মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

কাদেরিয়া বাহিনী জাদুঘর

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

কাদেরিয়া বাহিনী জাদুঘর

মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভালো-মন্দ মিলিয়ে এক দারুণ গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে জন্ম নিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা, এই মাসেই আমরা অর্জন করেছি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তৎসময়ের ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। এশিয়া মহাদেশে মাত্র দুজন মানুষ দুজন নেতা তার দেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছেন। একজন ভারতবর্ষের নাড়ির স্পন্দন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান আমরণ যোদ্ধা বীর বিপ্লবী মহাভারতের অহংকার বাঙালির গৌরব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে আন্দামান নিকোবর জাপানিরা ব্রিটিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলে আন্দামানে নেতাজি সুভাষ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এটা বলতেই হবে তখন আন্দামান নিকোবর ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্ত ছিল, কোনো ভয়ভীতি ছিল না। অন্যদিকে ছাত্রসমাজের অহংকার আ স ম আবদুর রব যখন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তখন পর্যন্ত আমরা ছিলাম পাকিস্তানের কামানের মুখে। এক গুলিতেই উড়িয়ে দিতে পারত। সেই অবস্থাতেও ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে আ স ম আবদুর রব ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। আমি বহুবার বহু জায়গায় বলার চেষ্টা করেছি ইতিহাস ইতিহাসই। তা নিয়ে বেশি টানাহেঁচড়া করলে প্রকৃত ইতিহাসের কোনো ক্ষতি হয় না। যারা টানাহেঁচড়া করেন বরং তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। আ স ম আবদুর রব এখনো বেঁচে আছেন। তার মত- পথ যাই হোক ’৭১-এর ২ মার্চ তার পতাকা উত্তোলন এটা জাতীয়ভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নেওয়া উচিত। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার নেতার একজন শাজাহান সিরাজ। সেখানে বাংলাদেশের পতাকা, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা এবং রাষ্ট্রপতি এমন কোনো বিষয় ছিল না যা উল্লেখ করা হয়নি এবং সমগ্র জাতি যেটাকে সমর্থন করেছিল। ৩ মার্চ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহূত সমাবেশে ইশতেহার পাঠকে জাতীয়ভাবে যদি স্বীকার করে নেওয়া হতো তাহলে স্বাধীনতার ঘোষক-ঘোষিকা নিয়ে কোনো কথা আসত না। কেন যেন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকে আড়াল করা হচ্ছে। যাতে চলার পথে বাঁকে বাঁকে অসংগতি অসন্তোষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এর পরেই আসে ৭ মার্চ। ৭ মার্চে জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ পৃথিবীর অল্প কয়টি ভাষণের মধ্যে অন্যতম। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা নানাভাবে নানা কথা বলতে পারে। আমরা যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, যুদ্ধে আমাদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্র ছিল। যদিও শুরুতে কিছুই ছিল না। ভাঙা থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর বাঁশের লাঠির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। কিন্তু তবু পুলিশের থ্রি নট থ্রি রাইফেলই আমাদের কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের কামানের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। আস্তে আস্তে পাকিস্তান হানাদারদের যেমন আধুনিক মারণাস্ত্র ছিল আমাদেরও ছিল। কারণ একসময় এমন মনে হতো পাকিস্তানের হাতের অস্ত্রই আমাদের অস্ত্র। একসময় না একসময় আমরা তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে পারবই। তাই তাদের অস্ত্রই আমাদের অস্ত্র। আরেকটা ব্যাপার আগস্টের ১০-১১ তারিখ কালিহাতী ভূঞাপুরের মাটিকাটায় নানা ধরনের বিপুল অস্ত্র বোঝাই পাকিস্তানি দুটি জাহাজ প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্যে আমাদের দখলে আসে। আমরা সেখান থেকে বিপুল অস্ত্র সংগ্রহ করি। যা পরবর্তী যুদ্ধের সময় অস্ত্র গোলাবারুদের জন্য আমাদের আর কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়নি। এসবই আল্লাহর ইচ্ছে। কত অতি সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। আজ ভাবলে অনেক কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হয়। কথাটা বলছিলাম এই জন্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্র থাকলেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আরেক মহাঅস্ত্র। কামান বন্দুকের থেকে কম ছিল না। একে তো দেহমনে সিংহের তেজ অনুভব করতাম, দ্বিতীয়ত যখন যার দরকার হতো বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে তার কিছু না কিছু পাওয়া যেত। যেমন- রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের। আমাদের যাতে কোনো বদনাম না হয়। এমন কোনো কিছু ছিল না যা ৭ মার্চের ভাষণে ছিল না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দীপশিখা ছিল ৭ মার্চ।

১৭ মার্চ পিতার জন্মদিন। টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন। এরপর ২৫ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্যতম দিন। আজ অনেকে উপলব্ধি করতে পারবে না পাকিস্তানিরা কতটা নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল বাঙালির ওপর। ইয়াহিয়া বলেই দিয়েছিল, বঙ্গাল মল্লুককা আদমি নেহি, মিট্টি চাহিয়ে। সত্যিই তারা বাংলার লোকজনকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল। একটা মানুষ যে কত অপ্রয়োজন মূল্যহীন তা দেখা গেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই সময়ের কর্মকান্ডে। তাদের বন্দুকের সামনে নারী-পুরুষ-শিশু কারও কোনো ভেদাভেদ ছিল না। মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কত শিশুকে শূন্যে ছুড়ে বেয়নটে গেঁথে হত্যা করেছে তার কোনো হিসাব নেই। শত মানুষকে ব্রাশফায়ারে মুহূর্তের মধ্যে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে। যতভাবেই বলি সেই নিদারুণ বিভীষিকাময় অবস্থা বলে বা লিখে কাউকে বোঝানো যাবে না। কারণ এটা সিনেমায় দেখা হত্যাযজ্ঞ আর পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যাযজ্ঞ এক নয়। সিনেমায় তৈরি মেকি প্রদর্শনীর চেয়েও ভয়াবহ বিভীষিকাময় ছিল পাকিস্তানিদের ২৫ মার্চের সে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এক রাতেই তারা সারা দেশে ৩-৪ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই ২৫ মার্চ গভীর রাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। তাই বাংলার স্বাধীনতা ছেলেখেলা নয়। পৃথিবীর বহু দেশ অনেক বছর স্বাধীনতা জন্য যুদ্ধ করেছে। ভিয়েতনাম তো দুই যুগেরও বেশি। লাওস, কম্বোডিয়া কেউ কম যুদ্ধ করেনি, লড়াই করেনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সত্যিই খুব ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু রক্ত ঝরেছে অনেক। যে কারণে অনেকে উপলব্ধি করতে পারেনি স্বাধীনতার কত দাম কত মূল্য। অল্প সময়ে কোনো কিছু পেলে অনেকেই তার প্রকৃত মূল্য বুঝে না, বুঝতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধ যদি ১০-১৫-২০ বছর হতো, সবার গায়ে কম-বেশি বাতাস লাগত সবাই বুঝতে পারত। তবু স্বাধীনতা যে কি অমূল্য সম্পদ তা আজ ঘরে ঘরে বোঝার কথা।

৩০ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এসেছিলেন টাঙ্গাইলে। অনেক বছর ধরে একটা ইচ্ছে ছিল বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে যেভাবে আমরা অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম সেটাকে স্মরণীয় করে রাখতে একটা কাদেরিয়া বাহিনী জাদুঘর করা যায় কি না। জীবনের অনেকটা সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে কাটিয়ে দিয়েছি। আরও এক লম্বা জীবন বলতে গেলে প্রায় অকাজেই চলে গেল। গত বছর প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনাকে কাদেরিয়া বাহিনী জাদুঘর করার মানসে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি খুবই তাড়াতাড়ি সম্মতি জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর মন্ত্রীর ইচ্ছে বা আন্তরিকতায় কখনো কোনো খাদ দেখিনি। কিন্তু তবু কেন যেন প্রকল্পটির কাজ তেমন গতি পায়নি। তাই জায়গাটি পরিদর্শনে সংশ্লিষ্ট অনেককে নিয়ে মন্ত্রী টাঙ্গাইলে এসেছিলেন। বহুদিন পর আমার বড় ভালো লেগেছে। কাদেরিয়া বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৮ জন। একজন বীরউত্তম, ৩ জন বীরবিক্রম ও ১৪ জন বীরপ্রতীক। অনেকেই চলে গেছে। মনে হয় ৭ বা ৮ জন এখনো আমরা জীবিত। এর মধ্যে আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম, আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক, ফজলুল হক বীরপ্রতীক উপস্থিত ছিল। আবুল গফুর বীরপ্রতীক, খোরশেদ আলম, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী কোনো কারণে আসতে পারেনি। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের আট সংসদ সদস্যকেই অনুরোধ করেছিলাম, আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলাম। বিশেষ করে মনা এবং হাজী মকবুলের ছেলে আহসানুল ইসলাম টিটুকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গভবনে পেয়েছিলাম। আমার সখীপুর-বাসাইলের সংসদ সদস্য ভাগিনা জয়কেও বঙ্গভবনে বলেছিলাম। তাছাড়া ফোনেও কথা হয়েছিল। শুনলাম ওর নাকি বাচ্চার স্কুলে ভর্তির প্রোগ্রাম ছিল তাই আসতে পারেনি। প্রিয় যোদ্ধা ড. আবদুর রাজ্জাককেও বলেছিলাম। ড. আবদুর রাজ্জাকের সেদিনের কথাবার্তা আমার বড় ভালো লেগেছে। কিন্তু অনুষ্ঠানে আসতে পারেনি।

অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন নাহার চাপাকে টেলিফোনে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম আসবে। কিন্তু আসা হয়নি। প্রবীণ নেতা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুককে ব্যক্তিগতভাবে তার বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত করেছিলাম। সত্যিই তিনি শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। তার ছেলে মির্জাপুরের এমপি শুভর সঙ্গে কথা হয়েছিল। টাঙ্গাইল সদরের এমপি আলহাজ আবুল হোসেনের ছেলে সানোয়ারকে ব্যক্তিগতভাবে ওদের বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত করেছিলাম। সানোয়ার, শুভ এবং গোপালপুর-ভূঞাপুরের এমপি ছোট মনি খুবই আগ্রহ নিয়ে এসেছিল। কালিহাতীর সংসদ সদস্য বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, তাকে সপ্তাহখানিক আগেই বলে রেখেছিলাম। তিনি যথাসময়ে এসেছিলেন এবং সবার মত নিয়ে অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করার প্রস্তাব করেছিলাম। তিনি সানন্দে রাজি হয়েছিলেন। ঘাটাইলের সংসদ সদস্য রানার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ভেবেছিলাম আসবে। হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেনি। কিন্তু রানার বাবা ঘাটাইলের প্রাক্তন সংসদ সদস্য আতোয়ার রহমান খান এসেছিলেন। এসেছিলেন আমার সখীপুর-বাসাইলের প্রাক্তন এমপি, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমার প্রিয় অত্যন্ত স্নেহের জোয়াহেরুল ইসলাম। এককথায় বলতে গেলে অনুষ্ঠানটি অসাধারণ হয়েছে। বহুদিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের একত্র দেখে আমার অন্তরাত্মা ভরে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, কাদেরিয়া বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার যাকে পাকিস্তানিরা হনুমান কোম্পানি বলে ডাকত। হানাদারদের ভীতি সেই হুমায়ুন বাঙ্গালকে আমি চিনতে পারিনি। যে ছিল আমার ছায়ার মতো। ছাত্ররাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সব সময় সেই হুমায়ুন যার চেহারা এত বদলে গেছে। এ অনুষ্ঠানে তাকে আবার নতুন করে নতুন রূপে চিনলাম। মন্ত্রী পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় ১৯ মার্চ গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি এবং ২ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডিজার্ভ করার বিরুদ্ধে হাজার হাজার লোক নিয়ে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবারকে ঘেরাও করেছিলেন তার অন্যতম নেতা ছিলেন বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। আগাগোড়া রাজনৈতিক মানুষের চাল-চলন, চিন্তা-চেতনা থাকে একরকম। তাই রাজনৈতিক লোকের সঙ্গে চলাফেরা অরাজনৈতিক লোকের সঙ্গে চলাফেরা কখনো একরকম হয় না। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র প্রদানের ক্ষণটিকে স্মরণীয় করে রাখতে কাদেরিয়া বাহিনী জাদুঘর তৈরিতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেওয়ায় সবাই খুশি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা যদি জাদুঘর এবং কমপ্লেক্সটির সদয় হয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তাই তিনি শুধু জায়গাটি পরিদর্শন করে গেছেন। পরে সিদ্ধান্ত হবে।

আরেকটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ’৬৯-এর মার্চে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে এক বছরের জন্য প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ’৭০-এর ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু হয়। ১১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ প্রথম জনসভা করে। বঙ্গবন্ধু টাঙ্গাইল এসেছিলেন ১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায়। টাঙ্গাইল স্টেডিয়ামে বিশাল জনসভা হয়েছিল। সেদিনও বঙ্গবন্ধু ওয়াপদা ডাকবাংলোয় অবস্থান করেছিলেন। ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল স্বাধীন হয়। আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ায় ১২ ডিসেম্বর আমি ওয়াপদা ডাকবাংলোয় উঠেছিলাম। ১৩ ডিসেম্বর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজি, ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে নিয়ে ঢাকা দখলের পরিকল্পনা করা হয় এই ওয়াপদা ডাকবাংলোয়। স্বাধীনতার পর ২৪ জানুয়ারি যেদিন কাদেরিয়া বাহিনী বঙ্গবন্ধুর হাতে সমস্ত অস্ত্র তুলে দেয় সেদিনও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ডাকবাংলোতে দোতলার পশ্চিম পাশের ঘরে উঠেছিলেন। ঢাকা থেকে ভাঙা রাস্তায় ধুলোমাটিতে একাকার নেতা গোসল করে পরিপাটি হয়েছিলেন এখানে। দোতলা থেকে নেমে সার্কিট হাউসে যাওয়ার পথে পরম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ফোমিন তার দেশের স্বীকৃতি নিয়ে ছুটে এসেছিলেন। এখান থেকে তাকে আমরা সার্কিট হাউসে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং বঙ্গবন্ধুর পাশে বসিয়ে খাবার খাইয়ে ছিলাম। এর কিছুদিন পর ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে আবহাওয়া খারাপ থাকায় হেলিকপ্টার না চলায় বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার পথ ধরেছিলেন। আমরা ঘাটাইল পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে নেতাকে টাঙ্গাইল নিয়ে এসেছিলাম এবং টাঙ্গাইলে থাকার অনুরোধ করায় তারা থেকে গিয়েছিলেন। তিনজনই প্রথম ওয়াপদা ডাকবাংলোয় উঠেছিলেন। সৌভাগ্যের কথা এই ওয়াপদা ডাকবাংলোতেই আমেরিকার রাষ্ট্রদূতও তার দেশের স্বীকৃতির কথা জানিয়েছিলেন। রাতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তখনকার ভাঙা সার্কিট হাউসে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এম মনসুর আলী ছিলেন ওয়াপদা ডাকবাংলোয়।

আমাদের বাড়ি পুড়ে ছারখার করে দেওয়ায় ১২ ডিসেম্বর ’৭১ থেকে ১২ আগস্ট ’৭৫ পর্যন্ত আমি এই ডাকবাংলোর দোতলায় পশ্চিম ঘরের বাসিন্দা ছিলাম। তখন জেলা গভর্নর পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। আমাকে করা হয়েছিল টাঙ্গাইলের জেলা গভর্নর। ১২ আগস্ট সকালে এই ডাকবাংলো থেকেই ঢাকায় গিয়ে বঙ্গভবনে জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। মন্ত্রীকে তাই অনুরোধ করেছিলাম ভবনটি দেখে যেতে। পৃথিবীর বৃহৎ দুটি শক্তি বাংলাদেশকে যে ঘরে যে বাড়িতে স্বীকৃতি দিয়েছে, যে ঘরে বঙ্গবন্ধুর পায়ের ধুলো পড়েছে সেই ঘর সে বাড়ি হেলাফেলায় নষ্ট না করে সংরক্ষণ করা যায় কি না সেজন্য ভবনটি দেখতে মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি এই শেষ বয়সে আমার অনুরোধ রক্ষা করায় আমি যারপরনাই আনন্দিত। দেখা যাক এমন একটি ঐতিহাসিক ভবন হেলাফেলায় নষ্ট হবে নাকি জাতির ঐতিহ্য হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে তা ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর