রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

অংকন থেকে অবন্তিকা : কেন এ অপমৃত্যু?

লাকী আক্তার

অংকন থেকে অবন্তিকা : কেন এ অপমৃত্যু?

‘এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।’ এ কথাগুলো ফেসবুকে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। সুইসাইড নোটে তিনি তার এক সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী প্রক্টরকে দায়ী করেন মৃত্যুর জন্য। কিন্তু আমরা এখনো জানি না দুই বছর আগে ২০২২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অংকন বিশ্বাস কীভাবে মারা গিয়েছিলেন-সুইসাইড, নাকি মার্ডার! পিতৃহারা অবন্তিকার মা আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলা দায়ের করেন। অভিযুক্তরা গ্রেফতারও হয়েছেন। অংকন বিশ্বাসের মৃত্যুতে কি কেউ দায়ী নয়? তার মৃত্যুরহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। অংকন অনার্সে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করেন। ছিলেন একজন তুখোড় বিতার্কিক ও নৃত্যশিল্পী। প্রায় ১৪ দিন আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অংকন মারা যাওয়ার পর তার সহপাঠীরা অংকনের প্রেমিক শাকিলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। অংকন কেন ‘আত্মহত্যা’ করতে গেলেন, নাকি তিনি পরিকল্পিত হত্যার শিকার-সে বিষয়ে কোনো কিছু সুরাহা হয়নি। পুলিশ বাদী হয়ে অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে। হাসপাতালে তার ভর্তি সিøপেও ‘পুলিশ কেস’-এর সিলমোহর ছিল। কিন্তু সহপাঠীদের অনেক অনুরোধেও নিহত মেয়েটির পরিবার কোনো মামলা করতে রাজি হয়নি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম ও টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিম অভিযোগ করেছেন তার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের ‘কুপ্রস্তাব’-এ রাজি না হওয়ায় তাঁর শিক্ষাজীবন ও ব্যক্তিগত জীবন চরম হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষ বিশেষ শিক্ষকের সাবজেক্টে পরীক্ষায় অন্যায়ভাবে ফেল করানো হচ্ছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম গত ১৮ মার্চ গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান, ফারজানা মিমের ঘটনায় যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে বহিঃসদস্য হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, সেই কমিটির প্রতিবেদনকে আমলে নেওয়া হয়নি। তিনি মিমের বিভাগের চেয়ারপারসনের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করবেন এবং মেয়েটি কেন চেয়ারপারসনের সাবজেক্টে ফেল করল সেটির কারণ জানতে চাইবেন। বেদনাদায়ক হলেও সত্য, অবন্তিকার মৃত্যুর কারণেই মিমের বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে এবং আমরা আশা রাখি হয়তো দেরিতে হলেও তিনি ন্যায়বিচারও পাবেন। কিন্তু অংকন বিশ্বাস কি কখনো ন্যায়বিচার পাবেন? অংকনের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও সোচ্চার হয়েছেন। ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যু ও ফারজানা মিমের সঙ্গে হওয়া নিপীড়নের বিষয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু তড়িৎ পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলনের মাঝে জবি প্রশাসন যদি অংকন বিশ্বাসের মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে আইনি প্রক্রিয়াটি শুরু করেন তাহলে সেটি একটি অনন্য নজির হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক আলোচিত এ ঘটনাগুলো থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত, এখানে বিচার চাইতে গেলে আরও বেশি হয়রানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মিমের ভাষ্য, ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে তিনি তার অভিযোগ দায়ের করেন এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিচার দাবি করে একাই প্লাকার্ড হাতে দাঁড়ান। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। মিম জানান, দুই বছরেও তিনি বিচার তো পাননি-ই উল্টো আরও হয়রানির শিকার হন। অবন্তিকার বেলায়ও আমরা একই চিত্র দেখি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আস্থা তৈরি করতে পারেন তাহলে হয়তো বহু অবন্তিকা আত্মহত্যা থেকে রেহাই পাবেন, বহু মিম তার শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি দু-একজন শিক্ষার্থীকে জানি যারা ন্যায়বিচারের আশ্বাস পেলে নিজ নিজ অভিযোগ নিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত শিক্ষার্থীদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো, যাতে তারা কোনো বাড়তি হয়রানির আশঙ্কা ছাড়া প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে পারেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই নিপীড়নের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা পরিবারকে অবগত করতে চান না। কারণ, কিছু পরিবার এ ধরনের পরিস্থিতিতে সন্তানের পাশে থাকার বদলে উল্টো তার শিক্ষাজীবনই থামিয়ে দেন। আবার যারা বিচারের দাবি করেন, সেই পরিবারটিকে নতুন করে ভুক্তভোগী হতে হয়। বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার অভাব এক্ষেত্রে একটা কারণ, কিন্তু একমাত্র নয়। কোনো কোনো পরিবার রক্ষণশীল মূল্যবোধের কারণেও নিজের সন্তানের লড়াইকে এগিয়ে না নিয়ে তাকে পিছিয়ে আসতে বলে। সমাজের মধ্যকার পুরুষতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাবও একজন নারী শিক্ষার্থীর বিচার প্রাপ্তিকে অবরুদ্ধ করছে। অবন্তিকার বেলায়ও আমরা পুরুষতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব লক্ষ্য করি; বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মন্তব্যগুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ করার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে, ছাত্র এবং শিক্ষকের সম্পর্ক মূলত ‘মালিক’ ও ‘চাকর’ এর সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্লাসে উপস্থিতির হার, পরীক্ষার ফলাফল, অ্যাসাইনমেন্টসহ নানা বিষয়ে শিক্ষকের আনুকূল্য পেতে শিক্ষার্থীরাও দাসসুলভ মনোভাব নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রাখতে চান। কোনো শিক্ষক যদি কোনো কারণে শিক্ষার্থীর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন, তবে ওই শিক্ষার্থীর পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জীবন সংকটাপন্ন হতে পারে। এ বাস্তবতায় ভুক্তভোগীকে ক্রমাগত মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ মোকাবিলায় মনোরোগ সেবার কেন্দ্র আছে জবিতে। কিন্তু নানা কারণে মানসিক সমস্যায় ভোগা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে ওইসব শিক্ষকেরও মানসিক শুশ্রƒষা জরুরি, যারা ছাত্রদের ক্রীতদাস মনে করেন। যদিও কেবল বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর মধ্যেই এই মনোবৃত্তির প্রতিকার সম্ভব নয়। বর্তমান জবি উপাচার্য বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তার প্রশাসন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আশা করব উপাচার্য তা বাস্তবায়ন করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল থাকতে হবে-২০০৯ সালে হাই কোর্ট এমন নির্দেশনা জারি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হলে কোথায় এবং কীভাবে অভিযোগ করতে হবে এ বিষয়ে তাদের সজাগ করা এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী যেন নিঃসংকোচে অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হাজির হতে পারেন সেজন্য নিয়মিত প্রচারণামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হতে দেখা গেছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক একটি নজির। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। 

অবন্তিকার এই দুঃখজনক মৃত্যু অংকন, মিমসহ আরও অনেকের ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু ন্যায়বিচারের সেই মূল্যটা বড্ড বেশি হয়ে গেল। আর কোনো মিমকে যেন বিপর্যস্ত হয়ে বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয় সেটাই চাওয়া।

লেখক : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী

সর্বশেষ খবর