মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আত্মশুদ্ধি ও সিয়াম সাধনা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

আত্মশুদ্ধি ও সিয়াম সাধনা

ধৈর্যের মাস, মানুষের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশের মাস, আত্মশুদ্ধি আর খোদার নৈকট্য অর্জনের অসীম রহমত ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান আমাদের মাঝে সমুপস্থিত। মাহে রমজানে রোজা পালন বা সিয়াম সাধনাকে ‘পরহেজগারী অর্জনের জন্য’ ফরজ বা অবশ্য পালনীয় বলে বিধান দিয়ে আল কোরআনে বলা হয়েছে- ‘পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের জন্যও একই বিধান ছিল’। অর্থাৎ রোজা পালন শুধু কোরআনের বিধান ঘোষিত হওয়ার পর থেকে প্রবর্তিত হয়নি। আত্মশুদ্ধি ও বিধাতার নৈকট্য লাভের জন্য কৃচ্ছ্রসাধন ইবাদত হিসেবে শুধু ইসলামে পরিপালনীয় নয়, স্থান কাল পাত্র ভেদে সব সম্প্র্রদায় এর মধ্যে আত্মিক নির্বাণ লাভের এ সাধনা বিদ্যমান।

মহিমান্বিত মাহে রমজানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে আল কোরআনে। বলা হয়েছে ‘রমজান মাস এমন একটি মাস, এই মাসেই কোরআন মাজিদ নাজিল করা হয়েছে।’ (২ সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)। এ আয়াতের পরবর্তী বাক্যে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে যেন অবশ্যই এ মাসের রোজা পালন করে।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব আল কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার গৌরবে দীপ্ত ও তাৎপর্যমন্ডিত মাহে রমজান। এ মাসে রোজা পালন আল্লাহ রব্বুল আলামিনের তরফ থেকে এক বিশেষ নির্দেশ। কেননা এ রোজা পালনের মধ্যে রয়েছে ‘অধিকতর কল্যাণ’ (২ সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৪)।

আল কোরআনে মানবের সার্বিক কল্যাণের যাবতীয় পন্থা ও পথনির্দেশ রয়েছে। সে কারণেই সুরা বাকারার ১৮৫ সংখ্যক আয়াতে এ কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে ‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা পালন করবে।’ তবে মাহে রমজানে রোজা পালনের আবশ্যিক এ বিধান এ মাসে ‘অসুস্থ’ আর ‘মুসাফির’দের জন্য শিথিল করে দিয়ে বলা হয়েছে- ‘অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটিও যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে।’ আল্লাহ রব্বুল আলামিন সিয়াম সাধনার এ সুযোগকে তার প্রিয় বান্দাদের জন্য ‘সহজ করতে চান’, তিনি ‘কোনো জটিলতা কামনা করেন না।’ আর এ মহাসুযোগ এনায়েত করার জন্য কোরআনই শিখিয়ে দিয়েছে ‘তোমাদের হেদায়েত দান করার জন্য আল্লাহতায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ সিয়াম সাধনা বস্তুত কৃচ্ছ্রসাধনের এমন এক পর্যায় যা আত্মশুদ্ধির সুযোগকে করে অবারিত এবং আর আনে সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতের প্রাপ্তিতে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ লাভে অনাবিল আনন্দ। আত্মিক, শারীরিক, মানসিক ও সর্বোপরি সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিতকারী এমন কল্যাণপ্রদ পরিপালণীয় বিষয় আর নেই।

সাহরি ও ইফতার রোজার দুই গুরুত্বপুর্ণ পর্যায়। মহানবী (সা.) সাহরি খাওয়াকে মুস্তাহাব বা খুবই পছন্দনীয় কাজ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত রোজা রাখার জন্য শেষ রাতে কিছু পানাহার করা চাই। নবী করিম (সা.) বলেছেন ‘তোমরা সাহরি খাও। সাহরি খাওয়ায় নিশ্চয়ই বরকত রয়েছে।’ তিনি বলেছেন ‘যে লোক রোজা রাখতে চায়, তার কিছু খেয়ে সাহরি পালন করা কর্তব্য। তিনি আরও বলেছেন, ‘মুসলমানদের ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের রোজা রাখার একটি পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানগণ সাহরি খেয়ে রোজা রাখে আর অমুসলমানরা সাহরি না খেয়ে রোজা থাকে।’ হজরত আবুজর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে- রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘আমার উম্মত যতদিন ইফতার ত্বরান্বিত করবে এবং সাহরি বিলম্বিত করবে ততদিনে তারা কল্যাণকর হয়ে থাকবে।’ সূর্যাস্তের মুহূর্তে ইফতার করার সময়। এ মুহূর্ত উপস্থিত হওয়া মাত্রই রোজা খুলে ফেলা কর্তব্য। ইফতার করতে অকারণ বিলম্ব হওয়া উচিত নয়। যদি কেউ এ বিলম্বকে অধিক সওয়াব পাওয়ার উপায় কিংবা অধিক তাকওয়া দেখানোর শামিল মনে করেন তা আদৌ সঠিক নয়। ইফতার ত্বরান্বিত করা কেবল রসুল (সা.)-এর পছন্দ নয় আল্লার নিকটও তা অধিকতর প্রিয়। হাদিসে কুদসিরূপে উল্লিখিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ‘আমার নিকট ওই ব্যক্তি সর্বাধিক প্রিয় যে শিগগিরই ইফতার করে।’ সিয়াম সাধনার ফলে রোজাদারের জীবনযাপন প্রণালি শৃঙ্খলামন্ডিত হয়ে ওঠে। যথামুহূর্তে ইফতার করা এবং শেষ রাতে সাহরি খাওয়া সেই শৃঙ্খলা বিধান ও নিয়মতান্ত্রিকতারই অংশ। ইফতার করার পূর্বে ইফতারসামগ্রী সামনে নিয়ে সময়ের অপেক্ষা করার মধ্যে ধৈর্যশীলতা ও নিয়মনিষ্ঠার পরিচয় নিহিত। সাহরি ও ইফতার উভয়ই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে স্বাস্থ্যসম্মত ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

তারাবির নামাজ সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। হজরত হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এবং বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, যে ব্যক্তি রমজান মাসের রাত্রিতে ইমান ও সতর্কতা সহকারে নামাজ আদায় করবে, তার পূর্বের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। এ হাদিসে কিয়ামে রমজান হিসেবে যে নামাজের উল্লেখ করা হয়েছে, হাদিস ব্যাখ্যাকারকগণ তাকে তারাবির নামাজ বলে শনাক্ত করেছেন। তারাবি তারাবিহাতুন শব্দের বহুবচন। তারাবিহাতুন এর অর্থ আরাম করা, বিশ্রাম করা। বিশেষ নামাজের নাম তারাবি রাখার কারণ এ নামাজ প্রতি চার রাকাত আদায়ের পর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম করা বা বিশ্রাম দেওয়া হয়। আরবি ভাষাতত্ত্বে তারাবি শব্দের বুৎপত্তি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রতি চার রাকাত নামাজের পর বসে বিশ্রাম করা হয় এবং যে নামাজ এশার ফরজ ও সুন্নাতের পর এবং বেতেরের নামাজের পূর্বে পড়া হয়। তারাবির নামাজ পাঠ সুন্নত। মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের রোজা থাকা ফরজ করেছেন আর আমি সুন্নতরূপে চালু করেছি রমজান মাসব্যাপী আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ানো (তারাবির নামাজ)। মহানবী (সা.) তারাবির নামাজ পড়েছেন কিন্তু তা রীতিমতো প্রত্যেক রাতে পড়েননি। এর কারণস্বরূপ তিনি নিজেই বলেছেন, রোজার রাতের এই তারাবির নামাজ তোমাদের প্রতি ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয় করছি আমি। হাদিস বেত্তাগণের মতে, তারাবির নামাজ মুস্তাহাব, অর্থাৎ এ নামাজ ফরজ বা ওয়াজিব নয়।

তারাবির নামাজ সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম অঙ্গ। সিয়াম সাধনা একটি ট্রেনিংবিশেষ যার মুখ্য উদ্দেশ্য রোজাদারের জীবনযাপনকে শৃঙ্খলামন্ডিত করে তোলা। আরাম ও আয়েশ প্রবণতাকে সংযত করাও এ ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য। জীবনে সংগ্রাম ও কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। সারা দিন রোজা রাখার পর রাতে বিশ্রাম গ্রহণের অনিবার্য আকাক্সক্ষাকে অবদমিত করে তারাবির নামাজ পাঠ করা হয়- কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের এটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রক্রিয়াও বটে। বিশ্রাম ও আরাম-আয়েশ প্রবণতাকে সচেতনভাবে হ্রাস করার মাধ্যমে একজন রোজাদার মুসলমান ব্যক্তিগত জীবনে কঠোর পরিশ্রমের দীক্ষা লাভ করতে পারে। তারাবির নামাজ পাঠের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর করার লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রমের অনুপ্রেরণা। আল্লাহর প্রকৃত বান্দা, সত্যের সৈনিক কখনো আরামপ্রিয় হতে পারে না। পরকালমুখিনতার কারণেও শুধু নয়, দুনিয়ামুখিনতার কারণেও আরামপ্রিয় হলে চলে না। জীবন-সংগ্রামে কৃতকার্য হতে হলে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হয়। সুতরাং তারাবির নামাজে আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু শরিক হওয়া নয়, এ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আরামকে হারাম করে কঠোর পরিশ্রম করার দীপ্ত শপথের ও মানসিকতা অর্জনের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তারাবির নামাজে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে একাগ্রচিত্তে বিনীতভাবে আল্লাহর কালাম শ্রবণ করতে হয়। এভাবে এ নামাজ আরামকে হারাম করার মনোবল সৃষ্টিতে সহায়তা করার মাধ্যমেই এর কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে।

                     

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান

সর্বশেষ খবর