শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমার প্রিয় হকভাই

ইমদাদুল হক মিলন

আমার প্রিয় হকভাই

কী যে ভালো তিনি আমাকে বাসতেন! দেখা হলেই আমি তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। দু’হাতে তিনি আমাকে বুকে টেনে নিতেন। তিনি সৈয়দ শামসুল হক। আমাদের সব্যসাচী লেখক। আমার প্রিয় হকভাই।

বড় বেদনাময় সেই দিনটির কথা মনে পড়ে। আমি ছিলাম সুইডেনে। প্রথমে গিয়েছিলাম নরওয়েতে। সেখানকার কবি লেখকদের সঙ্গে মনোরম এক আড্ডা ছিল সন্ধ্যাবেলায়। এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে রিসিভ করেছিল পেন ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ‘জন’। মানুষটি দেখতে সুন্দর, সুপুরুষ। স্ক্যানডেনিভিয়ানদের গায়ের রং যেমন হয় তেমন গায়ের রং। চেহারাও খুব সুন্দর। ভালো ইংরেজি বলে। ভঙ্গিটা আন্তরিক। নরওয়েতে যাওয়ার আগে দুয়েকবার ফোনে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। পেন ইন্টারন্যাশনালের আমন্ত্রণেই নরওয়ে আর সুইডেনে গিয়েছিলাম। আমার যাত্রাসঙ্গী ছিল তখনকার কালের কণ্ঠ’র উপদেষ্টা সম্পাদক অমিত হাবিব। ঢাকা থেকে প্রথমে গেলাম ইস্তাম্বুলে। এয়ারপোর্টের হোটেলে থাকলাম এক রাত। পরদিন অমিত চলে গেল সুইডেনে, আমি নরওয়েতে। সুইডেনে কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধি সাব্বির। অমিত সাব্বিরের ওখানে উঠবে। সাত দিন পর সুইডেন থেকে সে এবং আমি সরাসরি চলে যাব নিউইয়র্কে। নিউইয়র্কে অমিত থাকবে তার বন্ধুর বাড়িতে। আমি থাকব আমার বড়বোনের বাড়ি লং আইল্যান্ডে। সেখানে সপ্তাহখানেক থাকার পর চলে যাব লসঅ্যাঞ্জেলেসে আমার ছোটবোনের বাড়িতে। সব মিলিয়ে তিন সপ্তাহের ভ্রমণ।

এই ভ্রমণের মধ্যেই এলো সেই দুঃসংবাদ। হকভাই চলে গেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মঙ্গলবার। ঢাকার ইউনাইটেড হসপিটালে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। একদিন হাসপাতাল থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। ‘আমাকে এসে দেখে যা, মিলন।’ আমি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, ‘আপনার অসুস্থ মুখ আমি সহ্য করতে পারব না।’

আমি যাইনি।

নরওয়ে থেকে গিয়েছিলাম সুইডেনের গোটেনবার্গে। গোটেনবার্গে পৃথিবীর বিখ্যাত একটি বইমেলা হয়। সেই মেলা উপলক্ষে সুইডিশ ভাষায় আমার একটি রূপকথার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক ছেলেটি মালমো শহরের। সেখানে তার বুকশপ আছে। নাম ‘ক্রিস্টিয়ান কার্লসন’। দেখতে গ্রিক দেবতাদের মতো। ক্রিস্টিয়ানের মতো এত সুন্দর সুপুরুষ সেদিনের আগে আমি আর দেখিনি। খুব নম্র বিনয়ী ভঙ্গিতে কথা বলে। কথায় যেন মধু ঝরে। গোটেনবার্গ বুক ফেয়ার উপলক্ষে ঢাকা থেকে দুজন প্রকাশকও গিয়েছিলেন সেখানে। ‘অনন্যা’র মনিরুল হক আর ‘সময় প্রকাশনী’র ফরিদ আহমেদ। আমাদের সেবারের ভ্রমণের পুরো আয়োজন করেছিলেন সুইডেন প্রবাসী বাঙালি লেখক ও তরুণ বুদ্ধিজীবী আনিসুর রহমান। আনিস এক তুখোড় যুবক। ‘জন’ ও ‘ক্রিস্টিয়ান কার্লসন’ তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আনিসের উদ্যোগেই সুইডিশ ভাষায় আমার বইয়ের অনুবাদ ও প্রকাশনা।

আমার সুইডেন ভ্রমণের পুরো পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন আনিস। এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল মালমো শহরে আমার প্রকাশকের সঙ্গে দুটো দিন কাটানো। তার প্রকাশনা সংস্থার অফিসে আমাকে ঘিরে ওই শহরের লেখকদের একটি সমাবেশও করবে ক্রিস্টিয়ান। ভাবলাম একা না গিয়ে মনির আর ফরিদকেও আমার সঙ্গে মালমোতে নিয়ে যাব। ট্রেনে করে যাচ্ছি। ফরিদের মোবাইলে ঢাকা থেকে ফোন এলো, হকভাই চলে গেছেন। আমাদের যাত্রার আনন্দ বিষণ্নতায় ভরে গেল। হকভাইকে ঘিরে কতদিনকার কত স্মৃতি যে মনের আয়নায় ভেসে উঠল!

ধু-ধু মনে পড়ে হকভাইকে প্রথম দেখি ১৯৬৭ সালে পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ‘মায়া’ সিনেমা হলে। যে হলটির নাম পরে হয়েছে ‘স্টার’। হকভাই তখন প্রচুর সিনেমার গল্প লেখেন, চিত্রনাট্য করেন। ওরকম একটা সিনেমার প্রিমিয়ার শো হচ্ছিল দুপুরবেলা। আব্বা চাকরি করতেন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে। তিনি দুটো পাস পেয়েছিলেন। এসব ব্যাপারে আমার অনেক আগ্রহ বলে আমার খালাতো ভাই নুজুর সঙ্গে তিনি আমাকে ওই শোটি দেখতে পাঠিয়েছিলেন। সেই হলে নায়ক-নায়িকাদের ভিড়ে একজন মানুষকে লক্ষ্য করেছিলাম। মাথার সামনের দিকে কিছুটা টাক পড়েছে। বাকি মাথাভর্তি লম্বা কালো চুল। তিনি খুব সুন্দর ভাষায় এবং কণ্ঠে, হাসিমুখে বেশ একটা গল্পে আনন্দে মেতে আছেন। পরে জেনেছি তিনি সৈয়দ শামসুল হক। আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। রূপকথা আর নানা রকমের ছোটদের গল্প উপন্যাস পড়ি। সৈয়দ শামসুল হককে বোঝার বয়স হয়নি।

এই মহান লেখককে বুঝতে শিখলাম স্বাধীনতার পর। তিয়াত্তর চুয়াত্তর সালের দিকে। তাঁর নানা রকমের গল্প উপন্যাস হাতের কাছে পেলেই পড়ি। ‘খেলারাম খেলে যা’ পড়ে ফেললাম। ‘আনন্দের মৃত্যু’ নামের গল্পের বইটি পড়লাম। সেই বইয়ের ‘কেরায়া’ গল্পটির কথা আর কিছুতেই ভুলতে পারি না। ‘শীত বিকেল’ বইটির গল্পগুলোর কথা ভুলতে পারি না। ‘রক্ত গোলাপ’, ‘জনক ও কালো কফি’ এসব গল্প মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। আমি তখনো কবিতার পাঠক হয়ে উঠিনি। হকভাইয়ের আরেকটি বই পড়লাম ‘এক মহিলার ছবি’। তরুণ লেখক বন্ধুদের কাছে হকভাইকে নিয়ে নানা রকমের গল্প শুনি। তাঁর লন্ডনে বসবাস, বিবিসির সঙ্গে জড়িত থাকা, অসামান্য কণ্ঠে বেতারে কথা বলা, জীবনাচরণ আর লেখার স্মার্টনেস তো আছেই। শুনে শুনে আমার কল্পনায় সেই ’৬৭ সালে দেখা মানুষটি আর রইলেন না। অন্য এক কল্পনার নায়ক হয়ে উঠলেন তিনি।

তারপর তাঁকে দেখলাম ১৯৭৮ সালে। ‘দৈনিক বাংলা’ ভবনের পত্রিকা ‘বিচিত্রা’ তখন সাপ্তাহিক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়। ‘ইত্তেফাক ভবন’ থেকে ওরকম একটি সাপ্তাহিকের উদ্যোগ নেওয়া হলো। নাম ‘রোববার’। আর গাজী সাহাবুদ্দিন আহমেদ, আমাদের প্রিয় মনুভাই নতুন করে উদ্যোগ নিলেন ‘সচিত্র সন্ধানী’ প্রকাশের। পত্রিকার দায়িত্বে কবি বেলাল চৌধুরী। অন্যদিকে ‘রোববার’র দায়িত্বে কবি রফিক আজাদ। আমি জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করেছি ‘রোববারে’। এখন যেখানে ‘গাজী ভবন’, ‘জোনাকী সিনেমা’ হলের পশ্চিম পাশে, তখন বাড়িটি ছিল দোতলা পুরনো বিল্ডিং। পিছন দিককার উঠোন পেরিয়ে আরেকটা একতলা দালান। সেখানে ‘সচিত্র সন্ধানী’র অফিস। একদিন গেছি বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তখনই জিন্স টি-শার্ট পরা, পায়ে চপ্পল, হাতে বালা, মাথাভর্তি টাক, অসামান্য একজন স্মার্ট মানুষ এসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়ালাম আমি। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার স্বপ্নের নায়ক সৈয়দ শামসুল হক।

তারপর আমি চলে গিয়েছিলাম জার্মানিতে। হকভাইও বোধহয় তখনো পর্যন্ত লন্ডনেই। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে কাটিয়ে ফিরে এলাম। বিরাশি তিরাশি সালের দিক থেকে ধীরে ধীরে হকভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। দিনে দিনে এমন সম্পর্ক হলো, সত্যিকার অর্থেই আমি হয়ে উঠলাম সৈয়দ শামসুল হকের অনুজ। তিনি আমাকে ‘তুই’ করে বলতে লাগলেন।

আমি তখন গেন্ডারিয়াতে থাকি। ভোর ৬টা থেকে লিখতে বসি। দুপুর পর্যন্ত একটানা লিখি। লেখালেখি করেই জীবন ধারণ করি। এক দুপুরে আমার সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের ডোরবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে মনে হলো আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। হকভাই দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জিন্সের প্যান্ট, ফুলহাতা শার্টটিও জিন্সের ডাবল পকেটওয়ালা। হাত ধরে আমি তাঁকে ভিতরে নিয়ে এলাম। আদেশের গলায় তিনি বললেন, ‘বউমাকে বল আমাকে পোলাও রান্না করে খাওয়াতে।’ পোলাও রান্না হলো। তিনি খুব আনন্দ নিয়ে খেলেন। তারপর বহুবার বহু জায়গায় আমাকে দেখলেই তিনি বলতেন, ‘আহ্, খুব ভালো পোলাও খাইয়েছিল তোর বউ। আরেকদিন ওর হাতের পোলাও রান্না খেতে যাব।’ সেই যাওয়াটা আর হয়নি হকভাইয়ের।

যশোর বা খুলনায় একটি কবি সম্মেলন হবে। সম্ভবত তিরাশি সাল। ঢাকা থেকে বড় বড় কবিরা যাচ্ছেন। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, রফিক আজাদ ও বেলাল চৌধুরী। তরুণ কবিদের মধ্যেও বোধহয় কেউ কেউ ছিলেন। তাদের কথা আমার মনে নেই। অকবিদের মধ্যে যাচ্ছি শুধু আমি। আমি তো তখন সারাক্ষণ রফিক আজাদের সঙ্গে। তিনি আমাকে ‘ব্যাটা’ বলে ডাকেন। রফিক ভাই আর বেলাল ভাইও আমাকে ‘তুই’ সম্বোধন করতেন। সেই কবি সম্মেলনে রফিক ভাই-ই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আরিচা ঘাট দিয়ে ফেরি পার হতে হবে। ফেরির আশায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গাড়ি। সবাই গাড়ি থেকে নেমেছেন। এদিক ওদিক হাঁটছেন। পথপাশের চায়ের দোকান থেকে চা খাচ্ছেন, হাতে সিগ্রেট। আমি লক্ষ্য করছিলাম আমার নায়ক হকভাইকে। দেখি তিনি উদাস ভঙ্গিতে মাছচালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাঁর পিছু নিলাম। নদীতীরের মাছচালায় দুটো একই সাইজের বিশাল পাঙাশ নিয়ে বসে আছে একজন জেলে। মাছ দুটো দেখে উৎসাহিত হলেন হকভাই। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন জেলের কাছে। দুটো মাছের একটি দেখিয়ে পিউর গদ্যে বললেন, ‘এটির দাম কত?’

জেলে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আশি টাকা।’

হকভাই অন্য মাছটি দেখিয়ে বললেন, ‘আর ওটির?’

জেলে বলল, ‘সত্তর টাকা।’

একই মাপের দুটো মাছের দুরকম দাম? হকভাই জেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সত্তর টাকা দামের মাছটি দেখিয়ে বললেন, ‘তা এটির অসুবিধে কী?’

হকভাইয়ের বিবিসিখ্যাত ভয়েস আর ভাষা শুনে জেলে খুবই ভড়কালো। সে কথা বলতে পারছে না, তোতলাতে লাগল। হকভাই আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি মুচকি হাসলেন। আর আমি তখন এক হাতে মুখ চেপে হাসি সামলাচ্ছি।

সেই প্রথম টের পেলাম, হকভাইয়ের ভিতর অসামান্য এক রসবোধ আছে। বড় লেখকদের মধ্যে ব্যাপারটা থাকতে হয়। হকভাই ছিলেন তীক্ষè মেধার মানুষ। আর রসবোধের কথা তো বললামই। একবার কলকাতায় গেছেন এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে আড্ডা আর পানাহার চলছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার অফিসে। কলকাতার বাঘা বাঘা লেখকরা আছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। ঠোঁটকাটা হিসেবে সন্দীপনের খুবই নামডাক। অন্য কবি লেখকদের সব সময়ই তিনি এক ধরনের অবজ্ঞার চোখে দেখেন। মূর্খ মনে করেন অনেককেই। সেই বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইস পেয়েছেন আমেরিকান লেখক ‘সল বেলো’। আড্ডার এক ফাঁকে হকভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সন্দীপন খুবই তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন, ‘এই যে হক সাহেব, এ বছর সাহিত্যে যিনি নোবেল প্রাইস পেলেন, ‘সল বেলো’, আপনি কি তাঁর নাম শুনেছেন?’

হকভাই মুখ ঘুরিয়ে সন্দীপনের দিকে তাকালেন। তাঁর সেই বিখ্যাত কণ্ঠে বললেন, ‘শুনুন সন্দীপন বাবু, আপনি যখন হাফপ্যান্ট পরেন, তখন আমি সল বেলোর ‘হ্যান্ডারসান দ্য রেইনকিং’ উপন্যাসটি অনুবাদ করেছি। বাংলা নাম ‘শ্রাবণরাজা’। সন্দীপন বোধহয় তাঁর জীবদ্দশায় এতবড় চপেটাঘাত আর খাননি।

এক বিকেলে বেইলি রোডের সাগর পাবলিশার্সে গিয়েছি। এম আর আখতার মুকুল বসে আছেন তাঁর ছোট্ট টেবিলটিতে। সামনের চেয়ারটিতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন শওকত ওসমান। আমি ঘুরে ঘুরে বই দেখছি। এ সময় এলেন হকভাই। হকভাইকে দেখে তাকিয়েছি। দেখি তিনি অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে শওকত ভাইকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছেন। সেই বিকেলে হকভাইয়ের কাছ থেকে শিখলাম, একজন বড় লেখক কীভাবে আরেকজন অগ্রজ বড় লেখককে সম্মান দেখান। তারপর থেকে যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই হকভাইকে আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছি। পায়ে হাতটা দিলেই তিনি আমাকে টেনে তুলতেন, বুকে জড়িয়ে ধরতেন।

চ্যানেল আইতে একদিন দেখা। সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। হকভাই জানতেন না। ফরিদুর রেজা সাগর অথবা আমীরুল ইসলাম কে যেন কথাটা হকভাইকে বলল। সঙ্গে সঙ্গে হকভাই পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করলেন। আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘মিষ্টি খেয়ে নিস।’ অর্জুন দুহাতে তীর চালাতে পারতেন বলে তাকে বলা হতো ‘সব্যসাচী’। হকভাই আমাদের সব্যসাচী লেখক। আমার অনেক সময় বিশ্বাস হতো না যে, সৈয়দ শামসুল হক নামে একজনই লেখেন। মনে হতো সৈয়দ শামসুল হক আসলে দশ বারোজন। একজন লিখছেন, ‘খেলারাম খেলে যা’, বা ‘এক মহিলার ছবি’, বা ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, বা ‘বালিকার চন্দ্রযান’, বা ‘তুমি সেই তরবারি’ এইসব লেখা।

আরেকজন লিখছেন, ‘রক্ত গোলাপ’, ‘কেরায়া’, ‘শীত বিকেল’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘জনক ও কালো কফি’। আরেকজন লিখছেন, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি,’ ‘অন্তর্গত’ অথবা ‘নীল দংশন’। আরেকজন লিখছেন, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, কিংবা ‘নুরলদিনের সারাজীবন’। আরেকজন লিখছেন ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’। আরেকজন লিখছেন, ‘সীমান্তের সিংহাসন’, অথবা ‘কাতল মাছের ঘাই’। আরেকজন লিখছেন, ‘হৃত কলমের টানে’। আরেকজন অনুবাদ করছেন, ‘সেক্সপিয়র’। একজন লেখকের পক্ষে কী করে সম্ভব এতরকম লেখা? আর তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘তিন পয়সার জোসনা’, ‘প্রণীত জীবন’, ‘হে বৃদ্ধ সময়’! কী করে সম্ভব?

আমার প্রতি হকভাইয়ের ভালোবাসার কথা বলেছি। হুমায়ূন আহমেদকেও খুব ভালোবাসতেন হকভাই। আমাদের তিনজনের একটি ছবি আছে। হকভাই মাঝখানে বসে আমাদের দুজনার কাঁধে দুহাত রেখেছেন আর আমরা দুজন জড়িয়ে ধরে আছি তাঁকে। এই লেখা লিখতে বসে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে, চোখ ভেসে যাচ্ছে। হকভাই চলে গেছেন, হুমায়ূন ভাই চলে গেছেন। প্রতি মুহূর্তে তাঁদের কথা আমার মনে হয়। ‘পরানের গহিন ভিতর’ কাব্যগ্রন্থটি লিখে বাংলা সাহিত্য কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন হকভাই। আমার শুধু মনে হয় হকভাই চলে যাননি। তিনি রয়ে গেছেন বাঙালি পাঠকের পরানের গহিন ভিতর। আমার বুক শেলফে আর হৃদয়ে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর