বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

দিল্লির চিঠি : বঙ্গে কি বিজেপির পদ্ম ফুটবে?

জয়ন্ত রায়চৌধুরী

দিল্লির চিঠি : বঙ্গে কি বিজেপির পদ্ম ফুটবে?

শোন নদীর পূর্বদিকে মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত যে রাজ্যগুলোর বিস্তার, সেই রাজ্যগুলোর মোট ১২২টি লোকসভা আসন বিজেপির বর্তমান হিসাব-নিকাশের মূল লক্ষ্য। এটিই বিজেপির ‘পূর্বাঞ্চলে অপারেশন লোটাস’- যা সম্ভবত হয়ে উঠেছে উত্তর ভারতের হিন্দি বলয় এবং পশ্চিম-ভারতে আরএসএসের খাসতালুকের বাইরে দলটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রচারাভিযান।

বিজেপির পূর্বসূরি জনসংঘের দলটির প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। ৫৪৪টি আসনের ভারতীয় লোকসভায় এ রাজ্যের আসন সংখ্যা ৪২। পূর্ব ভারত এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গকে দক্ষিণপন্থি দলটি এবং তার তাত্ত্বিক নেতারা বরাবরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর এবং নতুন সমর্থক জোগাড় করার পক্ষে উর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচনা করে এসেছেন।

ফলে প্রতিটি জাতীয় ও রাজ্য স্তরের নির্বাচনে এই অঞ্চলটির জন্য ভারতীয় জনতা পার্টি সুচিন্তিতভাবে নিজেদের রণকৌশল সাজিয়েছে। জুটিয়ে নিয়েছে আঞ্চলিক স্তরের জোটসঙ্গী এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিশেষ করে এমন অনেককে যাদের পূর্ব-ইতিহাস সুবিধার নয়। দলটির পিতৃপ্রতিম কেন্দ্রীয় সংগঠন আরএসএসকে অনেক সময়েই পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর প্রান্তিক গ্রামাঞ্চল ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় সামাজিক সংগঠন বিস্তার ও শিশুশিক্ষার মতো দীর্ঘমেয়াদি ও পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ অঞ্চলে সাংগঠনিক শক্তি ও আর্থিক নিরিখে বিপুল উদ্যম ব্যয় করার পর যে ফলাফল দেখা গিয়েছিল, তা গেরুয়া শিবিরের কাছে নিঃসন্দেহে সুসংবাদ হয়ে এসেছিল। এই নির্বাচনে বিজেপি তার নিজস্ব শক্তিতে জয় করে নিয়েছিল এ অঞ্চলের ৬৪টি আসন, অর্থাৎ পূর্ব ভারতের মোট নির্বাচনি কেন্দ্রের অর্ধেকের সামান্য বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গে তারা পেয়েছিল ১৮টি আসন। অর্থাৎ রাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ আসন।

বিহারে জেডি(ইউ)-এর মতো জোটসঙ্গী কিংবা ওড়িশায় বিজেডির মতো ‘দোস্তি-কুস্তি’র বন্ধুদের নিয়ে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া পূর্ব ভারতের সবকটি রাজ্যে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তাদের সেই বিজয় অভিযানের গোলাপঝাড়ে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস। তবে এ কথাও সত্য, গত সাধারণ নির্বাচনে রবিঠাকুরের রাজ্যে বিজেপি তাদের আসন সংখ্যা এক ধাক্কায় নয় গুণ বাড়িয়ে দুই থেকে পৌঁছে গিয়েছিল আঠারোয়। ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে অবশ্য নির্বাচনি ফলাফলের নিরিখে পূর্ব ভারতের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারে গেরুয়া ঝড়ের গতি থিতিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও ২০২৪-এর পরিস্থিতি বিজেপি নেতৃত্বের চোখে আরও বেশি উর্বর।

দোলাচলের পথে বাংলা

পশ্চিমবঙ্গে এখনো পর্যন্ত গৈরিক দলটি সেরা কৃতিত্ব দিয়েছে ২০১৯-এ। সেবারের নির্বাচনে তারা ৪০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিল, যা ২০১৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের চার গুণ। সে বছর পশ্চিমবঙ্গে এহেন গেরুয়া ঝড়ের মধ্যেও অবশ্য রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ভোটব্যাংক মোটের ওপর অক্ষত রাখতে পেরেছিল। ২০১৯-এর নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪ শতাংশ ভোট, অর্থাৎ তাদের হাতছাড়া হয়েছিল মাত্র দেড় শতাংশ ভোট।

সেবার মূলত ধস নেমেছিল কংগ্রেস ও বাম শিবিরের ভোটব্যাংকে। ২০১৬-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বাম শিবির ও কংগ্রেস পেয়েছিল যথাক্রমে ২৭ শতাংশ ও ১২.৫ শতাংশ ভোট; ২০১৯-এর নির্বাচনে তা হয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭ শতাংশ ও ৬ শতাংশ। অনেকের ধারণা, ২০১৯-এ সিপিআই(এম) সমর্থকদের মধ্যে চুপিসারে একটি প্রচারের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিল-যার মোদ্দা কথা, ‘চুপচাপ পদ্মফুলে ছাপ’। আর তার জেরেই সে বছরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটিতে বামশিবিরের বিপুলসংখ্যক ভোট গিয়েছিল বিজেপির ভোটবাক্সে।

২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বামশিবির জোটসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় জনৈক কট্টরপন্থি ‘পীরজাদা’র হাতেগড়া পার্টিকে। এই পদক্ষেপটির জেরে তাদের ভোটাররা বাম দলগুলো থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মাথায় রাখতে হবে, এই বাম ভোটারের বড় একটা অংশ ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এ রাজ্যে আগত উদ্বাস্তু, কিংবা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম। গত বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময় এই অসন্তুষ্ট বাম সমর্থকরা তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে বাছাই করেছিলেন; আর তার ফলে বাম ভোটের একটা বড় অংশ গিয়েছিল তৃণমূলের ঝুলিতে।

মেরুকরণের এই বিশেষ ঝোঁকটির ফলে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি বিপুল জয় পেয়েছিলেন। তাঁর দল পেয়েছিল নজিরবিহীন ২১৩টি আসন, আর বিজেপির ভাগ্যে জুটেছিল ৭৭টি আসন। এ রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘দিদি, দিদি’ জাতীয় টিটকিরি কিংবা তাঁর পার্টির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগসহ বিজেপির চড়া দাগের প্রচার গেরুয়া শিবিরকে আদপেই বিশেষ সুফল দেয়নি।

২০২১-এর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাম শিবির কিছুটা সক্রিয়তা দেখিয়েছে এবং হারানো জমি পুনরুদ্ধারের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে মূলত তাদের তরুণ ব্রিগেড। বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে মর্যাদার লড়াইসহ একাধিক উপনির্বাচন ও পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল থেকে বামশিবির এবং সিপিআই(এম) দলের লড়াইয়ে ফিরে আসার ইঙ্গিত মিলেছে।

এ রাজ্যে বিজেপির ভোটের হার ক্রমশ নিম্নমুখী-২০১৯-এর ৪০ শতাংশ ভোট ২০২১-এ হয়ে দাঁড়ায় ৩৮.৫ শতাংশ, আর ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটে তা নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে। অন্যদিকে ২০২১-এর তুলনায় বামেদের ভোটের হার বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আর বিজেপির তুল্যমূল্য মেরুকরণের হিসাব আর কাজ করছে না এবং বামেদের অনুগত ভোটাররা আবার আপন ঘরে ফিরে আসছে।

সন্দেশখালির অভিঘাত

সম্ভবত সে কারণেও বিজেপি সম্প্রতি আবার তাদের দুর্নীতিবিরোধী চড়া দাগের প্রচারের ওপর স্থান দিচ্ছে মূলত দুটি ইস্যুকে- নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) আর সন্দেশখালি। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা সন্দেশখালি দ্বীপে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতদের বিরুদ্ধে মহিলাদের শ্লীলতাহানি করার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই দুষ্কৃতদের পাখির চোখ, মাছচাষের লাভজনক উদ্যোগের জন্য এলাকার কৃষিজমি দখল। অন্যদিকে আশা করা হচ্ছে, সিএএ লাগু করার পদক্ষেপটির ফলে সবচেয়ে লাভবান হবে এ রাজ্যের মতুয়া সম্প্রদায়। মূলত বাংলাদেশের সীমান্ত-লাগোয়া দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে প্রায় তিরিশ লাখের মতো মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। এই সম্প্রদায়ের মানুষ বহু বছর ধরে তাঁদের বাসভূমি পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে আসছেন। তাঁদের সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদের বাস পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন চব্বিশ পরগনা বা বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়। আর সেই ধর্মীয় টানেই মতুয়াদের এই দীর্ঘমেয়াদি পরিযান। আশা করা যায়, সন্দেশখালির ঘটনাও এ রাজ্যের ভোটারদের ওপর এবং বিশেষ করে প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলের ভোটারের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। এমনটা ভাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এ রাজ্যের ভাগচাষিরা স্থায়ীভাবে জমির অধিকার পেয়েছিল। আবার সেই সময়েই নকশালবাড়ি আন্দোলনের জেরে ভেঙে পড়েছিল মোটের ওপর শান্তিপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা। তারপর থেকে গ্রামাঞ্চলে মানুষের নিরাপত্তা ও জমির অধিকার- এ রাজ্যের রাজনীতিতে দুটি গোলমেলে ইস্যু।

তবে এসব সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতা হলো- এ রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির তুমুল জনপ্রিয়তা এখনো অটুট। তাই রাজ্যের অনেক ভোটারই তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার ধরাবাঁধা বিকল্পটি আপনা থেকেই বেছে নেবেন।

অন্য একটি বিষয়ও তৃণমূলের পক্ষে যাবে। তারা ইন্ডিয়া জোটের কোনো দলের সঙ্গে আসন সমঝোতায় যায়নি। ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে বর্তমানে নির্বাচনি মেরুকরণের ঝোঁকটি যেমন মোদিপন্থি আর মোদিবিরোধী ভোটের মধ্যে, ঠিক সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে মেরুকরণের ঝোঁকটি মমতাপন্থি আর মমতাবিরোধী ভোটের দিকে। কাজেই ত্রিমুখী নির্বাচনি লড়াই হলে মমতাবিরোধী ভোট বিজেপি আর বামশিবিরের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাবে। তার ফলে বহু নির্বাচনি কেন্দ্রে এগিয়ে থাকবে তৃণমূলই।

পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা-জর্জরিত দশা নিয়ে এ রাজ্যের ভোটারদের মনে ক্ষোভ যথেষ্ট। তাই ২০২৪-এর নির্বাচনে এ বঙ্গে বিজেপির আসন সংখ্যা যদি না-ও বাড়ে, তাদের ভোটের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা ষোলো আনা। তবে তা সত্ত্বেও এ রাজ্য এখনো মমতা ব্যানার্জির নিজস্ব গড় এবং খুব সম্ভবত তা তাঁর দখলেই থেকে যাবে অন্তত বর্তমান পরিস্থিতিতে তো বটেই।

লেখক : প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার সাবেক   রেসিডেন্ট এডিটর (পূর্ব ভারত)

সর্বশেষ খবর