বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

রোজাদারদের ইফতার

আবদুর রশিদ

ইসলামে সিয়াম সাধনা বা রোজা ফরজ ইবাদত। তবে এটি যাতে আত্মনিগ্রহ না হয়ে দাঁড়ায় সে জন্য রোজা শেষে ইফতারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সারা দিন সিয়াম সাধনায় রত থেকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ইফতার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা কী যে আনন্দের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের সময় রয়েছে- এক. ইফতারের সময়। দুই. মহান প্রভুর দিদার লাভের সময়।’ (বুখারি)

ইহুদিদের রোজা ছিল আত্ম নিগ্রহের। দেহ ও মনকে কষ্ট দেওয়ার রোজা। ইসলামের রোজা তেমন নয়। আল্লাহ বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। নামাজ, রোজা, হজ সবকিছুই ফরজ ইবাদত। তবে ইবাদতের নামে বাড়াবাড়িও ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বান্দা ইবাদতের নামে আত্মনিগ্রহের আশ্রয় নেবে তা মহান আল্লাহর কাম্য নয়। ইবাদতের নামে নিজের সাধ্যের চেয়ে বেশি কিছু করার ধারণাকেও উৎসাহিত করা হয়নি আল কোরআন ও হাদিসে। জীবনযাপন ও ইবাদত সব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা বজায় রাখাই ইসলামের শিক্ষা। পথিক যেমন অবিরত পথ অতিক্রম করে, অনুকূল সময়ে সফর করে, অবশিষ্ট সময়ে নিজেও বিশ্রাম নেয় এবং নিজের বাহনকেও বিশ্রামের সুযোগ দেয়, দীনের পথের পথিকের অবস্থাও তেমন হওয়া উচিত। নিজেকে সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কঠোরতার মধ্যে নিক্ষেপ করা, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে নফল ইবাদতে কড়াকড়ি করা ইত্যাদি কারণে দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ির পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিজের মর্যাদাহানি করা মুমিন ব্যক্তির জন্য শোভা পায় না। সাহাবিরা বললেন, মুমিন ব্যক্তি কেমন করে নিজের মর্যাদাহানি করতে পারে? তিনি বললেন, নিজেকে সামর্থ্যরে অতিরিক্ত পরীক্ষার সম্মুখীন করা।’ তিরমিজি থেকে মিশকাতে, বাব জামিউদ-দুআ। উপরোক্ত হাদিসে স্পষ্ট হয়, মানুষ সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করুক আল্লাহ ও তাঁর রসুল তেমনটিই চেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির কোনো অবকাশ নেই। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) নামাজ আদায়ের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি ভেজা খেজুর না থাকত তবে সাধারণ শুকনো খেজুরই গ্রহণ করতেন। যদি তা-ও না থাকত তবে কয়েক ঢোক পানিই হতো তাঁর ইফতার।’ (তিরমিজি)। হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন, আমার তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়েছে, আমার শিরা-উপশিরা সিক্ত হয়েছে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আমার পুরস্কারও নির্ধারিত হয়েছে।’ (আবু দাউদ)। ইফতারের সময় হওয়া মাত্র দ্রুত ইফতার গ্রহণ করা সুন্নত। রসুল (সা.) অত্যন্ত আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সঙ্গে ইফতার গ্রহণ করতেন এবং ইফতারের সময় হলে দ্রুত ইফতার করতেন। সাহাবায়ে কিরামও সর্বদা তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন এবং দেরিতে সাহরি করতেন। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি ওই ব্যক্তিকে সর্বাধিক ভালোবাসি যে ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করে নেয়।’ (তিরমিজি)। তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘মানুষ যত দিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে তত দিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে।’ (বুখারি)। সারা দিন অভুক্ত থেকে ইফতার সামনে নিয়ে চোখের দুই ফোঁটা পানি ছেড়ে দিয়ে বান্দা যখন আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে, মহান আল্লাহ তখন তাঁর প্রিয় বান্দাকে রহমতের চাদরে আবৃত করে নেন, অপরাধগুলো মার্জনা করেন এবং তার সব ফরিয়াদ কবুল করে নেন। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো প্রত্যাখ্যান করা হয় না। ১. ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর দোয়া ২. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া ৩. মজলুমের দোয়া।’ (তিরমিজি)

মাহে রমজানে রোজাদারকে ইফতার করানো একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল ও সওয়াবের কাজ। রসুল (সা.) রোজাদারকে ইফতার করানোর ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামকে উৎসাহিত করেছেন এবং একে ফজিলতময় ও সওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কেউ যদি মাহে রমজানে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় তাহলে ওই ইফতার করানোটা তার গুনাহ মাফের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে অথচ রোজাদারের সওয়াব বিন্দুমাত্রও কমানো হবে না। সাহাবিরা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসুুল! আমাদের সবার তো আর রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। প্রিয়নবী (সা.) বললেন, আল্লাহ তাকেও এ সওয়াব দান করবেন যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে এক ঢোক দুধ অথবা একটি খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দ্বারাও ইফতার করাবে।’

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর