শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

মায়ের ভূমিকায় দুই ঔপন্যাসিক

ইমদাদুল হক মিলন

মায়ের ভূমিকায় দুই ঔপন্যাসিক

আমি তখন উন্মাদের মতো লিখি। বড়দের লেখা, ছোটদের লেখা, গ্রামের গল্প। রফিক আজাদের সাগরেদ হয়েছি। বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার সম্পাদক তিনি। ছিয়াত্তর সালে আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ ধারাবাহিকভাবে তাঁর ‘উত্তরাধিকারে’ ছাপলেন রফিক ভাই। আমার দিনরাত্রির অনেকটা সময় কেটে যায় তাঁর সঙ্গে।

আটাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে ইত্তেফাক ভবন থেকে ‘রোববার’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সাহেবের স্ত্রী সাজু হোসেন। পত্রিকা দেখভালের দায়িত্ব রাহাত খানের। তিনি রফিক আজাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রফিক আজাদকে দিলেন পত্রিকার দায়িত্ব। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করার পরও বিকাল বেলায় এসে তিনি সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় কাজ করবেন। আমার বিখ্যাত শিল্পীবন্ধু কাজী হাসান হাবিব পত্রিকার গেটআপ মেকাপ প্রচ্ছদ আর ইলাস্ট্রেশন সব করবেন। হাবিবও সরকারি চাকরি করেন। ‘সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীতে’ পার্টটাইম করেন। আবার রোববারেও কাজ নিয়েছেন। রফিক ভাই আমাকে নিলেন জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। বেতন ৪০০ টাকা।

তখন ইত্তেফাক ভবন থেকে ‘পূর্বাণী’ নামে একটি সাপ্তাহিক সিনেমার পত্রিকা বের হতো। সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। অবজারভার ভবন থেকে বেরোত ‘চিত্রালী’। এই দুটো পত্রিকায় চলত বিরাট প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ‘রোববার’ও প্রকাশের পর হয়ে উঠেছিল ‘বিচিত্রা’র প্রতিদ্বন্দ্বী। এই রোববার পত্রিকার কারণেই রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে পরিচয়। রিজিয়া রহমানের সঙ্গে পরিচয়। সেলিনা হোসেনকে তো আগে থেকেই চিনি। বাংলা একাডেমিতে আছেন। ছোটদের পত্রিকা ‘ধান শালিকের দেশ’-এর সম্পাদক।

রাবেয়া খাতুনের বাসায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কবি ইকবাল হাসান। ইকবাল কাজ করত ‘পূর্বাণী’ পত্রিকায়। একই ভবনে অফিস। যখন তখন রোববার অফিসে এসে ইকবাল আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিত। অনেক লেখক কবির সঙ্গে তাঁর পরিচয়।

রাবেয়া খাতুনের কাছে গিয়েছিলাম রোববারের জন্য তাঁর গল্প চাইতে। ‘মালতীর বাবা’ নামে অসামান্য একটি গল্প লিখে দিলেন। প্রথম দিনই অনেকক্ষণ তাঁর সেই স্নিগ্ধ মায়াবী কণ্ঠে আমার সঙ্গে কথা বললেন। আমার দু-একটি লেখাও তিনি পড়েছেন। সেসব লেখার কথা বললেন। এত আপন করে নিলেন প্রথম দিনই, এতটা প্রশ্রয় দিলেন, আমি কল্পনাও করিনি এত বড় একজন লেখক একজন তরুণ লেখককে এতটা প্রশ্রয় দিতে পারেন। হঠাৎ হঠাৎ চলে যেতাম তাঁর বাসায়। তখন পকেটে পয়সা থাকে না। দুপুরে খাওয়া হয় না প্রায়ই। তার ওপর ধরেছি সিগ্রেট। সিগ্রেট খাওয়ার পয়সাও থাকে না। বন্ধুবান্ধবের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিই। এক দুপুরে দশটা টাকাও নেই পকেটে। রিকশা নিয়ে গেছি রাবেয়া খাতুনের বাসায়। রিকশাওয়ালাকে বলেছি, তোমাকে নিয়েই ফিরে যাব। গেটের সামনেই বসে থাক। রাবেয়া খাতুনকে গিয়ে বললাম, ‘আগে চা-নাশতা খাওয়ান, তারপর একশটা টাকা ধার দেন।’ শুনে তিনি হতবাক। তখন তাঁর আর্থিক অবস্থাও ভালো না। লিখে সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। ওদিকে শাইখ সিরাজকে নিয়ে স্টেডিয়ামের উল্টোদিকে বাবার বন্ধ করে যাওয়া ঘড়ির দোকানটি খুলে সাগর রেস্টুরেন্ট করেছে। ‘খাবার দাবার ও পিঠাঘর’ নামে। ফাঁকে ফাঁকে বিটিভির জন্য স্ক্রিপ্ট লেখে। সব মিলিয়ে খুবই স্ট্রাগলের সময়। ওদিকে ‘খাবার দাবার’ হয়ে উঠেছে আমাদের বিভিন্ন সার্কেলের বন্ধুদের নিয়মিত আড্ডার জায়গা।

রাবেয়া খাতুন আমাকে চা-বিস্কুট খাওয়ালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘একশ টাকা দিয়ে কী করবে?’ আমি তখন উগ্র তরুণ লেখক। কথাবার্তার কোনো বাছবিচার নাই। বড়দের সঙ্গেও বেয়াদপের মতো আচরণ করি। বললাম, ‘সিগ্রেট ইত্যাদি খাব।’ শুনে তিনি হাসলেন। ‘সিগ্রেট তো বুঝলাম, ইত্যাদিটা কী? বুঝেছি, বুঝেছি। টাকাটা ফেরত দেবে কবে?’

সপ্তাহখানেক পরের কথা বলে সেই যে একশ টাকা নিয়ে ভাগলাম, পনেরো দিনেও আর খবর নেই। বারেয়া খাতুন রোববার অফিসে ফোন করে আমাকে খোঁজেন। অফিসে থেকেও পিয়নকে দিয়ে বলাই, আমি নেই। তিনিও নাছোড়বান্দা। প্রায়ই ফোন করেন। একদিন টাকাটা নিয়ে গেলাম। সেই টাকা হাতে নিয়ে হাসলেন। বললেন, ‘মাত্র একশ টাকার জন্য তোমাকে আমি এত তাগিদ কেন দিয়েছি তুমি কি তা জানো? দিয়েছি একটাই কারণে, কাউকে কথা দিলে সে কথা অবশ্যই রাখতে শিখ। সারা জীবন কাজে লাগবে।’

রাবেয়া খাতুনের সেই কথা আমি মনে রেখেছি।

তারপর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। সাগর ‘ইমপ্রেস গ্র“প’ করে ‘চ্যানেল আই’ ও ‘ইনসেপ্টা’র মতো বিশাল প্রতিষ্ঠান করে যেমন সম্মানীয় হয়েছেন তেমন হয়েছেন অর্থশালী। কিন্তু মা ছেলে কেউ অতীতের দুঃখময় দিনের কথা ভুলে যাননি।

সাগর একবার আমাদের কয়েকজনকে বগুড়ায় নিয়ে গেল। বগুড়া শহরে তাঁদের বাড়ি। সেই শহরে রোমেনা আফাজেরও বাড়ি। প্রয়াণের পর একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে তাঁর নামে। সাগরকে দেওয়া হয়েছে সেই পুরস্কার। আমি আফজাল আরও কাউকে কাউকে সঙ্গে নিয়ে গেছে সাগর। রাবেয়া খাতুনও আছেন। তিনি সাগরের মা এ কথা জানার পর থেকেই আমি আর ‘রাবেয়া আপা’ বলে ডাকি না। ডাকি ‘খালাম্মা’। খালাম্মাও গেছেন আমাদের সঙ্গে। ফেরার সময় গাড়িতে একপাশে আফজাল আরেক পাশে আমি। খালাম্মা আছেন আমাদের মধ্যমণি হয়ে। তিনি গহনা পরতে ভালোবাসতেন। দামি শাড়ি পরতে ভালোবাসতেন। শরীর ভর্তি গহনা ছিল সেদিন তাঁর। আর অনেক দামি ভারি সুন্দর একটা শাড়ি। ওই শাড়ি গহনা পরা সম্রাজ্ঞীর মতো মানুষটি সেদিন ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর ফেলে আসা জীবনে। দুঃখ বেদনা আর দারিদ্র্য জর্জরিত জীবনে। সেসব কথা এত গুছিয়ে এত সুন্দর করে বলছিলেন, শুনে আমার আর আফজালের চোখ ছলছল করছিল।

একবার কক্সবাজারে চ্যানেল আইয়ের বিশাল অনুষ্ঠান। সি-বিচে আয়োজন করা হয়েছে। রহমান আমীরুলরা আছে যথারীতি। সাচ্চু আছে। খালাম্মাও আছেন। আমি আর আফজালও গেছি। সবচেয়ে বড় সরকারি মোটেলটির প্রায় পুরোটাই আমাদের দখলে। এক রোদ্র ঝলমল সকালে আমাকে আর আফজালকে নিয়ে মোটেলের সমুদ্রমুখী মাঠটিতে ধীরে ধারে হাঁটতে লাগলেন খালাম্মা। এক হাতে আমার হাত ধরেছেন অন্য হাতে ধরেছেন আফজালের হাত। আফজাল কথায় কথায় বলল, ‘আপনাকে আর মিলনকে নিয়ে আমি একটা বিজ্ঞাপন তৈরি করব। দুজন অসমবয়সি লেখক বন্ধুর গল্প।’ শুনে তিনি উচ্ছ্বসিত। ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কর আফজাল।’ আমি তো সেই শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গে ঠাট্টার সুরে কথা বলি। আপা থেকে খালাম্মা হওয়ার পরও। সেই মুহূর্তে ঠাট্টার সুরেই বললাম, ‘আর আমি একটি লেখা লিখব। সেই লেখার নাম হবে, ‘আমার বন্ধু রাবেয়া খাতুন’। শুনে তিনি তাঁর সেই স্নিগ্ধ হাসিটি হাসলেন। ‘তুমি তো লিখতেই পার। লেখকরা তো পরস্পরের বন্ধুই হয়। বয়স সেখানে কোনো সমস্যা নয়।’

কতটা আধুনিকমনস্ক হলে একজন অনুজ লেখককে এরকম কথা বলা সম্ভব। সেই লেখা আমার আর লেখা হয়নি। কতদিনকার কত স্মৃতি তাঁর সঙ্গে। কত পিছনে ফেলে আসা ঘটনা। কত আনন্দের দিন। এই লেখায় তাঁর কিছুই লিখতে পারলাম না। অতিপ্রিয়জনকে নিয়ে লেখা খুবই সমস্যার। কী রেখে কী লিখব বুঝে উঠা মুশকিল।

রাবেয়া খাতুনের মতো লেখকের আসলে মৃত্যু নেই। তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মধ্যে নেই এটা সত্য। কিন্তু তাঁর কাজ তো রয়ে গেছে। তাঁর লেখাগুলো তো রয়ে গেছে আমাদের বইয়ের আলমারিজুড়ে। ‘মধুমতী’র মতো উপন্যাস রেখে গেছেন তিনি। রেখে গেছেন ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’। পুরান ঢাকার সর্দারদের নিয়ে লেখা অসামান্য এক উপন্যাস। এই সব উপন্যাস বহুকাল বাঁচিয়ে রাখবে তাঁকে। আটাত্তর সালের একদিন ‘রোববারে’ চা-সিগারেটের আড্ডা চলছে। আমাদের মধ্যমণি রফিক আজাদ। ‘রোববারে’র জন্য গল্প জোগাড় করার চেষ্টা চলছে। ইকবাল হাসানের ওপর দায়িত্ব পড়েছে রিজিয়া রহমানের গল্প সংগ্রহ করার। আমাকে নিয়ে এক দুপুরে ইকবাল রওনা দিল রিজিয়া রহমানের বাসায়। তিনি তখন মগবাজারে থাকেন। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়ির গলিতে। ইকবালের অবাধ যাতায়াত সেই বাসায়। সেদিন ইকবালের সঙ্গে আমিও। দুপুর হয়ে গেছে, আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। ইকবাল আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিজিয়া রহমান বললেন, ‘ওকে আমি চিনি। লেখা পড়েছি। আমাদের বিক্রমপুরের ছেলে তা-ও জানি।’ তারপর তিনি তীক্ষè চোখে প্রথমে আমার দিকে তাকালেন, তারপর তাকালেন ইকবাল হাসানের দিকে। ‘মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তোমাদের খাওয়া হয়নি। একটু বসো।’ তিনি ভিতরের দিকে চলে গেলেন। দশ-পনেরো মিনিট পরে এসে খেতে ডাকলেন। তারপর মায়ের স্নেহে সামনে বসিয়ে আমাদের দুজনকে খাওয়ালেন। আমি ততক্ষণে তাঁকে আপা ডাকতে শুরু করেছি। খেতে বসে গল্প করলাম, আপার মুখে পান। তারপর জীবনে যত দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, মনে হয় বেশির ভাগ সময় তাঁর মুখে পান দেখেছি। আর এত ধীর, শান্ত নম্র কণ্ঠে কথা বলতেন, কথায় ঝরত গভীর মমত্ববোধ। ‘রোববারে’র জন্য গল্প চেয়ে এলাম। দিন দশেকের মাথায় দুপুরের পরপরই তিনি ‘রোববার’ অফিসে এসে উপস্থিত। গল্প নিয়ে নিজেই চলে এসেছেন। আমি বিস্মিত হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। একজন বড় লেখক এভাবে পত্রিকা অফিসে এসে তাঁর লেখা পৌঁছে দেন, এ ধারণা আমার ছিল না। পরিচয়ের আগে বিচ্ছিন্নভাবে রিজিয়া আপার কয়েকটি গল্প আমি পড়েছি। ‘উত্তর পুরুষ’ নামের উপন্যাসটি পড়েছি। তাঁর লেখা আমার খুবই ভালো লেগেছে। রফিক আজাদও বসে ছিলেন অফিসে। কিন্তু রিজিয়া আপা গল্পটি দিলেন আমার হাতে। মনে আছে সেই গল্পের নাম ‘বহর’। ভারি চমৎকার গল্প। বললেন, ‘আমার শরীরটা ভালো নেই, জ্বর। তার পরও ভাবলাম, গল্পটা এসে দিয়ে যাই।’ রফিক ভাই চা খাওয়ার কথা বললেন, তিনি রাজি হলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে একটু এগিয়ে দাও মিলন।’

ওই সময় একটি সরকারি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোত, নাম ‘প্রতিরোধ’। সম্পাদক ছিলেন আরেফিন বাদল। সচিবালয়ের ভেতরে ছিল পত্রিকাটির অফিস। করটিয়া কলেজে আরেফিন বাদল ছিলেন রফিক আজাদের ছাত্র। রফিক ভাইয়ের কল্যাণে পরিচয় তাঁর সঙ্গে। ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছে। সেই সংখ্যায় বাদল ভাই আমার ‘দুঃখ কষ্ট’ উপন্যাসটি ছেপেছেন। ‘দুঃখ কষ্ট’ আমার তৃতীয় উপন্যাস। রফিক আজাদকে নিয়েই লেখা। উপন্যাসটির প্রতিটি চ্যাপ্টার শুরু হয়েছিল রফিক আজাদের একেকটি কবিতার লাইন দিয়ে। নামটাও তাঁর কবিতা থেকেই নেওয়া। ‘পাখি উড়ে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে কঠিন মাটিতে, এই ভেবে দুঃখ পেয়েছিলেন’ এই কবিতা থেকেই নামটি নেওয়া হয়েছিল। আমার খুব ইচ্ছা, উপন্যাসটি রিজিয়া আপাকে পড়াই। কিন্তু আমার কাছে কপি নেই। স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিককার ফুটপাতে হকাররা পত্রিকা নিয়ে বসে। ওখানে গেলে পাওয়া যাবে। কথাটা বললাম রিজিয়া আপাকে। তিনি বললেন, ‘চলো যাই’। ওই জ্বর গায়ে তারপর তিনি আমার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলেন। গল্প করতে করতে আমি হাঁটছি তো হাঁটছি। ইত্তেফাক ভবন থেকে স্টেডিয়াম খুব একটা কাছে নয়। আর আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম ঘুর পথে, মতিঝিলের ওদিকটা হয়ে সোনালী ব্যাংক ভবনের পাশ দিয়ে। রিজিয়া আপা এক সময় হাসিমুখে বললেন, ‘আর কত হাঁটব, একটা রিকশা নাও।’

‘এখন আর রিকশা নিয়ে কী হবে। এসেই তো পড়েছি।’ রিজিয়া আপা আর কথা বললেন না। স্টেডিয়ামের ফুটপাত থেকে পত্রিকাটি তিনি কিনলেন। তারপর আমি তাঁকে রিকশা ঠিক করে দিলাম। তিনি বাড়ি চলে গেলেন।

‘রোববার’ অফিসে আমরা রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত আড্ডা দিতাম। সেদিনও আড্ডা চলছে। রাত ৮টার দিকে রিজিয়া আপার ফোন এলো। আমাকে চাইলেন। ফোন ধরতেই বললেন, ‘আমার জ্বর ছিল, তোমার উপন্যাসটা পড়ে জ্বর ছেড়ে গেল, খুব ভালো লিখেছ।’ কত কত বছর আগেকার কথা, কিন্তু রিজিয়া আপার সেই অসামান্য অনুভূতির কথা আমি কখনো ভুলতে পারিনি। আমার লেখা পড়ে তাঁর জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল, ভাবা যায়!

তারপর বহু বছর কেটে গেছে জীবনের। কত ঘনিষ্ঠতা রিজিয়া আপার সঙ্গে। যখন তখন চলে যাই তাঁর বাড়িতে। বিশেষ করে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেই যাই। রিজিয়া আপা আমার মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন। দুপুরের খাবার শেষ হয়ে গেলে নতুন করে রান্না করে খাওয়ান। ২০, ৫০, ১০০ টাকা চেয়ে নিয়ে আসি তাঁর কাছ থেকে। যেন আপন বড় বোনটি। যেখানে তাঁর যে লেখা পাই তা-ই পড়ি। সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র প্রায় প্রতিটি ঈদ সংখ্যায় তাঁর উপন্যাস ছাপা হয়। আর কী একেকটি লেখা! ‘রক্তের অরে’ লিখলেন পতিতাপল্লীর মেয়েদের নিয়ে। এ এক অসামান্য উপন্যাস। দুঃসাহসীও বটে। যে সময়ে রিজিয়া আপা এই উপন্যাসটি লিখলেন, তখন এরকম লেখা লেখার সাহস অন্য কেউ করতেন বলে আমার মনে হয় না। সাহিত্যের পাঠকরা কেঁপে উঠেছিল ‘রক্তের অরে’ পড়ে। তারপর তিনি লিখলেন, চা শ্রমিকদের নিয়ে আরেক অসামান্য উপন্যাস, ‘সূর্য সবুজ রক্ত’। চা শ্রমিকদের অতি কষ্টকর জীবনের ছবি তিনি তুলে ধরলেন সেই উপন্যাসে। পাশাপাশি চা শিল্পের ইতিহাসকেও মেশালেন উপন্যাসের পরতে পরতে। এই ভূখন্ডের ইতিহাস বরাবরই রিজিয়া আপাকে খুব আকর্ষণ করেছে। তাঁর ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসটি পড়লে যে কোনো পাঠকই এ কথা উপলব্ধি করবে। ঢাকার মসলিন শাড়ি তৈরির শিল্পীদের নিয়ে তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘আবে রওয়াঁ’। যতদূর মনে পড়ে এই উপন্যাসটির একটি অংশ ‘রোববার’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বহু পরে পরিপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে তিনি তা প্রকাশ করেন। তাঁর তিন পর্বের আত্মজীবনী ‘অভিবাসী আমি’, ‘নদী নিরবধি’ ও ‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’ যে কোনো পাঠককে একজন মহৎ ঔপন্যাসিকের জীবনের সঙ্গে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিচয় করিয়ে দেবে।

প্রিয় মানুষদের নিয়ে অনেক কিছু লেখার থাকে। অনেক কিছু বলার থাকে। রিজিয়া আপা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন বহু বছর আগে। তারপর তাঁকে আর তেমন বড় পুরস্কার পেতে দেখিনি। ২০১৮ সালে তিনি পেলেন ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। সেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হুইলচেয়ারে করে এলেন রিজিয়া আপা। তিনি হাঁটাচলা তেমন করতে পারেন না। আসাদুজ্জামান নূর, আমাদের প্রিয় নূরভাই রিজিয়া রহমানের খুবই ভক্ত। রিজিয়া আপা মুখ ফুটে কখনো তাঁর নিজের সম্পর্কে কিছু বলতেন না। না নিজের লেখা নিয়ে, না কোনো পুরস্কার নিয়ে। পুরস্কার পাওয়ার আশায় তিনি আসলে কোনো দিন লেখেননি। তিনি আমৃত্যু লিখে গেছেন তাঁর আনন্দ থেকে। নিজের ভালো লাগা থাকে। নিভৃতে থেকে নিজের মতো করে লিখতেন। কোনো প্রচার-প্রচারণার ডামাডোলে তিনি একেবারে বিশ্বাসী ছিলেন না। সাহিত্যের অনুষ্ঠানগুলোতে তাঁকে খুব একটা যেতে দেখিনি আমি। ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ বিতরণী অনুষ্ঠানে কেমন করে যেন নূরভাই জেনে গেলেন রিজিয়া আপা তখনো একুশে পদক পাননি। তিনি বিস্মিত হলেন। পরের বছর রিজিয়া আপা একুশে পদক পেলেন। তাঁর সঙ্গে আমিও পেয়েছি। বিশ্বজিৎ ঘোষ, হরিশংকর জলদাসও পেয়েছেন। পুরস্কার পর্ব শুরুর আগে পুরস্কারপ্রাপ্ত সবাইকে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে’র একটি রুমে বসানো হয়েছে। রিজিয়া আপা হুইলচেয়ারে বসে আছেন। বরাবরই কম কথা বলার মানুষ। আমি বসে আছি আপার পাশে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘মিলন, অনেক আগেই তোমার একুশে পদক পাওয়া উচিত ছিল।’ আমি আপার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আর, আপনার’। আপা কোনো কথা বললেন না।

ওই ছিল আমার সঙ্গে আপার শেষ কথা, শেষ দেখা। ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান চলে গেছেন কিন্তু বাংলা সাহিত্যের জন্য রেখে গেছেন অপূর্ব কয়েকটি উপন্যাস। বাংলা সাহিত্য থেকে কখনোই তাঁর নামটি মুছে যাবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর