে প্রশ্নটা খুব সাদাসিধা মনে হলেও উত্তরটা কঠিন। এই জীবনটা বুঝি এমনই, যেখানে প্রশ্ন অনেক, উত্তর সবগুলোর নেই। কিংবা প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকলেও উত্তর ঠিক কোনটা হবে সেটা বুঝে উঠতে গেলে নিজেকেই বোঝাটা খুব কঠিন হয়ে যায়।
আচ্ছা, লেখাটার সূত্র ধরেই যদি বলা হয়, শেকড় যখন পচে যায়, কে প্রথম জানে, মাটি নাকি শেকড় নিজেই। মানুষ যখন পচে যায়, কে প্রথম জানে মানুষের নিজের রক্ত-মাংস-হাড়ে গড়া দেহ নাকি মানুষটা নিজেই। পচনের তত্ত্বটা খুব অদ্ভুত, যে পচে যায়, পচনের গন্ধে তার নাক-মুখ-দম বন্ধ হয়ে আসলেও সে বুঝতে পারে না সে নিজেই পচে গেছে। বরং সে নিজের দিকে তাকানোর চেয়ে চারপাশে তাকিয়ে খুঁজে পচনের শেকড়টা কোথায়? সমস্যাটা এখানেই, নিজের পচনটা দেখার চেয়ে মানুষ চারপাশের পচনটাকে আগে দেখার চেষ্টা করে অথচ একটা আম ভর্তি ঝুড়িতে পচনশীল আমটা যে নিজে হতে পারে, সেটা মেনে নেওয়ার মতো সাহস তার থাকে না।
মানুষ এমন করে পচে গিয়ে কাপুরুষ হয়, অথচ নিজেকে সাহসী হিসেবে প্রমাণ করার প্রতিযোগিতায় নামে। মানুষ যেটা না, সেটাই সে দেখাতে চায়, মানুষ যেটা, সেটা সে দেখাতে ভয় পায়। পচে যাওয়াটাকে আগে জানল, কে পরে জানল, সেটার চেয়ে বড় পচে যাওয়ার উৎসটা খুঁজে বের করা। সে পচনের উৎসটা নিজের ভিতর থেকে কি না সেটাই আগে দেখা উচিত। মুনীর চৌধুরী বলতেন, ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’। আসলে মানুষ পচে গেলেই মরে যায়, পচে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকে, সেই বেঁচে থাকার সুখ সবাই পায় না। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলতেন, ‘কিছু কিছু মানুষ পঁচিশেই মারা যায়, দাফন করতে করতে পঁচাত্তর বছর লেগে যায়’। হয়তো কোনো কোনো মানুষের পচনটা অনেক আগেই ঘটে বলে তার প্রকৃত মৃত্যু ঘটে অনেক আগেই, কারণ মানুষ পচে গেলে মানুষের বিবেকও পচে যায়, মানুষের দৃশ্যমান দেহটা তখনো থাকে, যদিও আত্মার মতো মহামূল্যবান সম্পদের পুরোপুরি মৃত্যু ঘটে। অথচ এই মৃত মানুষটা তার পচে যাওয়া মৃতদেহটাকে নিজের কাঁধে বইতে বইতে অন্তিম বিদায়টা টেনে নিয়ে যায় অনেকটা দূর পর্যন্ত।
কিন্তু তাতে কী লাভ, চারপাশে যারা চিৎকার করে গর্ব ভরে বলছে বেঁচে আছি, এই পচনের যুগে তাদের কতজনইবা বেঁচে আছে! হয়তো যাদের আমরা বেঁচে থাকতে দেখছি তারাই মৃত, যাদের আমরা মৃত ভাবছি তারাই জীবিত। কে জানবে আগে এটা, মানুষ নাকি মনুষ্যত্ব! আবার প্রশ্ন, আবার বিব্রত, সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া।
৩. মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদকে দেখছিলাম, খুব কষ্ট হচ্ছিল চাঁদের জন্য। চাঁদের এত সোনায় মোড়ানো রূপ, অথচ এই সোনা ঝলমলে রূপ নিকষ অন্ধকারে ঢেকে যেত যদি সূর্যের আলো ধার হিসেবে না পেত। ভাবছি সূর্যের মহত্ত্বের কথা, চাঁদকে রূপবতী বানালেও নিজের আলোয় নিজেকে পুড়ে মরতে হচ্ছে অবিরত। সূর্যের এত দহন জ্বালা, তারপরও অন্ধকারে ডুবে থাকা পৃথিবীকে আলোয় উদ্ভাসিত করতে এতটুকু কার্পণ্য নেই তার।
কেউ কেউ মনে করে, কী আছে আর এই সূর্যের, নিজেকে পোড়ানো ছাড়া, প্রতিদিন নিজের আগুনে পুড়ে নিজেই ছাই হয়ে যায়। কিবা মূল্য আছে সেই পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের। চাঁদকে যদি সূর্য আলো না দিত, তবে সূর্যের অস্তিত্ব কি টিকে থাকত? চাঁদ আছে বলেই সূর্যের অস্তিত্ব টিকে আছে। অথচ কেউ কি কখনো ভেবেছে, যে পুড়তে জানে, সে চাঁদের ভিতর আলো ছড়িয়ে মুগ্ধতার জন্ম দিতে জানে। যে যুদ্ধে নামতে জানে, সেই শান্তির পরশ বুলিয়ে জীবনের অলিগলিতে আনন্দ-উৎসবের জন্ম দিতে জানে। যে সিংহের মতো মরতে জানে, সেই পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়ে ইতিহাস বদলাতে জানে।
কবি-লেখকরা চাঁদের প্রেমে পড়ে চাঁদকে নিয়েই কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেছে। চাঁদের ভিতর কলঙ্ককে খুঁজেছে, আবার চাঁদের রূপে ডুবে মরেছে। সাধারণ মানুষেরাও চাঁদের রূপের লোভে পড়েছে, ভেবেছে আহা, এমন চাঁদনী রাত যেন শেষ হয়ে না যায়। অথচ সূর্য অবহেলিত হয়েছে, হয়তো অভিমান হয়েছে সূর্যের, কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতেও দেয়নি, কারণ অবহেলিতরা অভিমান করতে জানে, অপমান হয়তো হয় বারবার, কিন্তু অপমানিত হতে জানে না। মানুষ কোনটা হতে ভালোবাসে, চাঁদ নাকি সূর্য! হয়তো চাঁদ, কারণ মানুষ চাঁদের মতো সুবিধাবাদী হয়ে কেবল নিতেই জানে, অথচ পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যারা মানুষকে কেবল দিয়েই যায় তেমন সাহসী হতে জানে না। যারা সাহসী হয়, তারা সূর্যের মতো করে নিজে পুড়ে, নিজেকে পোড়ায় অথচ মানুষের জন্য রেখে যায় নিরাপদ এক পৃথিবী। এমন মানুষেরা চাঁদের মতো করে গর্বিত হতে জানে না, বরং নিজের মাথা নিচু করে পাদপ্রদীপের নিচে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, অথচ উজাড় করে দেয় তার সবটুকু। সারা পৃথিবীর বোঝা মাথায় নিয়ে এমন অনেক মানুষ হয়তো আমাদের আশপাশেই থাকে। আমরা মনে করি, এই মানুষটার মূল্যইবা কতটুকু, এমন মানুষ থাকলেই কী আর না থাকলেইবা কী। আমরা যে এখন আর সূর্যের মতো মানুষদের দেখি না, এজন্য সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতেও পারি না। আমরা নির্লোভ, ত্যাগী, মহতী মানুষের চিনতে পারছি না, নিজের অস্তিত্বের সংকটই যে এমন অদ্ভুত পরিবেশের জন্য দায়ী সেটাও বুঝতে পারছি না। আমরা চাঁদের মতো মানুষের দিকেই তাকাই, অথচ ভুলে যাই, এই চাঁদ মানুষটার অস্তিত্ব থাকত না যদি সূর্য মানুষটা টিকে না থাকত।
বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, মন্ত্রী, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, উঁচু উঁচু পদধারী মানুষদের দিকেই এখন আমাদের দৃষ্টি, অথচ কৃষক না থাকলে খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা মিটত না, শ্রমিক না থাকলে বড় বড় মার্বেল পাথরে খোদায় করা দালানকোঠায় নিরাপদ বাসস্থানের চাহিদা মিটত না। ক’জন ভাবে সেই অচেনা, অজানা কৃষক, শ্রমিক, তৃণমূল মানুষদের কথা। চোখটা ওপরে উঠতে উঠতে এখন আমাদের কপালে উঠেছে, চোখ আছে, দৃষ্টিশক্তি নেই, দৃষ্টিভঙ্গি নেই, অথচ মিথ্যা দম্ভের ঘাটতি নেই। সবার অজান্তে এমন মানুষদের জন্ম হয়, সবার অজান্তেই মৃত্যু হয়, অথচ সবার অগোচরে থেকে তারা যা দিয়ে যায়, তেমন দেওয়ার মতো উদার মানুষ আর কতজনইবা পৃথিবীতে আছে।
এখন আবার সূর্যের জন্য কষ্ট হচ্ছে, জানি না কেন এমন হয়, নিজের ভিতরেই ডুবে আছি, অথচ আমি নিজেই নেই। কেবল হাতড়াচ্ছি, নিজেকে খুঁজতে গিয়ে আঁকড়ে ধরতে পারছি না কিছুই, চারপাশে যে কেবল শূন্যতা, অসীম শূন্যতা।
৪. কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন নিজেকে পিছিয়ে নিতে হয়, লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে নিতে হয়, খুব খারাপভাবে হারতে হয়, ক্ষিপ্ত গতিতে এগিয়ে চলা পাগলা ঘোড়াটার লাগামটা টেনে থেমে যেতে হয়। রঙ্গমঞ্চের পৃথিবীকে দেখাতে হয়, আপনার নাম-গন্ধ আর পৃথিবীতে নেই, প্রস্থানের মতো বাস্তবতাই এখন আপনার জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। আপনি আর সেই আপনি নেই, মূল্যহীন একটা বস্তুতে পরিণত হয়েছেন।
লাভ একটাই, এতদিন যারা আপনার সামনে প্রশংসা ও পেছনে দুর্নাম করত, তারা একটু দম ফেলানোর সময় পাবে আর আপনিও এদের চিনে নিতে পারবেন। সময় আপনাকে আরও দেখাবে, এতদিন আপনার চারপাশে যে স্বার্থপর ও অভিনেতাদের দল ছিল, তারা আপনাকে ছেড়ে আরেকজন এগিয়ে যাওয়া মানুষের পিছু নিয়েছে। এরা এমনই অন্যের কাঁধে ভর করে বড় হতে চায়, অন্যের ভিতরে বিশ্বাস জন্মিয়ে বিশ্বাস হরণ করতে চায়।
এই লোকগুলোকে চিনুন, কারণ এরা আগাছা হয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু সুযোগমতো আপনার সমস্ত অর্জনে পানি ঢেলে সর্বনাশ করতে ছাড়ে না। এরা কখনো কখনো পরজীবী হয়ে আপনার ওপর এমনভাবে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে যে, আপনাকে আর স্বাধীনভাবে চলতে দেয় না, বরং আপনাকে তাদের আগ্রাসনের শিকারে পরিণত করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ, কিন্তু সবাই মানুষ নয়। আর সব সময় আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে একটা কথা মনে রাখবেন, সুদিন এক দিন আসবেই আর প্রস্থান মানে চিরবিদায় নয়, বরং সব জেনে-বুঝে নিজেকে আরও উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর