শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রিয় সাদি মহম্মদ

ফরিদুর রেজা সাগর

প্রিয় সাদি মহম্মদ

প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদের মৃত্যুর পর, দেখলাম সাদি বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা ছোট। কিন্তু সারা জীবন আমি ভেবেছি সাদি আর শিবলী আমরা প্রায় সমবয়সী। এমন ভাবার কারণ হলো একটা, আমার যদ্দুর মনে পড়ে সাদি এবং শিবলী দুজনই যে বছর খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য গিয়েছিল, ভর্তি হয়েছিল, সে সময় আমাদেরও লেখাপড়াটা সেরকম পর্যায়ে ছিল। কিন্তু বয়সের পার্থক্য যাই হোক না কেন, সারা জীবন এ দুজনের সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের মতোই। একজন নাচত আর একজন গান গাইত। গানের সঙ্গে যেহেতু আমার সম্পর্ক একটু বেশি সে কারণে সাদির সঙ্গেও আমার অন্তরঙ্গতা শিবলীর চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল।

শিবলী মহম্মদ এ বছর একুশে পদক পাওয়ার পর ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। কথা হয়েছিল নানা বিষয়ে। আর সাদির সঙ্গে দেখা হয়েছে এ মাসের ৫ তারিখে। চ্যানেল আইতে সাদির গানে গানে সকাল শুরুতে গান ছিল। এর বাইরে আরেকটি বিশেষ অনুষ্ঠানে। তার কয়েকদিন আগেও দেখা হয়েছিল অন্য কোনো এক জায়গায়। সাদিকে দেখলাম বিষণœ এবং খুবই হতাশ। সাদির, সঙ্গে কথা হলো।

-‘এই যে সাগর ভাই আপনি আমার গানটা শুনে যান।’

কথা খুব সুন্দর করে, আস্তে আস্তে গুছিয়ে বলত সাদি

-‘আমি বললাম- আমি তো শুনবই তোমার গান।’

-‘সাদি বলল- না, না, একটু আমার সামনে বসে শুনে যান। কবে আবার গান গাইতে পারব, কবে আবার আপনাকে পাব। কবে এ-গান হবে কে জানে।’

‘আমি বললাম, কেন তুমি এত হতাশ হচ্ছো। তোমার গান যখনই হয়, যেখানে হয় আমি অবশ্যই বসে বসে শুনি বা দেখি এবং তুমি যে নতুন শিল্পীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমরা যখন অনুরোধ করি যে, তুমি অমুক শিল্পীর সঙ্গে গান গেয়ে দাও, তুমি কখনো না বল না। এটা তোমার অনেক বড় গুণ।’ ‘সাদি বলে, কী করব বাচ্চারা তো গান শিখতে আসে, শুনতে আসে। ওদের সঙ্গে বসে যদি একটু গান গাই ওরা উৎসাহিত হয়। তারপর তারা ভবিষ্যতে কী করবে, কতটা ভালো তারা গাইবে কিংবা সংগীতের জন্য কতটুকু জীবনের সময়কে উৎসর্গ করবে সেটা তাদের ব্যাপার।’

শুধু তরুণ শিল্পীদের জন্য তা নয়, সাদি খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত গান গাইতে অনেক প্রবীণ শিল্পীর সঙ্গে।

আমার মনে আছে, সাদি মহম্মদ এবং রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ডুয়েট রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবামও বেরিয়েছে অনেক। পুরনো দিনের গানও বেরিয়েছে এবং সেই গানগুলো রেকর্ডিংয়ের সময় সাদি মহম্মদ কীভাবে গানগুলো খুঁজে নিয়ে এলো, সুর-স্বর-তাল-লয় সব যাতে ঠিক থাকে, নিখুঁত থাকে তার জন্য কী পরিমাণ পরিশ্রম বন্যার সঙ্গে করেছে-সেটা আমি দেখেছি।

আরও একটা ব্যাপার। তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে বা পরিচিত শিল্পীদের সঙ্গে সাদি একসঙ্গে গান গাইত তা নয়। অনেক তরুণ শিল্পী যারা ভালোভাবে গান গাইতে পারছে না। কিন্তু একসময় ভালো গাইত। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য অনেক সময় তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠান করত। বসত টেলিভিশনের পর্দায়। বিশেষ করে চ্যানেল আইয়ের ‘গান দিয়ে শুরু’র অনুষ্ঠানে।

আমি অনেকের কথাই বলতে পারব, যারা বলেন বা যারা বলতেন- ‘সাদির জন্যই এখনো বেঁচে আছি।

কারণ তাদের শুধু যে অনুশীলনে সাহায্য করত সাদি, তা নয়, হারমোনিয়াম বাজিয়ে তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, তাদের এই ভোরবেলার এ অনুষ্ঠানে নিয়ে আসত এবং অনুষ্ঠানে যদি তারা ভালো গায়, মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে, দর্শকদের সামনে সেই ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেত একেবারেই হাসিমুখে। একজন শিল্পীর এই যে প্রচেষ্টা। স্কুল না করে শুধু রবিরাগ বলে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থেকে সারা দেশের শিল্পীদের সেখানে একত্রিত করা এবং নানা রকম অনুষ্ঠান। বিশেষ করে ধানমন্ডি লেককে কেন্দ্র করে। রবীন্দ্রসংগীতকে কেন্দ্র করে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা নিয়ে অনেক রকম অনুষ্ঠান সাদি করেছে।

শান্তিনিকেতনে থাকা নিয়েও অনেক গল্প রয়েছে। সাদি কীভাবে পড়াশোনা করত, ঘুরত। কেমন করে বন্ধুদের মধ্যে সবাইকে আনন্দে রাখত। সে সম্পর্কে শুভেচ্ছার একটি অনুষ্ঠানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা অনেকক্ষণ গল্প করেছিলেন। সাদি সেসব গল্প শুনে প্রাণ খুলে হেসেছিল।

সাদি যেমন প্রাণ খুলে হাসতে পারত, তেমনি প্রায় প্রতি বছরই, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ দিবসে সাদি ইচ্ছা করে সকালের গানের অনুষ্ঠানে আসত এবং সেখানে তার বাবাকে যে তার চোখের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করেছে, সেই বর্ণনা দিত এবং সবাইকে সচেতন করে দিত, সজাগ করে দিত। পাকিস্তানি শত্রুদের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে দেশপ্রেমের কথা। দেশের কথাও সে বলত। সে জানত, তার অনুষ্ঠানের বহু শ্রোতা তরুণ প্রজন্ম। সুতরাং তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, বাংলাদেশের জন্য সবার ভালোবাসা এ ব্যাপারে সাদি সব সময় তার গান দিয়ে চেষ্টা করেছে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য।

সাদি মহম্মদের একটা বড় দুঃখ ছিল। এই ১২ তারিখে এক অনুষ্ঠানে সাদি খুব দুঃখ করে বলছিল, কোনো একজন শিল্পীকে যে, তার আর পদকের দরকার নেই। রাষ্ট্রীয় কোনো পদকের দরকার নেই। কারণ, মরণোত্তর পদক দিয়ে সে কী করবে। হঠাৎ কেন মরণের কথা এলো। কিংবা হঠাৎ কেন সে আমাকেই বা কেন বলল। বসে আমার গানটা শুনে যান আবার কবে শোনাব। তার উত্তর আজ আমাদের কাছে অজানা। কিন্তু একটা কথা জানি, সেটা হলো পুরস্কারের জন্য তো কখনো শিল্পীরা গান গান না। যদি একটা পুরস্কার আসে সেটা তাদের উৎসাহ জোগাতে পারে, তাদের মনে একটু আনন্দ দিতে পারে। সেই ক্ষণিকের আনন্দ তারা ভুলে গিয়ে আবার নিবেদিত হন গানচর্চায়। সাদি মহম্মদ একজন সেরকম নির্মোহ শিল্পী ছিল। কিন্তু তারপরও একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তার মনেই হতে পারে পুরস্কার তার সংগীতের জন্য পাওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে সে যে পুরস্কার পেয়েছে। চ্যানেল আইয়ের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার সে পেয়েছে। ১৯১২ সালে এবং আমার মনে আছে, পুরস্কার পাওয়ার পর সে বলেছিল, ‘এটাই আমার জীবনের রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে প্রথম পুরস্কার। এই পুরস্কারের জন্য আমি অনেক আনন্দিত।’

পরবর্তী পর্যায়ে ২০১৫ সালে সে বাংলা একাডেমির পুরস্কার পেয়েছে। আর নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আমাকে বললেন, এই বছর শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার তার পাওয়ার কথা। জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি রবীন্দ্রসংগীতের জন্য পুরস্কার যাকে দেয় সেই পুরস্কার পাওয়ার কারণে হয়তো এবার একুশে পদকে দুই ভাইয়ের নামই একসঙ্গে থাকতে পারত। সেখানে শুধু শিবলী মহম্মদের নাম রয়েছে। আবার মনে করার চেষ্টা করি সাদি মহম্মদের মতো শিল্পীরা গান গায় আপামর দর্শকদের জন্য, মানুষের ভালোবাসার জন্য। সাদির মৃত্যুর পর রাতের বেলায় যে পরিমাণ দর্শক এই রোজার দিনে তার বাসায় গেছে, হাসপাতালে গেছে, তাতে কি প্রমাণ হয় না সাদি মহম্মদ দর্শকদের অনেক কাছের মানুষ ছিল। প্রিয় মানুষ ছিল। সাদি মহম্মদের গান বহু মানুষের ভালো লাগত। ভালো লাগবে। ভালো থাকবেন সবাই। 

লেখক :  মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর