শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

সত্য-মিথ্যার সীমারেখা ও সিয়াম সাধনা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সত্য-মিথ্যার সীমারেখা ও সিয়াম সাধনা

সত্য-মিথ্যা আলো ও অন্ধকারের মতোই। সত্য সুন্দর। মিথ্যা অসুন্দর অন্ধকারের সমতুল্য। আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য সাধারণ দৃষ্টিতে সহজে বোঝা গেলেও প্রকৃতপক্ষে এর সীমারেখা বাছবিচার করা কঠিন। কারণ মিথ্যার আবরণ সরিয়ে সত্যকে বের করতে হয় আবার সত্যকে মিথ্যার প্রলেপ প্রলোভন হতে মুক্ত রাখতে হবে। উভয় প্রকার কাজও দুঃসাধ্য এ জন্য যে, সত্যকে আত্মসাৎ করতে মিথ্যার প্রচেষ্টার অন্ত নেই। অন্ধকারও দ্রুত ধাবমান আলোকে গ্রাস করার চেষ্টা করে। আলো স্থায়ী কিন্তু তাকে ক্ষণস্থায়ী করতে চলে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। মাহে রমজানের রোজা পালনকারীকে সত্য ও মিথ্যা আলো-অন্ধকারের এই অবিরাম বোঝাপড়াকে উপলব্ধি করতে হয়। মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের প্রবণতা সব সময় কার্যকর। ভালো প্রবণতা যদি মন্দ প্রবণতার চেয়ে জোরদার হয়, শক্তিশালী হয়, তাহলে তার দ্বারা ভালো বিকাশ লাভ করে থাকে। আবার মন্দ প্রবণতা যদি ভালো প্রবণতাকে পরাজিত করতে পারে, অতিক্রম করে, তাহলে মন্দই প্রকাশ পাবে। মানুষের মনের মধ্যে ভালোর প্রতি আগ্রহ যেমন আছে মন্দের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতাও তেমন রয়েছে। এই প্রবণতা বা ইচ্ছার প্রতিনিয়ত ইন্ধন জোগাচ্ছে সেরা কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান। সিয়াম সাধনার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো- ভালোর প্রতি আগ্রহ ও আকাক্সক্ষাকে দৃঢ় করা, সত্যের প্রতি একাগ্র হওয়া এবং মিথ্যা অসত্য অসুন্দর হতে দূরে থাকার জন্য বিশেষ চেষ্টা করা।

একজন রোজাদার তার আচার-আচরণে বিশ্বাস ও বয়ানে এমন হবেন যেন তার মধ্যে সত্য ও সুন্দরের প্রকাশ ঘটে। একজন রোজাদার ব্যক্তির চিন্তায় ও কাজে প্রকৃত রোজাদারের পরিচয় থাকা চাই। হাদিসে বলা হয়েছে, রোজাদার ব্যক্তির মধ্যে যদি রোজার আগের আচার-আচরণই বিরাজ করে তাহলে রোজা রাখা শুধু উপবাস থাকার সমতুল্য হয়ে যায়। রোজাদার যদি মানসিকতায় রোজাদার না হয়, তাহলে রোজা পালনের সার্থকতা নেই। মিথ্যা পরিহার, খারাপ ইচ্ছা পরিহার, খারাপ ইচ্ছা দমন, অন্যায় অনিয়মকে প্রশ্রয় না দেওয়াসহ সব ব্যাপারে ও বিষয়ে একজন রোজাদারের মধ্যে যথার্থ পরিবর্তন যদি না আসে তাহলে তার রোজা পালন নিছক অভিনয়ের তুল্য হয়ে দাঁড়ায়। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার গ্রহণে বিরত থাকাটাই রোজা পালনের জন্য যথেষ্ট নয়, চিন্তায় ও কাজে, চলাফেরায়, দৃষ্টিপাতে, আলাপ-ব্যবহারে সব ক্ষেত্রেই সংযমী হওয়া সিয়াম সাধনার শর্ত। অপচয় অপব্যয় ব্যষ্টিক ও সমষ্টির সামগ্রিক অবয়বে অনির্বচনীয় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্থান-কাল-পাত্র-নির্বিশেষে এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সময় সম্পদ ও সুযোগের সুষম ব্যবহারের সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। আল কোরআনে অপচয় অপব্যয় ও অমিতাচার থেকে দূরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা মানুষকে দেখাবার জন্য তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ আখিরাতে বিশ্বাস করে না আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না, আর শয়তান কারও সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কত মন্দ’ (সুরা নিসা-৩৮)। ‘অপচয় করবে না, কারণ আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা আল আনআম-১৪১)।

‘হে বনি আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করবে। আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অমিতাচার করবে না। তিনি অমিতাচারীকে পছন্দ করনে না’ (সুরা আরাফ-৩১)। ‘আত্মীয়স্বজনকে দেবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও পর্যটককেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় কৃতজ্ঞ’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)। ‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়’ (সুরা ফুরকান-৬৭)।

অপব্যয়ের ফলে স্বভাবত অন্য ক্ষেত্রের ন্যায্য দায় পরিশোধে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে থাকে বলেই ব্যয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুষম অবস্থা অবলম্বনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সম্পদ সসীম, চাহিদা অসীম। সসীম সম্পদের সুষম ব্যবহারের দ্বারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাহিদা মেটানো যেখানে জরুরি সেখানে অপব্যয়ের অবকাশ নেই। ব্যষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা। অপব্যয় অপচয়ে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়, বৈষম্য প্রকাশ্য হয়ে ওঠে ভোগ ও বণ্টন প্রক্রিয়ায়। পানাহারের ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ক্ষুধা ও প্রয়োজনের চাইতে অধিক খাদ্য গ্রহণ অনুচিত। ফিকাহবিদগণ উদরপূর্তি ও অস্বাভাবিক ভক্ষণ করাকে নাজায়েজ লিখেছেন। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘বেশি পানাহার থেকে বেঁচে থাক। কারণ অধিক পানাহার দেহকে নষ্ট করে, নানান রোগের জন্ম দেয় এবং কর্মে অলসতা সৃষ্টি করে। পানাহারের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর। এটা দৈহিক সুস্থতার পক্ষে উপকারী এবং অপব্যয় থেকে দূরবর্তী।’ কোরআনে অপব্যয়কারীদের শয়তানের দোসর সাব্যস্ত করা হয়েছে, যারা আল্লাহর পথে নিজেরাও ব্যয় করে না এবং অন্যকেও ব্যয় না করার অনুপ্রেরণা জোগায়, অথচ তারা অপচয় করে লোককে দেখানোর উদ্দেশ্যে। হাদিসে এমন কাজকে শিরক বলেও অভিহিত করা হয়েছে। মুসনাদে আহমাদে সংকলিত এবং সাদ্দাম ইবনে আওস বর্ণিত হাদিসে আছে, ‘আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ল সে শিরক কর। যে লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা রাখল সে শিরক করল। এবং যে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সদকা খয়রাত করল সে শিরক করল’ (মুসনাদে আহমাদ)। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ প্রসঙ্গে সত্য-মিথ্যার বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। নির্ভেজাল এবং পারস্পরিক কল্যাণ ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসা-বাণিজ্যই সৎ ও কল্যাণকর। এতদ্সংক্রান্ত আল কোরআনের ভাষ্য এই- ‘আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন’ (সুরা বাকারা-৭৫)। নগদ আদান-প্রদান ব্যতীত যে কোনো লেনদেন তা ছোট হোক আর বড় হোক মেয়াদসহ লিখতে কোনো বিরক্ত না হওয়া’ (সুরা বাকারা-২৮২)।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান

সর্বশেষ খবর