সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

জাহাজ ও নাবিকদের নিরাপত্তা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

জাহাজ ও নাবিকদের নিরাপত্তা

জলদস্যুতা মানব ইতিহাসের এক অতি প্রাচীন অধ্যায়। মানবসভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ পায়ে হেঁটে, পশুর পিঠে চড়ে এবং কাঠের নৌযানে বাণিজ্য বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করত। তখন আজকের দিনের মতো এমন রাষ্ট্রীয় সীমানা ছিল না। তবে মূলত নিরাপত্তার স্বার্থেই মানুষ অঞ্চল ভেদে গোত্রভিত্তিক জীবনযাপন করত। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে জলপথে যাতায়াতের সময় নৌ-ডাকাতির ঘটনা তখনো ঘটত। তবে তা প্রকাশ ও প্রচারের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনের এক গবেষণা মতে, পৃথিবীর বুকে জলদস্যুতার ইতিহাস ৩ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। তবে এ-সংক্রান্ত নিশ্চিত তথ্য রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০ সালের অর্থাৎ প্রায় ৩ হাজার ৩৭৪ বছর আগের একটি কাদামাটির টেবিলে খোদাইকৃত তথ্যে। এ ফলকে তৎকালে ভূমধ্যসাগরে চলাচলকারী উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের নৌযানে জলদস্যুতার ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। বিশ্বজয়ী গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার দি গ্রেট (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ খ্রিস্ট-খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সাল) এবং ভয়ংকর ও অত্যাচারী এক জলদস্যু নিয়ে প্রচলিত একটি ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। বর্ণনা মতে, ওই জলদস্যুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ বণিকরা অনেক চেষ্টার পর সেই জলদস্যুকে কবজা করে এবং বিচারের জন্য মহাবীর আলেকজান্ডারের সামনে হাজির করে। তখন এমন অপরাধে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিধান ছিল। তথাপি আলেকজান্ডার তাকে এ অপরাধ স্বীকার করা এবং ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব দেন। জলদস্যু সেই প্রস্তাবে কোনো সাড়া দিল না বরং মহাবীর আলেকজান্ডারের চোখে চোখ রেখে বলে গেল, আপনি আর আমি তো একই কাজ করি। আমি এক নৌযান নিয়ে অন্য নৌযানের মালামাল লুট করি, আর আপনি বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে অন্য দেশ দখল করেন এবং আপনি ও আপনার সৈন্যরা মিলে সেই দেশের ধন-সম্পদ লুটতরাজ করেন।

মজার বিষয় হলো এমন কথা শুনে মহাবীর আলেকজান্ডার একটুও রাগ করলেন না। বরং তাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কিছু অর্থ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রস্তাব দিলেন। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে জলদস্যু যে উত্তর দিল, তার সারমর্ম- আগে আপনি যুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা আর দেশ দখলের নামে লুটতরাজ বন্ধ করুন। আবারও আলেকজান্ডার নিজেকে শান্ত রাখলেন এবং স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন- ‘তোমার জন্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যতটা সহজ, আমার জন্য তা ততটাই কঠিন’।

কোনো এক ১৭ মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে একদা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সঙ্গী এক প্রবীণ নেতার বক্তৃতা শুনছিলাম। ’৭০- এর নির্বাচনের প্রচারণা সময় বঙ্গবন্ধু একবার সিরাজগঞ্জ-পাবনা-নাটোরের চলনবিল এলাকায় নৌকাযোগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছিলেন। পথে তাকে বহনকারী নৌকায় একদল জলদস্যু উঠে পড়ে, তাদের হাতে ছিল বড় বড় রামদা। তারা বঙ্গবন্ধুকে খুঁজতে থাকেন। জলদস্যুদের কাছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গীদের প্রশ্ন ছিল, তারা কেন বঙ্গবন্ধুকে খুঁজছেন। প্রশ্ন শুনে জলদস্যুদের নেতা এগিয়ে এলেন, যার হাতে ছিল এত বড় ও ভারী একটি দা যা বহন করতে স্বাভাবিক দুজন মানুষের প্রয়োজন। জলদস্যু সরদার এরপর বললেন, তারা খবর পেয়েছেন যে, সামনে পশ্চিম পাকিস্তানের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীরা বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী নৌকার অপেক্ষায় রয়েছে এবং নৌকা দেখামাত্র তারা বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। তাই তারা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বেচ্ছায় এ নৌযানে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু শান্তভাবে তাদের সঙ্গে কথা বললেন। একসঙ্গে খাবার খেলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার আদায় করলেন। এ জলদস্যু দলের খবর পেয়ে পশ্চিমাদের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।

বঙ্গোপসাগরে এরপর বহু পানি গড়িয়েছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশের অহংকার লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে এখন বহু বাণিজ্যিক জাহাজ পৃথিবীর সব সাগর মহাসাগরের নীল জলরাশিতে ছুটে চলে। এ ছুটে চলার মাঝে হঠাৎই আবার ছন্দপতনও ঘটে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় কেবল বাংলাদেশি নয়, বিশ্বের ছোট-বড় বহু দেশের বাণিজ্যিক জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় জলদস্যুরা। অতীতে সোমালিয়াসহ আফ্রিকার যেসব এলাকায় জলদস্যুদের প্রভাব আছে, এমন সমুদ্র অঞ্চলে চলাচলের সময় আক্রমণের শিকার  হয়েছে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজ। এখনো এমন ঘটনা ঘটছে। ইদানীং ইয়েমেনের হুতিদেরও আক্রমণের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজ।

ভারত মহাসাগর ও এডেন উপসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের তৎপরতা এতই বেশি যে, আন্তর্জাতিকভাবে এটিকে রেড জোন বা বিপজ্জনক এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে, যা নাবিকরা এড়িয়ে চলে। মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাইয়ের পথে যাত্রা করা বাংলাদেশের পতাকাবাহী বেসরকারি বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি আবদুল্লাহও সেই বিপজ্জনক এলাকা বা রেড জোন এড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে গত ১২ মার্চ মঙ্গলবার আচমকা বেশকিছু ছোট ছোট নৌকায় সোমালীয় জলদস্যুরা এমভি আবদুল্লাহতে উঠে পড়ে। অস্ত্রের মুখে ক্যাপ্টেনসহ ২৩ জন ক্রুকে জিম্মি করে তারা জাহাজটিকে নিজেদের পছন্দের জলসীমায় নিয়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে মূলত চারটি কারণে জাহাজ ও জাহাজিদের জিম্মি করে জলদস্যুরা। এ চারটি কারণের মধ্যে রয়েছে- এক. জাহাজে বহনকৃত মূল্যবান মালামাল লুটপাট। দুই. জাহাজটি ব্যবহার করে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পরিবহন। তিন. সামরিক ও রাজনৈতিক দাবি আদায় ও রাজবন্দিদের মুক্তি। চার. জাহাজটি ব্যবহার করে অন্যান্য জাহাজে লুটপাট করা। পাঁচ. মুক্তিপণ বা অর্থ আদায়। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক জাহাজ অতীতেও এভাবে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিল। তবে মুক্তিপণ আদায় ছাড়া জলদস্যুদের অন্য কোনো দাবি ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের নজর হয়তো সর্বোচ্চ মুক্তিপণ আদায়ের দিকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সমুদ্রে জলদস্যুতা কমাতে দেশ ও আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় নানামুখী তৎপরতা দেখা যায়। দেশে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের নৌ-সেনারা জাহাজ নিয়ে নিয়মিত টহল দিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবেও এমন বেশকিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার অন্যতম ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক এ-সংক্রান্ত ধারা (আর্টিক্যাল ১০১ ও ১০২) অনুমোদন। বিশ্ববরেণ্য সমুদ্র চলাচল বিশেষজ্ঞরা একত্রিত হয়ে পৃথিবীর মোট পাঁচটি সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশের এমভি আবদুল্লাহ এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিহার করেই চলাচল করছিল। তথাপি পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল লোহিত সাগর, আফ্রিকা উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে তৎপর সোমালিয়ার জলদস্যুরা এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে। উল্লেখ্য, এ ঝুঁকিপূর্ণ নৌ-সীমায় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং ফ্রান্সের নৌ-সেনারা একক ও যৌথভাবে নিয়মিত টহল দিয়ে থাকেন। তথাপি বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষেই এমন জাহাজ জিম্মির ঘটনা শূন্যতে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

২০০৮ সালে সোমালিয়ার নিকটবর্তী এ সমুদ্র অঞ্চলে ১৪১টি জাহাজ জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। ২০০৯ সালের প্রথম ছয় মাসেই এ সংখ্যা ১৩৫ অতিক্রম করে। একই বছরে (২০০৯) একই অঞ্চলে মার্কিন পতাকাবাহী জাহাজ এমভি মায়ের্স্ক আলাবামা ও জাহাজে থাকা ২০ মার্কিন নাবিককে জিম্মি করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে গঠন করা হয়েছিল কম্বাইন্ড ট্রাস্ট ফোর্স-১৫১। এ ট্রাস্ট ফোর্সে আমেরিকা ছাড়াও ফ্রান্স, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া, ভারত ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ যোগ দিয়েছিল। এরপর বিগত ১৫ বছরে বহু স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও সংগঠন গড়ে উঠেছে। এর ফলে জলদস্যুতা কিছুটা কমলেও ঝুঁকি তেমনটা কমেনি। তারই প্রমাণ এমভি আবদুল্লাহর এ দুঃখজনক জিম্মি ঘটনা।

ভবিষ্যতে এমন দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা এখন সময়ের দাবি। পৃথিবীর অধিকাংশ জাহাজেই এখন কাঁটাতারের প্রতিবন্ধকতা, জলকামান, গরম পানি, জাহাজে বিভিন্ন অংশ পিচ্ছিল করার ফোম, বিকট শব্দ তৈরির অস্ত্র (যেমন সাউন্ড গ্রেনেড) রাখা হয়। স্থলভাগের প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানির মতো সামুদ্রিক জাহাজেও প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি প্রদানের জন্য বহু বৈধ কোম্পানি গড়ে উঠেছে। বিশ্বের বুকে জাহাজ মালিকদের বহু ক্লাব ও সংগঠন রয়েছে যারা কোনো সদস্যের জাহাজ বিপদে পড়া মাত্র তাদের সাহায্য করতে অর্থ, জনবল, লবিং এজেন্ট ও অন্য সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে সব জাহাজ মালিকের নিজস্ব জাহাজ ও নাবিকদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে এসব বিষয় নিয়ে আরও তৎপর হতে হবে। ইতোমধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ও হেলিকপ্টার এমভি আবদুল্লাহর কাছে পৌঁছেছে এবং জাহাজটিকে নজরে রাখছে, যা প্রশংসার দাবিদার।

আমাদের দেশপ্রিয় নৌবাহিনী ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর সঙ্গে সৌহার্দ বজায় রাখলে এমন সহায়তা ভবিষ্যতেও প্রত্যাশা করা যায়। সব শেষে গণমাধ্যমকর্মী ও কনটেন্ট নির্মাতাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, অনুগ্রহ করে মনগড়া বা কাল্পনিক তথ্য প্রচার ও আশঙ্কা সৃষ্টি করে জাহাজে জিম্মি ২৩ নাবিকের স্বজনদের মনে অযথা কোনো আতঙ্ক বা ট্রমা তৈরি করবেন না। অতীতে বাংলাদেশসহ বহু দেশে জাহাজিরা এমন জিম্মি হয়েছিলেন এবং তারা অক্ষত অবস্থায়ই স্বজনদের কাছে ফিরে এসেছেন। আমাদের সবার শুভকামনা ও সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপে, সর্বোপরি বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র ও সংস্থার সার্বিক সহায়তায় আমাদের প্রিয় নাবিকরা সুস্থ দেহে জাহাজ নিয়ে দেশে ফিরবেন এটাই প্রত্যাশা।

 

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর