রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

রমজান ও জাকাত

আফতাব চৌধুরী

রমজান ও জাকাত

রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। এক বছরে মানুষের শরীরে যে বাড়তি মেদ বা বিষাক্ত পদার্থ জমে ওঠে, রমজানের এক মাসে সারা দিন উপবাস থাকার কারণে তা পুড়ে গিয়ে শরীরকে রক্ষা করে। রমজানের রোজা মনের কুন্ডপ্রবৃত্তিগুলোকে নিবৃত করে মনে ও প্রাণে পবিত্রতার ভাব এনে দেয়।

সিয়াম বা রোজা হচ্ছে আধ্যাত্মিক জিহাদ। এ রমজান মাস বিশ্বমানবের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। কারণ প্রায় সব আসমানি কিতাব এ মাসে নাজিল হয়েছে। যেমন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ওপর ১০ রমজান নাজিল হয় ‘ছহিফা’, হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর ১৮ রমজান নাজিল হয় ‘যবুর’, হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর ৬ রমজান নাজিল হয় ‘তৌরাত’, হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর ১৩ রমজান নাজিল হয় ইঞ্জিল এবং রমজানের ২৭ তারিখ রাতে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কোরআন। এ ছাড়া এ মাসে রয়েছে ‘লাইলাতুল কদর’ অর্থাৎ এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত থেকে উত্তম। পবিত্র হাদিসে আছে, ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ আল্লাহপাক রোজা পালনের জন্য মুমিন মুসলমানদের বারবার তাগিদ দিয়েছেন। তাই মাহে রমজান আত্মশুদ্ধি, আল্লাহপাকের অসীম করুণা ও শুভ প্রতিফল লাভের এক অতুলনীয় সুযোগ।

রোজা রাখার অনেকটা হৃদয়ঘটিত ব্যাপার অর্থাৎ তাকওয়া রোজার ভিত্তি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আজকাল অনেক পূর্ণবয়স্ক পুরুষ-মহিলা নানা অজুহাতে রোজা পালন থেকে বিরত থাকে। অথচ অনেক পরিবার আছে যেসব পরিবারে ৮-৯ বছরের ছেলে-মেয়েকে রোজা রাখতে দেখা যায়। এটি মনের টান ও আল্লাহর গজবের ভয়ে সম্ভব হয়। ইসলাম এমন এক ধর্ম যার প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি ইবাদত বন্দেগির মধ্যে সর্বজনীন কল্যাণ নিহিত। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা রোজার গুরুত্ব যে কত ব্যাপক তা প্রমাণিত হয়েছে। যারা গ্যাস্ট্রিক বা আলসারের কারণে রোজা থেকে বিরত থাকেন, বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান কিন্তু তার বিপরীতে মতামত ব্যক্ত করেছে। ডাক্তার ও অভিজ্ঞদের মতো, পেপটিক আলসার রোজার উপবাসের কারণে তাড়াতাড়ি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রোজার উপবাসের কারণে লিভারে প্লিহা, কিডনি, মূত্রথলি পূর্ণ বিশ্রাম পায়। রক্ত প্লিহা প্রবাহ, স্নায়ু, রক্ত সঞ্চালন ও দেহের গ্রন্থিসমূহের ওপর রোজার সুফল ও প্রতিক্রিয়া সর্বাধিক। ডায়াবেটিস নিরাময়ে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম, অতুলনীয়। মোটকথা স্বাস্থ্যরক্ষায় রোজার ভূমিকা ও উপকারিতা অপরিসীম, অতুলনীয়।

এদিকে রোজার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তারাবির নামাজ খাদ্য হজম করার পক্ষে বেশ সহায়ক। তেমনিভাবে সাহরির খাবারের পর তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ আদায় করা খাদ্যদ্রব্য হজম করার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এভাবে রোজা ও নামাজ দুই-ই একে অপরকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। তাই আল্লাহপাক প্রত্যেক গৃহবাসী নর-নারীর জন্য রোজা ফরজ বা অবশ্য পালনীয় করেছেন।

এদিকে ইসলামের পঞ্চম ভিত্তির অন্যতম হলো জাকাত। জাকাত আদায় করা প্রত্যেক বিত্তশালী মুসলমানের জন্য অবশ্য ফরজ করা হয়েছে। ইসলামের মৌলিক নীতিতে আছে ধনসম্পদ সঞ্চয় করে রাখা হারাম। এ প্রসঙ্গে কোরআন শরিফে আছে যারা খোদা প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপণতা করে তারা যেন তাদের এ কাজ তাদের জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক মনে না করে বরং তা তাদের জন্য খুব খারাপ। ইসলামের মৌলিক নীতিতে আছে অর্থ বিনিয়োগের নির্দেশ। এ ছাড়া তাদের ধন সম্পত্তিতে সব প্রাণী ও অভাবী লোকদের অধিকার রয়েছে। এ কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। ইসলামে কিন্তু ধন উপার্জনে কোনো বাধা নেই, তবে তা কুক্ষিগত করে রাখার কোনো উপায় নেই। ইসলামী জীবন বিধানে এটি একটি অবাস্তব ব্যাপার। এদিকে ধনসম্পদ বৃদ্ধির লোভে মালামাল মজুত করে সাময়িক অভাব সৃষ্টি করা ইসলামে হারাম। ধনীদের দান-সদকা করা এবং জাকাত আদায় করার ফলে অতিরিক্ত টাকা তাদের হাত থেকে জনসাধারণের মধ্যে চলে আসে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এ জাকাত ব্যবস্থাকে তাই ঝরনা ও বৃষ্টি ধারার সঙ্গে তুলনা করা চলে। সাগরের পানি বৃষ্টি রূপে নেমে যেমন মৃত প্রায় ধরণীতে আনে নতুন জীবন, ঠিক তেমনি ধনীদের জাকাতের টাকা-পয়সা গরিবদের মধ্যে নিয়ে আসে নতুন জীবন, সজীবতা। আনে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা।

তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ধনীর উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রীত হয়ে পুনরায় সে টাকা ধনীর তহবিলে ফিরে আসে। এতে সাগর বা নদীর পানি বা বিলের মাছের মতো এ হাত থেকে ও হাতে ধনী হতে গরিব আবার গরিব হতে ধনীর হাতে ফিরে যায়। এক হাতে জমা থাকে না। এতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্থবিরতা কেটে গিয়ে সচলতা আসে, গতিশীলতা বাড়ায়। জাকাত প্রদানের ফলে ধনসম্পদ প্রত্যেক ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছে। এর ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে সবার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পায়, খেতখামার শস্য শ্যামলায় ভরে ওঠে, যেমন খাল-বিল-নালা মাছে থাকে পরিপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। ইসলামের এক একটি বিধানে কীভাবে না মানবকল্যাণ নিহিত, তা পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই অকপটে বলা যায় ইসলামী নির্দেশ চিন্তা চেতনাগুলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূরীকরণে সহায়ক। এটি সত্য এবং বাস্তব।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর