শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মেশানো কবিরা গুনাহ

এম এ মান্নান

সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মেশানো কবিরা গুনাহ

যারা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তাদের জন্য পবিত্র কোরআনে আছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ৪২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘এবং তোমরা সত্য মিথ্যার সঙ্গে মিশিও না এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন কর না।’ রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মিথ্যা সংবাদ প্রচার, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কবিরা গুনাহ’ (বুখারি, মুসলিম)। মুমিনদের সত্যনিষ্ঠ হওয়ার যে তাগিদ আল কোরআন ও হাদিসে দেওয়া হয়েছে তা মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অবশ্য-পালনীয় হওয়া উচিত। সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সত্য গোপন করা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া যেহেতু ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ সেহেতু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এটি অনুসরণীয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্য প্রকাশই সাংবাদিকতা, সংবাদপত্রসহ সব সংবাদমাধ্যমের জন্য তা অবশ্য-পালনীয় নীতি হওয়া উচিত। আল কোরআন নাজিল হয়েছিল মানব সমাজকে সত্য অবহিত করার জন্য। হজরত আদম (আ.) থেকে রসুল (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রসুলের আবির্ভাব হয়েছে মানুষকে সুপথে পরিচালনার উদ্দেশ্যে। তাঁরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে সত্যের সংবাদ বাহক হিসেবে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও যা অনুসরণীয় নীতিমালা বলে বিবেচিত। এ যুগে যারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত তাদের সবারই উচিত সংবাদ পরিবেশনে আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশনা মেনে চলা। সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ঐশী নির্দেশের তাৎপর্য অপরিসীম। সাংবাদিকদের দায়িত্ব সত্য তুলে ধরা। সঠিক খবর ও বিষয় সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা। এ ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা গাইডলাইন হিসেবে বিবেচিত হলে দেশ, জাতি ও সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। সুরা হুজুরাতের ৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, পাছে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বস এবং তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হয়।’ পবিত্র কোরআন সংবাদ পরিবেশনে প্রতারণা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। ইরশাদ করা হয়েছে- ‘বল, আমি (মুহাম্মদ) তোমাদের বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভান্ডার আছে, অদৃশ্য সম্বন্ধেও আমি অবগত নই। তোমাদের এটাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমার প্রতি যে ওহি নাজিল হয় আমি শুধু তা-ই অনুসরণ করি। বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন কর না?’ (সুরা আনআম-৫০)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্টতা দ্বারা। ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো’ (সুরা হা-মিম সাজদা-৪১)। রসুল (সা.) যে কোনো খবর অত্যন্ত ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতেন। রসুলুল্লাহ (সা.) একবার জাকাত সংগ্রহ করতে একজনকে একটি উপত্যকায় পাঠালে তিনি এসে খবর দিলেন সেখানকার লোকেরা মুরতাদ হয়ে গেছে। তারা জাকাত দিতে অস্বীকার করছে। এ কথা শুনে রসুল (সা.) মর্মাহত হয়ে যুদ্ধের জন্য খালিদ বিন ওয়ালিদকে নির্দেশ দিলেন। যুদ্ধে প্রেরণের আগে রসুল (সা.) তাঁকে নির্দেশ দিলেন, সেখানে আক্রমণ শুরু করার আগে ভালোভাবে খোঁজখবর নিতে। খালিদ বিন ওয়ালিদ রাতের বেলা ওই উপত্যকা অবরোধ করলেন এবং ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। ফজরের সময় ওই উপত্যকা থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলে তিনি চমকে উঠলেন। এরপর তিনি ওই এলাকায় গিয়ে প্রকৃত অবস্থা জানতে চাইলেন। সেখানকার নেতৃস্থানীয়রা জানালেন, তারা জাকাত দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট লোকের অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সেখানে কেউ না আসায় তারা মদিনায় প্রতিনিধি পাঠানোর কথা ভাবছেন। প্রকৃত ঘটনা হলো এর আগে যাকে পাঠানো হয়েছিল তিনি ওই এলাকায় না গিয়ে পথিমধ্য থেকে ফিরে এসে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিলেন। আর মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের কারণে একটি উপত্যকায় বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছিল। কেবল রসুল (সা.)-এর বিচক্ষণতা ও প্রকৃত সংবাদ যাচাই-বাছাইয়ের কারণে ওই উপত্যকাটি সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেল।

প্রত্যেক সংবাদকর্মীর উচিত সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। সংবাদ পরিবেশনে সীমা লঙ্ঘন যাতে না হয় সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ দায়িত্বহীনতার পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেশ, জাতি ও সাধারণ মানুষ। আল কোরআনে বলা হচ্ছে, ‘কিন্তু সীমা লঙ্ঘন কর না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ সংবাদ পরিবেশনে সততার ব্যত্যয় মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। ছড়িয়ে পড়তে পারে অশান্তির দাবানল। সংবাদ পরিবেশনের আগে যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রত্যেক সংবাদকর্মীর নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

সর্বশেষ খবর