রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আজ মহানায়কের জন্মদিন

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পু

আজ মহানায়কের জন্মদিন

বিংশ শতাব্দী সবে শুরু হয়েছে। গোটা উপমহাদেশ তখনো উপনিবেশবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। জনগণ বিক্ষুব্ধ শোষণের বিরুদ্ধে। জেল-জুলুম, হুলিয়া, নির্যাতন, জ্বালাতন ছিল যে সময়ের নিত্যসঙ্গী; অন্নহীন, বস্ত্রহীন আর স্বাস্থ্যহীনতা যাদের মানুষ পরিচয় ছাপিয়েও বড় হয়ে উঠেছিল, ঠিক এমনই এক প্রতিকূল পরিবেশে গোপালগঞ্জের বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় একটি শিশুর জন্ম হয়। সংগ্রাম ও স্বাধীনতা তাঁর এতটাই প্রিয় ছিল যে, এই দুয়ের পেছনেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ২৫টি বছর। তিনি নির্ভীক, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অনুপ্রেরণা, নিঃশঙ্কচিত্তে দেদীপ্যমান এক কিংবদন্তি। ‘রাজনীতির মাঠ থেকে জেল’, ‘জেল থেকে রাজনীতির মাঠ’- এই ছিল তাঁর জীবন। তিনি বলতেন, ‘জেল আমার আর একটা বাড়ি’। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন ও তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণের দায়ে জেল এবং পরে বের হয়ে যেদিন জানলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ছাত্রত্ব নেই, সেদিন থেকেই পুরোপুরিভাবে শুরু হয়েছিল তাঁর ঝড়ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক জীবন। এরপর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২; ১৯৫৪, ১৯৬৬ কিংবা ১৯৬৯-৭০ ও ১৯৭১-প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামেই তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য, প্রশ্নাতীত। ৫৫ বছরের জীবনে সংখ্যাতীত কারণে অসংখ্যবার (মোট ১৮) কারাভ্যন্তরে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। দিন-বছর হিসাব করলে যা ৪ হাজার ৬৮২ দিন এবং ১২ বছরেরও বেশি সময়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই জেলবরণের সময়কাল তাঁর জীবনের সৃষ্টিশীল সময়গুলোর এক-চতুর্থাংশ। তিনি বাঙালির এক হাজার বছরের ধন্য পুরুষ, কোটি কোটি মানুষের মনের জীবন্ত স্মৃতির মিনার।

তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। ভালোবেসে বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা শেখ সায়েরা খাতুন যাকে ‘খোকা’ নামে ডাকতেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের মুখে ‘মিয়া ভাই’, আর আমরা বাঙালি জাতির স্থপতি হিসেবে সম্মান জানিয়ে ডাকি ‘জাতির পিতা’; যদিও আদতে তিনি বাঙালির বন্ধু, বাংলার বন্ধু সর্বোপরি আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু’। সত্যি বলতে এ অল্প কথায়, স্বল্প পরিসরে তাঁর গুণ-বিশেষ কিংবা বিচিত্র কর্মময় সংগ্রামী জীবনকথা-সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করা দুরূহ ব্যাপার। শুধু তাই নয়, বাঙালির জন্য তাঁর কর্মব্যাপ্তি, ত্যাগ, সংগ্রাম, নিষ্ঠা; ব্যক্তিজীবনের উত্থান-পতন, স্বপ্ন, দর্শন, আদর্শ ও প্রাপ্তি এতটাই ছড়িয়ে যে, তা দিয়ে একটি মহাভারত লিখলেও কম হয়ে যাবে। শতবর্ষ পেরোনো সেই শেখ মুজিব এখন আরও শত কোটি গুণ শক্তিশালী, শ্রদ্ধেয়।

আজ ১৭ মার্চ; ইতিহাসের এই অগ্নিপুরুষের ১০৫তম জন্মদিন। ফুল-মাল্য আর শ্রদ্ধায় উদযাপনের অনন্য দিন আজ। বাঙালি জাতির জাগৃতির ইতিহাসে বরাবরই ভাস্বর ছিল এই ১৭ মার্চ। যদিও তাতে ঢের আপত্তি ছিল জাতির জনকের। যেমন স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিবসের স্নিগ্ধ সকালে শত শত অনুরাগী যখন ধানমন্ডির ৩২-এ সমবেত, তখন স্মিতমুখে বেরিয়ে এসে মহানায়ক বললেন, ‘আমার আবার জন্মোৎসব কীসের? আয় তোরা কাছে আয়।’ বঙ্গবন্ধুর এ ডাক নেহাত আমন্ত্রণ নয়, যেন একটি সাগরের আহ্বান ছিল। জাতির পিতার ভাষ্যই ছিল- ‘দুঃখী বাংলার অনাহারি মানুষেরা জন্মদিনের বার্তা বোঝে না। আমিও তাই বুঝতে চাই না। কারণ, আমি যে তাদেরই একজন।’ সত্যিই তো! জীবন যার রাজনীতির ঝড়ো খেরো খাতায় ভরা, ব্যক্তিগত উৎসব পালনের সময় কই তাঁর? জাতির পিতার কাছেও কোনো উৎসব কখনো গুরুত্ব পায়নি। সেখানে নিজের জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠান তো নয়-ই। জন্মদিন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনীহার কথা ১৯৭৩-এ জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার এক সাক্ষাৎকার থেকেও জানা যায়। যেখানে তিনি বলেন, ‘জন্মদিন উদযাপন আব্বা কোনো দিনও পছন্দ করেন না। আব্বা বলেন, যে দেশের মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই সংগ্রাম করতে হয় মৃত্যুর সঙ্গে; প্রতিদিনই তো তাদের জন্মদিন। বিশেষ একদিন অথবা ক্ষণেকের বৈশিষ্ট্য মাপার মতো সময় বা অবস্থায় তাদের কোথায়।’ কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার বক্তব্য, ‘আব্বা মনে-প্রাণে বাঙালি। বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মেশানো প্রতিটি জিনিসকে আব্বা যেমন পছন্দ করেন তেমনি বিদেশি কোনো আচার অনুষ্ঠানকে আব্বা এড়িয়ে চলেন। আব্বা বলেন, জন্মদিন শব্দটার সঙ্গে কেমন যেন বিদেশি ছোঁয়া লাগানো। আমাদের বাসাতে তাই কোনো জন্মদিনের উৎসব হয় না। শুধু আব্বার জন্মদিনে প্রত্যেক প্রভাতে বাগানের তাজা একটা ফুল তাঁকে আমি উপহার দিই।’ (১৭ই মার্চ, ১৯৭৩; দৈনিক বাংলা)।

নিজের জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা নিয়েও ক্ষুব্ধ ছিলেন জাতির পিতা। ১৭ মার্চ ১৯৭২-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি মনে করি না মার্চ ১৭ কে সরকারি ছুটি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন আছে! তবে এটিকে কঠোর শ্রম ও ত্যাগের দিন হিসেবে পালন করা যেতে পারে। জীবনের শেষ জন্মদিনে (১৯৭৫-এর ১৭ মার্চ) ধানমন্ডিতে শুভেচ্ছা জানাতে আসা হাজার হাজার দর্শকের পুষ্পমাল্যে ভূষিত হওয়ার পর অফিস করেন জাতির পিতা। এ সময় উপস্থিত অন্য সবাইকেও অফিসে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাইব, অল্পক্ষণের জন্য হইলেও অফিসের কাজ করিব।’ উপস্থিত বাকি সবাইকেও নিজ নিজ অফিসে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু বাঙালির উপলব্ধি যে জাতির জন্য মানুষটি নিজ জীবনে সবটা বিলিয়ে দিয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বারংবার; যে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমি জনগণের এবং জনগণ আমার। আমি বাংলার মাটিকে ভালোবাসি, আমায় ভালোবাসে বাংলার মাটি। বাংলা আমার, আমি বাংলার’। সেই মানুষটির জন্মদিন ঘিরে বাঙালির বাড়তি উৎসাহ থাকবে না, তা হতে পারে না। দেশমাতৃকার ও এর জনগণ নিয়ে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) আত্মোপলব্ধিই হয়তো কোটি কোটি বাঙালিকে আরও নিবিড়ভাবে এই মহাপ্রাণকে অনুভব করিয়েছে। বারবার নিয়ে গেছে তাঁর জন্মদিন ১৭ মার্চে।

দুই. বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে নেতৃত্বে মহানায়ক, ঝোলে ঝালে অম্বলে ১০০তে ১০০-এমন তারকা রাজনীতিকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারপরও যদি প্রশ্ন ওঠে, আসলে কত বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু? বাঙালির জীবনে কত বড় প্রভাবক তিনি? যদিও এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যাতীত, উত্তরও অনেক। তারপরও বলা যায়, শেখ মুজিব যতটা না রাজনীতির মারপ্যাঁচে দেশ গড়েছেন, তার চেয়ে বেশি গড়েছেন লাখ লাখ মানুষের আবেগ, কান্না আর রক্ত দিয়ে। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো রুপার চামচে নয়; বাংলাদেশের আর লাখ-কোটি জনের মতোই তিনি এ মাটি থেকে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন কাদামাটির সঙ্গে খেলতে খেলতে। জাতির পিতা নিজেও বলতেন, জীবনে যা কিছু পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি কিছু চান না; তিনি শুধু মাটির মানুষদের সঙ্গে থাকতে চান। অস্বীকার করছি না, হয়তো জ্ঞানে-গুণে-জনপ্রিয়তায় বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড় অনেক বাঙালি এ বঙ্গে জন্মেছেন; কিন্তু অসহায়-নিপীড়িত মানুষের জন্য জীবনবাজি রাখা; দিনের পর মাস, মাসের পর বছর ধরে জেলবরণ-একমাত্র বঙ্গবন্ধুই করেছেন। বারবার রাজনীতির মাঠে একমাত্র। এখানেই তিনি অন্য সবার থেকে আলাদা, এখানেই তাঁর অসাধারণত্ব। বঙ্গবন্ধু সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী একবার বলেছিলেন, দুটি মাত্র ব্যক্তিত্ব সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন। একজন রবীন্দ্রনাথ ও অপরজন বঙ্গবন্ধু। আমরা সবকিছুই হারিয়েছি কিন্তু একটিমাত্র সম্পদ রয়েছে। তা হলো- বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এক দল প্রতিনিধি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, ‘‘আমরা হয় ‘স্বাধীনতা’ নতুবা ‘বঙ্গবন্ধু’-দুটোর একটা পাব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু দুটোকেই পেয়েছি। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন- শুধু তোমরাই নও। আমরাও।’’ এই ছিল দেশ ও বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে আমাদের জাতির পিতার অবস্থান।

১৯৪১ সালে পয়লা বৈশাখের এক অনুষ্ঠানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এ দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত কুটিরে; অপেক্ষা করে থাকব সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে। মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এ পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’ বললে অত্যুক্তি হবে না, রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের রাজ্যে এমন দুর্লভ চরিত্রের পরিত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি কবির কথা ‘কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তার অধিক/...সবিনয়ে সগৌরবে ধরা-মাঝে দুঃখ মহত্তম’-এর মতোই পাওয়ার চেয়ে দেওয়ায় বেশি মেতে থাকতেন। বিনিময়ে দুঃখকেও মহত্তম হিসেবে গ্রহণ করতেন সবসময়।

তিন. আমার সমগ্র জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল মধুর স্মৃতি এবং গৌরবময় প্রাপ্তি হলো বঙ্গবন্ধুর স্নেহ সান্নিধ্য ও তাঁর সংস্পর্শে আসা। বঙ্গবন্ধুর মুখনিঃসৃত অমৃত বাণী আজও আমাকে তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব ধারণ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়; তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের কাজে আসতে উৎসাহ জোগায়। একজন বাঙালির জীবনে এর থেকে পরমানন্দ আর কিছু হতে পারে কি না আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেশ কয়েক দফা সাক্ষাতের মধ্যে ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল হওয়া প্রথম আলাপ ছিল অনেকটাই আচমকা। এর মাসখানেক আগেই শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরের গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছয় দফা পেশ করেন। এতে টনক নড়ে ওঠে তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান এবং তার সরকারের। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগও ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের ছয় দফা এবং ছাত্রলীগের ১১ দফা ঘোষণার পর বাংলার ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারণ মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ‘মনের কথা চাপা রাখি নাই, জেলে যেতে হবে জেনেও ছয় দফা জনগণের কাছে পেশ করেছিলাম।’ জাতির জনকের চিন্তা ছিল- এ ছয় দফাই বাংলার আকাশে-বাতাসে ‘স্বাধিকার’ শব্দটিকে ছড়িয়ে দেবে; সর্বজনের মুখে প্রবাদের মতো উচ্চারিত হবে ‘স্বাধীনতা ছাড়া রক্ষা নাই’ কথাটি। হয়েছেও তা-ই।

মূলত ছয় দফা ও স্বাধীনতা-পূর্ব আন্দোলনে বাড়তি মাত্রা যোগ করতেই সেদিন পাবনা সফর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই সুবাদেই পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাসায় তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। মুগ্ধ হলাম, পরিচিত হওয়ার পর পরই ‘তুই’ সম্বোধনের মাধ্যমে তিনি আমার ব্যক্তিগত আদ্যোপান্ত জানতে চাইলেন। এরপর বললেন টাউন হলের জনসভায় যোগ দিতে। জানালেন রাজনীতি জানাবোঝার আহ্বানও। এত বড় মাপের মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের কথা আমার কাছে শুধু নির্দেশ নয়-এরও অনেক ঊর্ধ্বে ছিল।

আজ ভাবি, জনগণের জন্য উৎসর্গিত যে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত জীবনে কোনো কিছুরই খোঁজ রাখতেন না। আজ কী খাওয়া হবে, কাল কী পরা হবে; এমনকি কোন জিনিসটা তাঁর একান্ত প্রয়োজন, সেগুলোও যেখানে স্মরণ করিয়ে দিতে হতো কর্মসঙ্গিনী বেগম মুজিবকে। সেখানে আমার মতো এক কিশোর সম্পর্কে জানা, তাকে রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করা ছিল তাঁর সুমহান স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্যেরই অংশবিশেষ মাত্র।

সীমাহীন গুণের অধিকারী এই বিশ্বনেতার কয়েক দফা সান্নিধ্য পেয়ে তাঁর সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়ন করা আমার জন্য কঠিন। তারপরও যতটুকু পেরেছি, সে হিসেবে আমি অতি সৌভাগ্যবানদের একজন। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, Bangabandhu was not only  ' a friend of Bengal '  but his role was more than that and incomparable. Noting that Bangabandhu was a fantastic person, He was snatched away from the Bangalees but nobody can snatch his clear thoughts and visions, which may be very helpful for us today’. অমর্ত্য সেন বলতে চাইছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে শুধু ‘বঙ্গবন্ধু’ বললে ভুল হবে; কারণ তাঁর কর্মকান্ড এমন ছিল যা কারও সঙ্গে তুলনা করা যায় না। শুধু তাই নয়, অবিসংবাদিত ও মানবদরদি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বলেই ১৯৭১-এ সাত কোটি বাঙালি লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আবার তাঁর দেখানো আদর্শ ও গণতন্ত্রের ওপর ভর করেই ২০২৪-এর বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আজ এ-ও বিশ্বাস করি, একটা জাতির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী স্বতন্ত্রের যে ধরন ছিল, বর্তমান সময়ে তার বিস্তৃত ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশ কিংবা বাংলা ভাষাভাষীর জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই বিশ্ববন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নাম রাখাকালীন নানা আবদুল মজিদের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম যে নাম জগৎ জোড়া খ্যাত হবে’-এর সার্থকতা।

মূল কথায় ফিরি। ৭ এপ্রিল পাবনায় ছয় দফা নিয়ে সমাবেশ করার মাসখানেক পরই (৮ মে, ১৯৬৬) বঙ্গবন্ধুকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বুঝে গিয়েছিল ‘ছয় দফা’ আসলে ‘ছয় দফা’ নয়; এর উদ্দেশ্য আদতে স্বাধীনতা নামক ‘এক দফা’র আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। হয়তো এ কারণেই সেই ধাপে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জীবনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ১০২১ দিন কারাগারে আটকে রেখেছিল বর্বর পাকিস্তানিরা। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিচার শুরু করেন। যা একসময় হালে পানি না পেয়ে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর পরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে আরেক দফায় গ্রেফতার করে। এই দফায় মোট ২৮৮ দিন কারাভোগ করেন জাতির স্থপতি। অর্থাৎ চাইলেও দীর্ঘ এ সময়ে (১৯৬৬-৭১) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না। অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২; দীর্ঘ ছয় বছর পর শুভযোগ হলো ইতোমধ্যেই জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনীতিক হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর সবক পাওয়া আমিও ততদিনে রাজনীতিতে বেশ পোক্ত। কাঁধেও বড় দায়িত্ব। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। এদিন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে বৃহত্তর পাবনা জেলাকে বন্যামুক্ত করতে নিজ হাতে মাটি কেটে ১৫৭.৫৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে আমরা পাবনাবাসী জাতির পিতাকে ভালোবেসে এই বাঁধের নামকরণ করি ‘মুজিব বাঁধ’। বাঁধটি নির্মাণ যে শুধু ওই সময়ে পাবনাবাসীর জন্য আশীর্বাদ ছিল তা নয়, বর্তমানেও এটি পদ্মা-যমুনা নদীবেষ্টিত পাবনার রক্ষাকবচ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।

যাই হোক, বাঁধ নির্মাণ উপলক্ষে আয়োজিত জনসভার মঞ্চে উপবিষ্ট হলেন বঙ্গবন্ধু। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ায় স্বাগত বক্তব্য দিলাম আমি। বক্তব্য শেষ হলে জাতির পিতা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমু দিলেন এবং বক্তব্যকে ‘অসাধারণ’ আখ্যা দিয়ে প্রশংসা করলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখে এমন প্রশংসা শুনে এই ভেবে উৎসাহী হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্ততৃায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে আমার পরম পাওয়া। বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। জাতির পিতাকে বিদায় দিতে যাচ্ছি, এমন সময় আচমকা প্রস্তাব দিলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন- ‘হেলিকপ্টারে তাঁর সঙ্গে ঢাকায় যাব কি না?’ কে চাইবে ওই বয়সে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হেলিকপ্টার ভ্রমণের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে! আমিও করিনি। মহানায়কের সঙ্গে জীবনের প্রথমবার হেলিকপ্টার ভ্রমণ করলাম। বঙ্গবন্ধু অনেক কথা বললেন, উপদেশ দিলেন। হেলিকপ্টার নামল রাজধানীর পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক আগের ন্যায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে শুভকামনা জানিয়ে আশীর্বাদ করলেন।

বঙ্গবন্ধু চলে যাওয়ার দুই মাস আগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তাঁর সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল। পাবনা জেলা বাকশাল কমিটিতে পদ পাওয়ায় ওই সাক্ষাৎ হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। জাতির জনক সেদিন তাঁর স্বভাব ড্রেসকোড ‘হাফ-শাটর্’ ও ‘লুঙ্গি’ পরেছিলেন। বাসায় ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম এবং বাকশাল কমিটিতে স্থান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের নানা দিকনির্দেশনা দিলেন। চলে আসব, ঠিক এই মুহূর্তে বললেন- ‘কী রে, আমার সঙ্গে ছবি তুলবি না?।’ তাৎক্ষণিক ক্যামেরাম্যান এলেন এবং দেশনায়কের সঙ্গে আমাদের ছবি তুললেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নেওয়া সেই ছবি আজও আমার কাছে থাকা তাঁর শেষ স্মৃতিচিহ্ন।

চার. বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ও সাধ ছিল বাংলাদেশের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তাদের সুখী ও সন্তুষ্ট করা। বাঙালিকে তিনি শুধু জাতীয়তাবাদের অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করেননি, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে একটি জাতিতেও রূপান্তর করেছেন। দিয়েছেন মুক্তির পূর্ণ স্বাদ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেওয়া। পাশাপাশি ১৫ মাসের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা। ইচ্ছা করলেই তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারতেন, কিন্তু তা করলেন না; জনগণের রায় পেতে দিলেন সাধারণ নির্বাচন। এই হলেন আমাদের জনগণের নেতা।

প্রিয় জাতির পিতা, আপনি আজ নেই। কিন্তু শৈল শিখরের মতো আজও আপনি আপন মহত্ত্বে ভাস্বর। আপনি ব্যক্তি নন, আপনিই একটি জাতি। আপনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়েছিলেন, আজ ১৭ কোটির আদর্শ হয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। আমাদের শঙ্কা নেই, কারণ চেতনায়-আদর্শে আজও আপনি আমাদের পুরোভাগে আছেন।

১০৫তম শুভদিনে আপনার প্রতি রইল মস্তক অবনত শ্রদ্ধা, সম্মান! শুভ জন্মদিন আমাদের মহানায়ক।

                লেখক : রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর