শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমার মায়ের আঁচলখানি

ইমদাদুল হক মিলন

আমার মায়ের আঁচলখানি

গত বিশ-পঁচিশ বছরে চার পর্বের আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখেছি আমি। ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’, ‘জিন্দাবাহার’, ‘মায়ানগর’, ‘একাত্তর ও একজন মা’। চার পর্বের একত্র সংকলন ‘এমন জনম’। ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে বেরিয়েছে। এই চার পর্বজুড়েই রয়েছে আমার মায়ের কথা। আব্বা ও নানির কথা। পুনুখালা ও অন্য প্রিয়জনদের কথা। মায়ের কথা অনেকখানি লেখা হয়েছে ‘একাত্তর ও একজন মা’ উপন্যাসে। আব্বা মারা গেলেন ৭ অক্টোবর ১৯৭১। দশটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তারপর শুরু হয়েছিল আমার মায়ের ভয়াবহ এক যুদ্ধ। আব্বার মৃত্যুর ঘটনা বিস্তারিত আছে এই উপন্যাসে। আব্বার মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয়। হত্যাকান্ড। একটু অন্যরকমভাবে আমার আব্বাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল।

আমি আমার মায়ের কথা বলি। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে আমার মা। আমরা সব ভাইবোন তার পাশে। মা শুয়ে আছে একটা খাটে। একটু যেন জোরে কথা বলছে। একটু যেন বেশি শব্দ করে ছেলেমেয়েদের বলছে, ‘আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা সবাই সবাইকে দেখে রেখো। কেউ কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্য কোরো না।’

মা’র একপাশে দাঁড়িয়ে আমি আকুল হয়ে কাঁদছি। এক সময় আমার দিকে তাকাল মা। অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। আমি হাঁটু গেড়ে মা’র সামনে বসলাম। মা’র কপালে, মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। চোখের জলে চোখ ভেসে যাচ্ছে আমার। গাল ভেসে যাচ্ছে। বুকফাটা কান্নায় আমি শুধু বলছি, ‘মা মাগো, আমার মা। আমার মা।’

মা তার শীর্ণ হাত বাড়িয়ে আমার একটা হাত ধরল। ‘কেঁদো না বাবা, কেঁদো না। এমন সময় তো একদিন আসবেই। মরতে তো একদিন হবেই।’ আমি আর কথা বলতে পারি না। আমি কাঁদি। আমি শুধু কাঁদি। এক সময় টের পাই আমি কাঁদছি ঘুমঘোরে। চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। আমি আসলে স্বপ্ন দেখে কাঁদছি। আমার ঘুম এমনিতেই খুব পাতলা। তার ওপর একবার ভাঙলে সহজে আর আসতে চায় না। সে রাতেও আর ঘুম এলো না। বাকি রাত জেগে থাকলাম। শুধুই মায়ের কথা মনে পড়ল। মাকে নিয়ে কত স্মৃতি। কত দুঃখ বেদনা আনন্দের কথা। তবে দুঃখের কথাই বেশি। কারণ আমার মা বলতে গেলে সারাটা জীবন শুধু কষ্ট করেই গেছে। সুখ যেটুকু পাওয়ার পেয়েছিল তার বাবার সংসারে। অতি সচ্ছল, বিশাল এক পিতার সংসারে জন্মেছিল। জায়গা সম্পত্তি টাকা-পয়সা প্রভাব প্রতিপত্তি সব মিলিয়ে আমার নানা ছিলেন বিশাল মানুষ। বেলফাস্ট নামের ব্রিটিশ কার্গো জাহাজের সারেং ছিলেন। বছরের বেশির ভাগ সময় থাকতেন কলকাতায় আর নদী সমুদ্রে। কখনো কখনো নারায়ণগঞ্জ বন্দরে এসেও নোঙর করত তাঁর কার্গো। নানার ছিল দুই বিয়ে। প্রথম স্ত্রী এক মেয়ে রেখে মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমার নানি ছিলেন বিক্রমপুরের কুমারভোগ গ্রামের গরিব কিন্তু শিক্ষিত বনেদি পরিবারের মেয়ে। আমার নানাবাড়ি মেদিনীমন্ডল গ্রামে। দুই গ্রামের মাঝখানে মাইলখানেকের দূরত্ব। আমার নানা ছিলেন মুঘল সম্রাটদের মতো ফর্সা সুন্দর এবং বিশালদেহী। নানার আদল পেয়েছিলেন আমার মা। মা হচ্ছেন নানার দ্বিতীয় ঘরের বড় মেয়ে। অনেক ছেলেমেয়ে হয়েছিল আমার নানির। আমরা তাকে ডাকতাম ‘বুজি’। বুজির ছেলেমেয়ে বাঁচত না। এগারো বারোটি সন্তানের মধ্যে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকল আমার মা আর পুনুখালা। টগর নামে একজন মামা ছিল আমার। সাত আট বছর বয়সে সেও মারা যায়। মেদিনীমন্ডল গ্রামে আমার নানাবাড়ির দক্ষিণ দিককার বাগানের পশ্চিম দিককার কয়েকটি আমগাছতলায় আমার নানা আর টগর মামার কবর।

মা ছিল নানার নয়নের মণি। কী যে ভালো মেয়েকে তিনি বাসতেন বলে বোঝানো মুশকিল। শুধু একটি ঘটনার কথা বলি। একবার বর্ষাকালে আমার মায়ের খুব কমলা খাওয়ার শখ হলো। কলকাতায় নানাকে চিঠি লিখে সে কথা জানানো হলো। কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ি এলেন নানা। তখন কলকাতা থেকে বিক্রমপুরে আসার ব্যবস্থা স্টিমার। গোয়ালন্দ হয়ে স্টিমার এসে নামত ভাগ্যকূল কিংবা লৌহজংয়ে। নানা এসে নামলেন ভাগ্যকূলে। বিশাল একখানা কেরায়া নৌকা নিয়ে ধানি বিলের ওপর দিয়ে সাত আট মাইল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে বাড়ি এলেন। সঙ্গে ব্যাগ সুটকেসের সঙ্গে অনেকগুলো বস্তা। মাঝিরা বস্তাগুলো এনে তুললেন বাড়ির উঠোনে। আমার মাকে ডাকলেন। ‘আনু, আমার কাছে আসো মা’। আমার মায়ের নাম আনোয়ারা বেগম। নানাবাড়ির সবাই তাকে ডাকত আনু। নানার ডাক শুনে মা গেলেন তাঁর কাছে। নানা তখন মা’র হাত ধরে উঠোনে গেলেন। হাতলঅলা চেয়ার নিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসলেন। মেয়েকে দাঁড় করালেন কোলের কাছে। বাড়ির কাজের লোকদের বললেন বস্তাগুলো খুলতে। পাঁচখানা বস্তা। সবগুলোই খোলা হলো। দেখা গেল বস্তাভর্তি কমলা আর কমলা। পাঁচ বস্তা কমলাই উঠোনে ঢালা হলো। উঠোন প্রায় ভরে গেল। মা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইলেন। বাড়ির লোকজন হতভম্ব। এত কমলা একসঙ্গে জীবনে কেউ দেখেনি। নানা বললেন, ‘মাগো, তুমি কমলা খেতে চেয়েছিলে এজন্য তোমার জন্য কমলা নিয়ে এসেছি। খাও। যত ইচ্ছা কমলা খাও মা।’

বিয়ের পর এই সুখের জীবন আমার মায়ের থাকেনি। আব্বা ছিলেন মোটামুটি সচ্ছল গেরস্তঘরের ছেলে। লৌহজং থানার ‘পয়সা’ গ্রামে জন্ম। দেড় বছর বয়সে মা হারান। সাত আট বছরের বড় এক ভাই ছিল। এই দুই ছেলে নিয়ে দাদা আবার বিয়ে করেন তাঁর এক আত্মীয়াকে। আমার সেই দাদি আগের স্বামীর একটি ছেলের হাত ধরে দাদার সংসারে আসেন। এই ঘরে তাঁর একটি মেয়ে হয়, একটি ছেলে জন্মায়। পয়সা হাইস্কুলে আব্বা যখন ক্লাস এইটে পড়েন তখন দাদা মারা গেলেন। বড় ভাইটি মারা গেছে তারও আগে। সৎমায়ের সংসারে আব্বা থাকেননি। তিনি থাকতেন তার এক চাচাতো চাচার কাছে। একই গ্রামে, একটু দূরে বাড়ি। সেই বাড়িতে থেকে কলকাতায় গিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিট পড়ত কলকাতায়। দেশ ভাগ হয়নি। চাচার সংসারে থেকেও বাবা ছিলেন সর্বান্তকরণে একা, এতিম। নানার মৃত্যুর পর মেয়ের জন্য এরকম পাত্রই খুঁজছিলেন আমার নানি। নানা অনেক জায়গা সম্পত্তি রেখে গেছেন। নিজের কোনো ছেলে নেই। দুটো মাত্র মেয়ে। বড় মেয়ের জন্য ঘরজামাই ধরনের পাত্র পেলে ভালো। আব্বা তখন ম্যাট্রিক সেকেন্ড ডিভিশন পাস করে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে কেরানিগিরির চাকরিতে ঢুকেছেন। চাকরির ব্যবস্থা করেছেন তাঁর ওই চাচা। কারণ তিনি নিজেও ওখানে চাকরি করতেন। লক্ষ্মীবাজারে মিউনিসিপ্যাল কমিটি সদ্য হয়েছে। লম্বা মতন একটা টিনের ঘরে পুরো অফিস। আমরা তখন একে একে ভাইবোনরা জন্মাচ্ছি। ঢাকার জিন্দাবাহারে থার্ড লেনে অনেক ভাড়াটেদের সঙ্গে একরুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন আব্বা। এতগুলো ছেলেমেয়ে সামলাতে পারে না মা। ফলে আমি আমার বড়ভাই আর কখনো কখনো বড় বোনটা গ্রামে গিয়ে নানির কাছে থাকি। ওদিকে আব্বার যা বেতন তাতে সংসার ঠিকমতো চলে না। পুনুখালাকে নিয়েও একটা ঝামেলা হয়েছে। তাঁর মেয়ে রিনা জন্মের পর স্বামীর সঙ্গে সেপারেশন হয়ে গেছে। সেই ভদ্রলোক ঢাকার সৈয়দপুরের ওদিকে আরেকটি বিয়ে করেছেন। ফলে পুনুখালাও আমাদের সংসারে। তখনো বছর বছর একটি করে ভাইবোন জন্মাছে আমাদের। গ্রামে আছেন নানি। সব মিলিয়ে আব্বার রোজগারে সংসার চলে না। আমার নানি তখন একটার পর একটা জমি বিক্রি করতে শুরু করলেন। আব্বার রোজগারের টাকা আর নানার জমি বিক্রির টাকায় সংসার চলে। আর এসব সামলাতে আমার মা দিন দিন ম্লান হচ্ছে। আমার মা অসাধারণ সুন্দর ছিল এক সময়। চেহারায় প্যাটার্ন ছিল কিছুটা ওয়াহিদা রহমান কিছুটা রাখি গুলজার ধরনের। দুধে আলতা মিশানো বলতে যা বোঝায় গায়ের রং ঠিক তেমন। মাথাভর্তি লম্বা ঘন চুল। মাঝারি আকৃতির শরীর না মোটা, না রোগা। সবমিলিয়ে চোখ ভরে থাকার মতো মানুষ। এগারোটি ভাইবোন জন্মালাম আমরা তবু মা’র সৌন্দর্য ম্লান হচ্ছিল না। নিজের বাবার সংসারের রাজকীয় জীবনযাপন করে এসে গরিব কেরানির সংসার। এতগুলো ছেলেমেয়ে। অভাব অনটন। তবু একটা সময় পর্যন্ত মা ভালোই ছিল। একহাতে এতবড় সংসার সবদিক ঠিক রেখে কী সুন্দরভাবে যে চালিয়ে যাচ্ছিল!

আব্বা যখন মারা গেলেন বড়ভাই তখন জগন্নাথ কলেজে নাইট শিফটে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে আর দিনেরবেলা টঙ্গীতে একটা চাকরি করে। এসবের বছরখানেক আগ থেকে আব্বাকে সাহায্য করার জন্য আমরা দুভাই অনেকগুলো করে টিউশনি করতাম। খুবই গরিব টিউশনি। দশ বিশ টাকার বেশি বেতন পাওয়া যেত না। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঘরে একটি পয়সা নেই। মাস গেলে চারশো টাকা বাড়িভাড়া। এতগুলো ছেলেমেয়ের পড়াশোনা। আমাদের পাশে দাঁড়াবার মানুষ নেই। দশটি নগদ টাকাও রেখে যেতে পারেননি বাবা। আমার মা একেবারে দিশাহারা হয়ে গেল। দেশ আছে তখন মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে। মিউনিসিপ্যালিটিতে আব্বার প্রভিডেন্ট ফান্ডের কিছু টাকা ছিল। গ্র্যাচিউয়িটির সামান্য টাকা ছিল। সেই টাকা তোলার জন্য কোর্ট থেকে একটা সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করা দরকার। সেই কাজটা কে করবে? আমরা তো কিছু বুঝিই না। মা’র প্রকৃত যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল তখন থেকে। আমার মায়ের মামাতো বোনের স্বামী দায়িত্ব নিলেন সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করার। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে দেশ স্বাধীন হলো। নতুন দেশ। সব কিছুই নতুন করে শুরু হচ্ছে। ওই সার্টিফিকেট হাতে পেতে বছর দেড়েক লাগল। সেই দেড়টা বছর প্রায়ই কোর্টে যেতে হতো মা’কে। আমার ছোটভাই খোকন তখন একেবারেই ছোট। ছ-সাত বছর বয়স হবে। খোকনকে নিয়ে গেন্ডারিয়া থেকে হেঁটে লক্ষ্মীবাজারের ওদিক দিয়ে কোর্টে গিয়ে বসে থাকতেন মা। রিকশা করে যাওয়ার সাধ্য ছিল না। পয়সা পাবে কোথায়? এ অবস্থায় একদিন খোকন আবার কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল।

মা’র এই যুদ্ধটা চলেছে অনেকদিন। তিয়াত্তরের শুরুতে মিউনিসিপ্যালিটিতে বড় ভাইয়ের চাকরি হলো। আব্বার জায়গায় তাকে নেওয়া হলো। আব্বার প্রভিডেন্ট ফান্ড গ্র্যাচিউয়িটির সামান্য কিছু টাকাও পাওয়া গেল। সেই টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা আবার মেরে দিল আমাদের এক টাউট মামা। ব্যবসার কথা বলে টাকাটা সে নিয়েছিল, মাসে মাসে আমাদের কিছু লাভ দেবে বলে। একপর্যায়ে পুরোটা সে নিজেই খেয়ে ফেলল।

তারপর থেকে দিন ফিরতে শুরু করেছিল আমাদের। মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরিতে ঢুকে বুদ্ধি করে আমার নামে একটি কন্ট্রাক্টরির লাইসেন্স বের করল বড় ভাই। ‘মিলন ট্রেডিং কোম্পানী’। আমি তখন জগন্নাথে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। পড়ি সায়েন্স। ওই বয়সে যা হয়, চোখভরা অনেক স্বপ্ন। এক ফাঁকে লেখক হওয়ার চেষ্টা করছি। বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত ‘শুভেচ্ছা’ নামের একটি সিনেমা মাসিকের বিজ্ঞাপন প্রতিনিধির কাজ করছি। সস্তা একটি ব্রিফকেস হাতে অনেকদিন বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য বায়তুল মোকাররমের বিভিন্ন দোকানে ছুটেছি। ফাঁকে ফাঁকে লেখা। এদিক ওদিক অবিরাম ছাপা হচ্ছে গল্প। আমার বন্ধু কামাল এবং মুকুলের সঙ্গে ওয়াইজঘাটের বুলবুল একাডেমিতে কয়েক মাস রবীন্দ্রসংগীতও শেখার চেষ্টা করলাম। তারপর শুরু হলো মিউনিসিপ্যালিটিতে কন্ট্রাক্টরি। রাস্তাঘাট মেরামতের ছোট ছোট কাজ করি। ওস্তাগার লেবারদের সঙ্গে কাজ। রোড ইন্সপেক্টর ওভারসিয়ার এসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিনিয়ারদের স্যার স্যার করি। আস্তে আস্তে দিন ঘুরতে লাগল। অবস্থা যখন বেশ ভালোর দিকে তখন সব কিছু চলে গেল বড়ভাইর হাতে। আমি নিজের জীবন বদলাতে, আমার বোন মণির জীবন বদলাতে চলে গেলাম জার্মানিতে। মণির কিছুটা গোপনেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। দুলাভাই চলে গিয়েছিলেন জার্মানিতে। মায়ের কথা বলতে গিয়ে এসব ইতিহাস লেখার কিছুটা দরকার। এই যে এতগুলো দিন, আব্বা বেঁচে থাকার অনেকদিন আগ থেকে যুদ্ধটা যে মা শুরু করেছিল, তারপর আব্বার মৃত্যু, আমাদের উঠে দাঁড়াবার সময়, একে একে প্রতিটি ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত হওয়া, বোনদের বিয়ে, সবার বড় মণি এবং সবার ছোটবোন আসমা থাকে আমেরিকাতে। একজন নিউইয়র্কে একজন লসঅ্যাঞ্জেলেসে। ছোটভাই খোকন পনেরো বছর আমেরিকায় থেকে দেশে ফিরল। বড়ভাই ভালোই অবস্থাপন্ন। শুধু একটা দুঃখজনক ঘটনা এর মধ্যে ঘটে গেল। আমার পিঠাপিঠি ভাই বাদল মারা গেল। সবমিলিয়ে সময় আমাদের একটা ভালো জায়গায় এনে দাঁড় করালো। পেছনে একক অবদান আমার মায়ের। বহু বহু বছরে আমার মাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি। অসুস্থ হতে দেখিনি। জ্বরজ্বারি সর্দি কাশি কিচ্ছু না। যন্ত্রের মতো প্রতিটি সকালে জীবন শুরু করেছে আমার মা। দুপুরবেলা আধাঘণ্টাও শুয়ে থাকেনি কোনো দিন। একটানা রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত সংসারের কাজ। মায়েদের জীবন হচ্ছে পাখির মতো। পাখি যেমন ডিম পেড়ে, ডানার আড়ালে ছানাদের রেখে বড় করে, তারপর উড়তে শিখে ছানারা যে যার মতো নিজের আকাশে উড়াল দেয়, আমরাও মায়ের সংসার ভেঙে সেভাবে একদিন উড়াল দিলাম। মাকে প্রথম ভাঙতে দেখলাম বড় ভাই আলাদা সংসারে চলে যাওয়ার পর। তবে আশ্চর্য ঘটনা হলো আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমার মাকে দেখছিলাম আস্তে আস্তে নিস্তেজ হচ্ছে। প্রথমে বসে পড়ল। হাঁটাচলা কমে এলো। তারপর শুয়ে পড়ল। এরপর আরেক শোকের ঘটনা ঘটে গেল মায়ের জীবনে। বাদল মারা গেল। আরও ভাঙতে শুরু করল মা। পুরোপুরিই বিছানা নিয়ে নিল। উঠে দাঁড়াতে পারে না। বসতে পারে না। খেতে পারে না। একরাতে প্রবলভাবে কাঁপতে লাগল। আমার সেজো বোন ডলি কাঁদতে কাঁদতে ফোন করল। রাত ৩টার সময় বড়ভাই ছুটে এলো রূপনগর থেকে, খোকন ছুটে এলো মোহাম্মদপুর থেকে। আমি মনোয়ারা হাসপাতাল থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেলাম। হাসপাতালে মা কিছুতেই থাকতে চায় না। এক দুদিন পরই বাড়ি ফেরার জন্য উতলা হয়।

এই ফাঁকে একটু একটু মাথার গন্ডগোলও দেখা দিয়েছে তাঁর। বর্তমান সময় এবং অতীতকালের স্মৃতি একাকার করে ফেলে। কখনো কখনো অবিরাম অতীতকাল নিয়ে কথা বলে যায়। কত ছোট ছোট সূক্ষ্ম ঘটনা যে বলে! মেদিনীমন্ডল গ্রামের মানুষের জন্য, আত্মীয়স্বজন এবং পড়শিদের জন্য আজীবনই প্রবল টান ছিল আমার মায়ের। আমাদের সেইসব দুঃখ এবং অভাবের দিনেও মাকে দেখেছি গ্রাম থেকে কেউ এলে নিজে না খেয়ে তাদের খাইয়েছে। কত যতেœ আশ্রয় দিয়েছে আমাদের এতগুলো মানুষের গাদাগাদি সংসারে। আর গ্রামের মানুষ কী যে ভালোবাসে আমার মাকে! গরিব মানুষরা বাসের ভাড়া জোগাড় করে, লঞ্চের ভাড়া জোগাড় চলে আসে আমার মাকে দেখতে।

মাথার ওই গন্ডগোলের জন্য দেশের বড় বড় ডাক্তাররা দেখেছেন আমার মাকে। মাঝখানে একেবারেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল মা। রাতের পর রাত ঘুমাত না। অবিরাম কথা বলত। ডলিকে ডাকত। সারাক্ষণ তার সামনে বসে থাকতে হতো কাউকে না কাউকে। নয়তো কী রকম যেন ভয় পেত। মাঝখানে তো অনেক দিন রাখতে হলো হাসপাতালে। সব কাজ বন্ধ করে আমি তখন রাত-দিন বসে থাকি মায়ের মুখোমুখি একটা চেয়ারে। কখনো কখনো রুমের অন্য বেডে। আমার সঙ্গে বসে থাকে আমার কোনো কোনো বোন, বোন জামাই। মুমূর্ষু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার তখন শুধু মনে হতো, মাকে কি আর বাড়ি ফিরিয়ে নিতে পারব? সেবার তাকে হাসপাতালে আনার কারণ ছিল, হঠাৎ করে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কিছুতেই কিছু খাওয়ানো যাচ্ছিল না। হাসপাতালে এনে টিউব দিয়ে খাওয়াতে হলো অনেকদিন। তারপর একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর বাড়ি ফিরিয়ে নিলাম। তখন কিছুটা স্বাভাবিক সে। মুখ দিয়ে খেতে পারছে। অবিরাম কথা বলাটা একেবারেই কমে গেছে। আর কোন ফাঁকে যেন কমেছে তার শরীর। মাঝে বেশ মোটা হয়েছিল। এখন আবার কী রকম যেন রোগা। এক জীবনে কত যে বদলালো আমার মা? হাসপাতালে মুমূর্ষু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যখন বসে থাকতাম, ফেলে আসা দিনের কত যে স্মৃতি আমার মনে পড়ত! একবার খুব ছেলেবেলায়, নানাবাড়িতে কী যেন কী কারণে মাকে শক্ত মাটির ছোট্ট একটা টুকরো ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আমার আনমনা মায়ের কপাল বরাবর গিয়ে লেগেছিল সেই টুকরো। মা ‘উহ’ করে শব্দ করেছিল। সেই করুণ শব্দ এখনো আমার বুকে লেগে আছে। ভয়ে আমি তারপর শেষ দুপুর পর্যন্ত বাড়ি ফিরিনি। মাঠে মাঠে ঘুরে বেরিয়েছি। খিদে সহ্য করতে না পেরে যখন বাড়ি ফিরেছি, দেখি আমার মা মাত্র নামাজ পড়া শেষ করেছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে ডাকল। কাছে যেতেই দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে গভীর মায়াবি গলায় বলল, ‘আমি তো জানিই তুই ইচ্ছে করে মারিসনি। হয়তো অন্য কোনো দিকে ছুড়েছিলি আমার কপালে এসে লেগেছে। চল ভাত খেতে চল।’ আমি তখন মায়ের বুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম।

যে রাতে মাকে স্বপ্ন দেখে কাঁদলাম, পরদিন ঘুম ভাঙার পর ভাবলাম আজ সকালবেলাই গেন্ডারিয়ায় গিয়ে মাকে একটু দেখে আসব। তৈরি হচ্ছি, গেন্ডারিয়ার বাড়ি থেকে ডলির ফোন এলো। গত রাতে প্রায় সারা রাত ধরেই নাকি মা আমার কথা বলেছে। মাকে ফোন দিল ডলি। জড়ানো অসংলগ্ন কণ্ঠে মা বলল, ‘বাবা, তুমি কোথায়? আসো, আমার কাছে আসো।’ আমি ছুটে গেছি মায়ের কাছে। তার কোলের কাছে গিয়ে বসেছি। মাথায় হাত দিয়েছি। অতিকষ্টে আমার মা তার শীর্ণ একটা হাত তুলে আমার গলা জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হু হু করে কাঁদতে লাগল। কী যে আকুল করা কান্না! কাঁদতে কাঁদতে বারবার জানতে চাইল আমি খেয়েছি কি না। আর কাকে যেন ডাকতে লাগল। বলতে লাগল, ‘ওকে খেতে দে। খেতে দে।’ অন্তত আট দশবার বলল। তারপর বলল, ‘আমি তো অনেকদিন তোমাকে রান্না করে খাওয়াতে পারি না বাবা। তুমি পেট ভরে খাও তো?’ ৮ ফেব্র“য়ারি ২০০৫ সালে আমার মা মারা গেলেন। তারপরও আমার মায়ের আঁচলখানির ছায়া আমার মাথার ওপর রয়ে গেছে। চিরকাল থাকবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর