সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

বরেণ্য শিল্পী সাদি মহম্মদ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

অধ্যাপক ডক্টর আবু সাইয়িদ

বরেণ্য শিল্পী সাদি মহম্মদ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

১. কেউ বলেছেন তিনি ‘মারা’ গেছেন, কেউবা বলেছেন ‘আত্মহত্যা’। আমার অনুমিতি তিনি আত্মমগ্ন ছিলেন- দহনে নিজেকে ছাড়িয়ে নিজেই ওপারে চলে গেছেন। তিনি মরেননি! দেহজ বিসর্জনের মাধ্যমে তিনি তিরোহিত হয়েছেন, আত্মার অমরত্ব নিয়ে জীবিত আজও। আত্মার অমরত্বে বিকীর্ণ তার শৈল্পিক পদচারণ। সমকালীনে তিনি যেমন ‘রবিবাগ’-এ উজ্জ্বল, ভবিষ্যতেও তেমনি। রবীন্দ্রসংগীত বিবর্তনের ধারায় তিনি বাতিঘর। ২. সংগীত জগতে আমার পদচারণ নেই; কিন্তু সংগীতের প্রতি আমার আকর্ষণ অহর্নিশ। ছোটবেলায় বাবার কণ্ঠে, চাচার গলায় গান শুনেছি। সেসব গানে জীবনের দাহ ও আকুতি ছিল। সেই আকুতিই আমাকে তাড়া করেছে। রাজনীতির মহান আদর্শগুলোর মোহনীয় আবর্তে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি কাছ থেকে। ছয় দফা ঘোষণা করার পর যমুনার ঘোলা জলের বহমান উজানে অথবা বড়ালের স্রোতধারার দিকে তাকিয়ে তিনি আপন মনে গিয়ে উঠতেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ এক শিল্পী সত্তার সঙ্গে রাজনৈতিক বাস্তবতার মেলবন্ধন। ৩. শিল্পী সত্তা সর্বদাই নিজেকে আড়াল করতে চায়- একাকী তার পথচলা। জীবন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অন্য ভুবনের অন্বেষায় এগিয়ে যায়। সাদি মহম্মদ আত্মমগ্ন ছিলেন, আত্মপ্রকাশে কুণ্ঠিত। সহস্র রবীন্দ্রসংগীত তার অবলীলায় সুরলহরির জাদুময় স্পর্শে উচ্চারিত। তার গায়কি ভঙ্গি, কণ্ঠ মাধুর্য ও প্রক্ষেপণ ছিল অনবদ্য। ৪. সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের সঙ্গে আমার একান্ত সহবাস ছিল না। যা ছিল তা সৌজন্য মধুরতায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট আমাকে এখনো দগ্ধ করে। জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ডের বেদনাবিধুর স্মৃতিরাজি নিয়ে তখন কোনো গান বা সংগীত দেশের কেউ তেমন একটি করেনি বলে মনে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা তখন ক্ষমতায়। আমি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক নান্দনিক চিত্রশৈল্পিক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী বললেন, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ড দিবসে একটি সংগীত গেলে ভালো হয়। বললাম, ভাবতে দিন। ৫. এই ভাবনা থেকে সম্ভাবনা। সম্ভাবনা থেকে সাধনা। সাধনা থেকে সৃষ্টি। আমি প্রকৃতির কাছে গেলাম। মেঘ ছিল। বৃষ্টি ছিল। চাঁদ ছিল না। লেখা হলো, ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল না চাঁদ।’ না গান, না কবিতা। মহাপরিচালককে বললাম। সঙ্গে এলেন খ ম হারুন। তিনি ওই শব্দগুচ্ছকে তুলে দিলেন সাদি মহম্মদের হাতে। বললাম আমার নাম যেন অনুক্ত থাকে। সাদি মহম্মদ তাকে বললেন, এ গানে তো অন্তরা নেই। নাই বা থাকুক। তিনি ভাবলেন। বাসায়, চলতি পথে সুরের পাখিকে ধরার এক পর্যায়ে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে সুর করলেন, ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল।’ ভিজ্যুয়াল করলেন খ ম হারুন আবেগ, মননশীলতা ও দক্ষতায়। কথার সঙ্গে শিল্পীর অনবদ্য কণ্ঠ-লহরি, দৃশ্য চিত্র একাকার হয়ে যায়। ৬. সাদি মহম্মদ আমার রচিত আরও কয়েকটি গানে কণ্ঠ ও সুর দিয়েছেন যা আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে গেয়েছেন, ‘সেই কবে থেকে জেগে ছিলাম আসার আশায়, তুমি আসবে বলে স্বদেশ ছিল মগ্ন ভালোবাসায়।’ এ গানগুলো নিয়ে ফরিদুর রেজা সাগর অ্যালবাম বের করেন। বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। সাদি মহম্মদকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : ’৭২ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর