মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের দায় আছে ভারতেরও, ক্ষমা চাক পাকিস্তান

অমল সরকার

সোমবার ভারতে আমরা যখন দোলযাত্রার আনন্দে  মেতে আছি, বাংলাদেশের মানুষ তখন শোকের গণহত্যা দিবস পালন করছে। আমাদের স্বাধীনতা দিবসটিও ও-দেশে চরম শোকাবহ অষ্টপ্রহর। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু তথা  দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। পড়শি দেশ যে দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে।

৩০ লাখ বাঙালির আত্মবলিদান এবং ১৬৬৮ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর বিনিময়ে পাকিস্তানের কবল  থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মেলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যা সে দেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। সে বছর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই পূর্ব পাকিস্তানকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিব। পরবর্তী ৯ মাসের যুদ্ধ ছিল  দেশকে পাকিস্তানি সেনা মুক্ত করা। সেই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। ৯ মাসের সেই যুদ্ধের ঠিক প্রাক মুহূর্তটি ছিল ২৫ মার্চের রাত। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না, তারা পাকিস্তানের কবলমুক্ত হতে মরিয়া বুঝতে পেরে পশ্চিম পাকিস্তানের  সেনা শাসকরা সেই রাতে খাঁচা থেকে বুভুক্ষু বাঘের পাল  ছেড়ে দেওয়ার মতো ব্যারাক থেকে হাজার হাজার  সেনাকে ঢাকার রাজপথে নামিয়ে দিয়েছিল। এক রাতেই তারা ঢাকা এবং আশপাশের জেলা মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে, দাবি বাংলাদেশ সরকারের। গ্রেফতার করে হাজার তিনেক নাগরিককে। নিজের দেশের নাগরিকের ওপর এত বড় রাষ্ট্রীয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নজির কমই আছে।

অপারেশন সার্চলাইট নামের সেই সেনা অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল গোড়াতেই বাঙালির মুক্তির বাসনার  কোমর ভেঙে দেওয়া। মুছে দিতে চেয়েছিল বাঙালির প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতির যাবতীয় অর্জন। পরের ৯ মাসে তারা টের পেয়েছিল বাঙালির বাচ্চার রক্তের তেজ। সেই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের কবিতার কালজয়ী লাইনগুলো মনে পড়ে- ‘অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার কানায়-কানায় রক্তে উঠবে ভরে,/যে রক্ত বাংলায় বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মতো।’ কিন্তু ভুলটা স্বীকার করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা যতটা রচিত হয়েছে, অত্যাচারের কাহিনি লিপিবদ্ধ করার কাজটি বহু বছর ততটা পেশাদারি ও আন্তরিকতার অভাবে হয়নি। তার প্রধানতম কারণ, শেখ মুজিবুরের হত্যা-পরবর্তী সেনা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাসকদের রাজত্বকাল।

চুকনগরের গণহত্যা নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের ভূমিকায় মুনতাসীর মামুন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যে অভিজ্ঞতাটি লিপিবদ্ধ করেছেন তা এক কঠিন বাস্তবের মুখে ফেলে দেয়। নিজের অভিজ্ঞতায় বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলকে নিয়ে উন্মাদনা  দেখে এক রিকশচালক বলে ওঠেন, ‘পাকিস্তানি গো লইয়া এত হইচই। তারা কী অত্যাচার করছে গাছের পাতাও সাক্ষী দিব।’

হয়তো সেই রিকশাচালক কখনো স্কুলে যাননি। হতে পারে তিনি নিজের নামটি সই করতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের নাম শোনেননি। তবু তাঁর  চেতনায়, মস্তিষ্কে খোঁচা দিয়েছিল একাত্তরের গণহত্যা।

গণহত্যার পর ঢাকার মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্লাড  গোপন বার্তায় ওই হত্যাকান্ডকে ‘সিলেক্টিভ  জেনোসাইড’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সানডে টাইমস প্রথম পাতায় হত্যাকান্ডের বর্ণনাকে শিরোনাম করেছিল ‘দ্য জেনোসাইড’। ফজলুল কাদের কাদেরির বাংলাদেশ ‘জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস’, এ কে এম নাসিমুল কামালের ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ’, মুনতাসীর মামুনের ‘চুকনগরের গণহত্যা’ বইয়ে গণহত্যার বিশদ বর্ণনা আছে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংসদে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) আইন পাস হওয়ার দিন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেছিলেন, ‘আমরা যুদ্ধাপরাধীদের শুধু বাংলাদেশের শত্রু মনে করি না, মনে করি মানবতার শত্রু। সেই হিসেবে আমরা তাদের বিচার করতে যাচ্ছি।  সেই দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়। সমগ্র বিশ্বের সভ্য মানবসমাজের কর্তব্য এদের নিন্দা করা, ঘৃণা করা, ধিক্কার দেওয়া।’ কিন্তু আগেই উল্লেখ করেছি বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ করার আন্তরিকতা দেশটির শাসকদের ছিল না। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী ঠান্ডা যুদ্ধের পরিমন্ডল এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে থমকে ছিল যে, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ তখন ততটা গুরুত্ব পায়নি। সেই সময় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল কেমন ছিল তা বোঝা যায় জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্টের ১৯৭১ সালের ৩ জুনের মন্তব্য থেকে। তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মানব ইতিহাসের অত্যন্ত মর্মান্তিক পর্ব।’ যদিও বাকি কাজ ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য ফেলে রেখেছিলেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নানাভাবে চেষ্টা হয়েছে অপরাধীদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বিচারের অসমাপ্ত কাজের অনেকটা সম্পন্ন করেছে দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখে দাঁড় করিয়ে। কিন্তু ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগপত্র তৈরি হয়েছিল তাদের বিচার আজও হয়নি। বিচার হয়নি সেই পাক শাসকদের যারা একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যত হয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইট এবং তার আগের ২৪ বছরের অসংখ্য নৃশংসতার আসল লক্ষ্য ছিল যা কিছু বাঙালির তার সবটুকু নির্মূল করে দেওয়া।

যদিও গণহত্যার বিচারের কোনো সময়রেখা হতে পারে না। দুই বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেমনিক ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন ’৭১-এর গণহত্যা নিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছে। তারা দাবি তুলেছে, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট নামে পাক সেনাবাহিনীর দেশের নাগরিকের ওপর সংঘটিত হত্যাকান্ডকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি  দেওয়া হোক।

রাফায়েল লেমনিকের নামে এই ইনস্টিটিউট যিনি ‘জেনোসাইড’ শব্দটি প্রচলনের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং সূচনা করেছিলেন জাতিসংঘের ঐতিহাসিক জেনোসাইড কনভেনশনের।

১৯৮১ জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়, মানব ইতিহাসের গণহত্যার মধ্যে কম সময়ের সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন প্রতিদিন। যা গণহত্যার ইতিহাসে  দৈনিক সর্বোচ্চ গড়। স্বাধীনতা যুদ্ধকে রক্তপাতের মানদন্ডে মাপা হলে কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সর্বাগ্রে থাকবে।

পাকিস্তান ৫৩ বছর পরও তার সেনাবাহিনী সংঘটিত অপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি এবং ১৯৭২ সালে প্রধান অপরাধী হিসেবে বাংলাদেশ চিহ্নিত ১৫৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারও করেনি। পাকিস্তানের নিজস্ব হামদুর রহমান কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংসতার জন্য দায়ী যুদ্ধবন্দিদের শাস্তির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছিল, যা পাক শাসকরা কার্যকর করেনি।

জাতিসংঘ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বসনিয়া, কম্বোডিয়া এবং রুয়ান্ডার গণহত্যার বিষয়েও পদক্ষেপ করেছে। তবুও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সশস্ত্র গুন্ডারা যেভাবে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করেছে সেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজও মেলেনি।

তার অন্যতম কারণ ভূরাজনৈতিক। মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার তৎকালীন নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা আমরা জানি। জানি কী ভূমিকা নিয়েছিল চীন। পাকবাহিনীর হত্যালীলা আজ রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি পেলে তাদের মুখ পুড়বে। ব্যর্থ হবে তাদের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। ফলে মার্কিন সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবকে সামনে রেখে ঘটনার স্বীকৃতি দাবির লড়াইকে নয়া মাত্রা দেওয়া যেতে পারে, উচিতও।

কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের কাছ থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপ আশা করা ভুল। মার্কিন প্রশাসন চায় না, চায় না চীনও। আজও তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে রাজি নয়। আর সেই সুযোগে পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবেই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছে। ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হিংসা, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদকে উসকানি দিয়ে তারা নিজেরই অস্তিত্ব, নিজেরই অতীত রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত।

দুই বছর আগে জনপ্রিয় পাক দৈনিক দ্য ডন-এর সম্পাদকীয় ‘East Pakistan Lessons’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয় Unfortunately, a few lessons learn from that tragedy. Denying people their rights, including the rights to information, imposing the will of the few on the many, and resorting to authoritarian tactics are still the preferred methods of those who control the levers of power in Pakistan. Fifty years later thorough and honest national debate is still pending on the separation of the eastern wing so that the mistakes at the mistakes of the past are not repeated. If a section of the people agitates for their rights are not working against state; they are simply seeking the fundamental safeguards promised to them in the constitution— they cannot be termed traitor as they were in Pakistan.

এখন প্রশ্ন হলো, ’৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে করণীয় কী। কোনো সন্দেহ নেই, কূটনৈতিক দৌত্য সবচেয়ে জরুরি। এ ব্যাপারে আমরা তাকাতে পারি মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত সরকার, বিশেষ করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতার দিকে। রাষ্ট্রসংঘে ভারতের প্রতিনিধি অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক অশোক মুখোপাধ্যায় তাঁর পাবলিক লেকচারে খুব সুন্দর করে বিবৃত করেছেন তৎকালীন সময়ে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা। যার ফলে রুশ প্রেসিডেন্ট, ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পাক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানকে অপারেশন সার্চলাইটের নিন্দা করে চিঠি পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধান সূত্র বের করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা জাতিসংঘে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে একটি মত তৈরি করেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত কোল পেতে দিয়েছিল। ১ কোটি ছিন্নমূল মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আর দাইমার মতো ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের বাঙালির অভীষ্ট মুক্তির প্রসব ঘটাতে হাত লাগিয়েছিল। লাঘব করেছিল মুক্তির প্রসব বেদনা। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের নৃশংস গণহত্যার স্বীকৃতির আদায়ের লড়াইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতোই ভারতেরও কিছু কর্তব্য আছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমাদের বিদেশ নীতির গোড়ার কথা প্রতিবেশী প্রথম। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ভূমিকা পালন করেছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, আজ কূটনৈতিক অঙ্গনে সেই তৎপরতা জারি রেখে নরেন্দ্র মোদিও একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের কাজে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবেন এটা প্রত্যাশিত। সেই সঙ্গে দুই দেশের শিক্ষাঙ্গন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম ও সুশীল সমাজের যৌথ প্রয়াস জরুরি। তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে আরও কোণঠাসা করা সম্ভব। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বারবার বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। কিন্তু সেনাবাহিনীর ভয়ে গণহত্যার নিন্দা করেননি কোনো শাসক।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর