শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

জীবনবিনাশী কবিরা গুনাহ

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

আফসোস এ যুগের মানুষের প্রতি! আগের দিনে দেখা যেত, শেষ রাতে মসজিদ-মাদরাসাগুলোতে নামাজ, জিকির, তেলাওয়াতের জান্নাতি পরিবেশ। ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জিকির ও তেলাওয়াতের কারণে মহল্লার একদল মানুষ শেষ রাতে মসজিদে এসে তাদের সঙ্গে নামাজ, জিকির-আসকার ও তেলাওয়াত করত। এভাবে মুসল্লিদের দ্বারা সর্বদা মসজিদ আবাদ থাকত। হাদিস শরিফে এসেছে, এমন এক যুগ আসবে যখন বিশাল আকৃতির মিনারবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন বড় বড় মসজিদ হবে, তাতে সৌন্দর্যের কোনো কমতি থাকবে না, ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমের জন্য সব সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে, মুসল্লিদের মাঝে হাদিয়া দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে, দীনি জ্ঞানহীন সাধারণ মানুষ কমিটির লোক হয়ে মসজিদ-মাদরাসায় এসে মিটিং করবে, মাতুব্বরি করবে, উল্টাপাল্টা ফতুয়া দেবে, কিন্তু নামাজের সময় হলে নামাজ পড়বে না। তাদের এসব ব্যাপার ইমাম, মুয়াজ্জিন ও এলাকার আহলে ইলমগণ মেনে নেবে। কারণ, তাদের পয়সার দ্বারাই তো মসজিদ-মাদরাসা চালাতে হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, এগুলো কেয়ামতের আলামত এবং এসব কাজের জন্য উভয় দলই জাহান্নামে যাবে। যে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন ইমামতি করার জন্য, মাদরাসায় পড়ানোর জন্য সে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে মাত্র কয়েক হাজার টাকার জন্য সত্যকে গোপন রাখা, মানুষের ভুলভ্রান্তি সংশোধনের জন্য জোরালো কথা ও কাজের মাধ্যমে চেষ্টা না করা জঘন্য অন্যায়। আফসোস, আমাদের সমাজের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের অবস্থা দেখলে বোঝা যায়, তাদের মর্যাদার দিকটি সমাজে আজ অবহেলিত। তার কারণ হলো, তারা শুধু পয়সার পেছনে ঘুরে নিজের সম্মানকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। বাসাবাড়িতে ঘুরে ঘুরে, পর্দার খেলাপ করে, পরনারীকে আপা-খালাম্মা বলে বলে প্রাইভেট পড়াচ্ছে, টেলিভিশন দেখছে। এসব কাজ কি ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সম্মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবরা যদি এমন সব কাজ করে বেড়ান, তাহলে মুসল্লিদের অবস্থা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা যে কেউ সহজে বুঝতে পারে। ইমাম-মুয়াজ্জিনদের চলাফেরা তো এমন হওয়া উচিত যাতে তাদের পুরুষরা দেখলে সম্মানের সঙ্গে সালাম দেয়, মহিলারা পর্দার ভিতরে চলে যায়।

আসলে হিম্মত করলে আল্লাহপাক সব কাজই সহজ করে দেন। আমার হিম্মতের দু-একটি ঘটনা আজ আপনাদের শোনাই। এর দ্বারা অহংকার প্রকাশ উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হলো, আপনাদের মাঝেও যেন এমন হিম্মত পয়দা হয়। তবে হিম্মত করতে হবে চিন্তা-ভাবনা করে, স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী। ১. আমার গাড়ির ড্রাইভার এক দিন আমাকে শোনাল, ঢাকার টিকাটুলীর সালাহউদ্দিন আস্শিফা হাসপাতালের নার্সরা একদিন বলেছিল, ‘আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব এলে সব সেবিকাদের বোরকা পরতে হয়, কিংবা টয়লেটে প্রবেশ করতে হয়। তিনি অসুস্থ হলে কী করবেন? ২. আমি একবার অসুস্থ হয়ে ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। পাঁচ-সাত দিন সেখানে থাকতে হয়েছিল। এ সময় সব ডাক্তার ও কর্মকর্তারা মিটিং করে বলে দিয়েছিল, হুজুরের কাছে দ্বিতীয় তলাতে মহিলা ডাক্তারের যাওয়া নিষেধ। এক ত্রুটি দেখে সেখানেও ধমকিয়ে ছিলাম।

৩. আমি যখন সর্বপ্রথম আমেরিকাতে গিয়েছিলাম তখন সেখানের বড় বড় আলেমরা বললেন, আমার শরীর চেকআপ করানোর জন্য; আমি তাতে রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ হলো, বিদেশে গিয়ে শরীর চেকআপ করাটা এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। তাছাড়া আমার শরীরে তেমন কোনো সমস্যাও ছিল না যে, চেকআপ করানোর দরকার হবে। আবার টাকাও বেশি লাগে। যা হোক তাদের পীড়াপীড়ির কাছে হার মানতে হলো। তারা আমাকে নিয়ে গেল নামিদামি এক বড় হাসপাতালে। চেকআপ রুমে প্রবেশ করলাম। শরীরে বহু মেশিন বসানো হলো পরীক্ষার জন্য। ডাক্তাররা মেশিন বসিয়ে চলে গেল। হঠাৎ দেখি ২০-২৫ বছর বয়সী এক মহিলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে পরীক্ষার বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য। আমার রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রচন্ড আওয়াজে ধমক দিলাম এবং শরীর নাড়া দিয়ে উঠে বসে পড়লাম। এদিকে লাখ টাকা দামের মেশিন ছিটকে পড়ে ভেঙে গেল। এমতাবস্থায় দৌড়ে একজন ডাক্তার এসে আমার পায়ে পড়ে কী যেন ইংরেজিতে বলছিল, আমি বুঝতে পারছিলাম না। সংবাদ পেয়ে আমার আলেম সাথী ভায়েরা এসে বলতে লাগল, হুজুর! কোনো সমস্যা হয়েছি নাকি? আমি বললাম, তোমরা আলেম মানুষ হয়ে বোঝ না? সমস্যা না হলে কি আমি এমন করতাম? তারা ডাক্তারদের বলল, তিনি আমাদের ধর্মগুরু। ডাক্তার বলল, ওনাকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে বলুন, এখনই আমাদের প্রধান পুরুষ ডাক্তার এসে পরীক্ষা করবেন।

আজ আমাদের হিম্মতের বড়ই অভাব। কারও হিম্মত থাকলেও এখলাস নেই। তাই সফলতা দেখা দেয় না। ইমাম-মুয়াজ্জিন এমনকি মাদরাসার অনেক হুজুরও বাসাবাড়িতে গিয়ে মহিলার সঙ্গে পড়ানোর নামে মজার মজার আলাপ করছে। এগুলো যে গুনাহে কবিরা তা তাদের বোধ থেকে সরে যাচ্ছে। যে ব্যক্তি বারবার গুনাহে কবিরা করে তার পেছনে নামাজ পড়া মাকরুহে তাহরিমি। যাকে দেখা হারাম, তাকে দেখলে সেটা হবে চোখের কবিরা গুনাহ, মুখে মিথ্যা কথা বললে, কুটনামি করলে, অপবাদ দিলে, গালিগালাজ করলে সেটি হবে মুখের কবিরা গুনাহ। কানে গিবত, গান, অশ্লীল কথা শোনা কানের কবিরা গুনাহ। নিষিদ্ধ বস্তু ধরা, মানুষকে আঘাত করা, মাল-সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া এগুলো হাতের কবিরা গুনাহ। হেঁটে খারাপ জায়গায় যাওয়া পায়ের কবিরা গুনাহ। কবিরা গুনাহ জীবনবিনাশী গুনাহ। খাঁটি দিলে তওবা না করলে এরকম একটি কবিরা গুনাহই জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।

হলেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

 

 

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর