বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ : বিদেশিদের বিড়ম্বনা

মেজর (অব.) আখতার

বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ : বিদেশিদের বিড়ম্বনা

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের মান্যবর রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ‘এক দিন এক দিন করে’ বাংলাদেশে দুই বছর পার করে তিন বছর পুরো করতে চলেছেন। আশা করি ‘এক দিন এক দিন করে’ উনার তিন বছরও পুরা হয়ে যাবে। ‘প্রতিদিন এ দেশের সম্ভাবনা, জনগণের শক্তি ও সহনশীলতা’ যে উনাকে মুগ্ধ করেছে তার জন্য অবশ্যই আমরা উনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি। তবে হয়তো দুঃখের সঙ্গে উনাকে জানাতে হচ্ছে তিনি যে ‘প্রাণবন্ত নাগরিক’ সমাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তারা কিন্তু এদেশের আপামর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না এবং তাদের বেশির ভাগ উনাদের দেশেরই নাগরিক। তবে সুখের বিষয় হলো উনারা মানে ‘প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজের’ প্রায় সবাই পিটার হাস সাহেবদের দেশের স্বার্থ ও প্রতিনিধিত্ব করে।

মান্যবর রাষ্ট্রদূত গত ১৫ মার্চ ২০২৪ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রাণবন্ত, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও আমাদের জাতির জন্য দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য লিখেছেন। লেখাটি পড়ে আমি খুব আপ্লুত ও আনন্দিত হয়েছি। লেখাটির জন্য মান্যবর রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি লেখাটিকে ২৩ ভাগে ভাগ করে কয়েকটি বক্তব্যকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই ‘বাংলাদেশের সামনে যে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশের দৃষ্টিতে তা কতটুকু অর্থ বহন করে। উনার বক্তব্যকে ক্রমান্বয়ে ১ থেকে ২৩ পর্যন্ত সাজিয়েছি যার থেকে ক্রম নং উল্লেখসহ আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

(১) ‘প্রতিদিন এ দেশের সম্ভাবনা, জনগণের শক্তি ও সহনশীলতা এবং এর প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ আমাকে মুগ্ধ করে। যেমনটা আমি গত বছর বলেছিলাম, বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এক দিন এক দিন করে এগিয়ে আসে এমন এক ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাই, আমি এ দেশের সামনে সম্ভাবনা দেখতে পাই। তবে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও চোখে পড়ে।’ ভাবতে আমার খুব ভালো লাগছে জেনে যে এ দেশের সম্ভাবনা মান্যবর রাষ্ট্রদূতকে প্রতিদিন মুগ্ধ করে। কী সম্ভাবনা প্রতিদিন উনাকে মুগ্ধ করে তার কোনো বর্ণনা অবশ্য আমরা উনার লেখায় পাইনি, হয়তো আমাদের তেমন অন্তর্দৃষ্টি না থাকার কারণে। তবে তিনি যদি একটু খোলাসা করে এ অজ্ঞ বধির জাতির সামনে আমাদের সম্ভাবনাগুলো বলে দিতেন তাহলে সম্ভাবনাগুলো অর্জন করতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতাম। তারপরে তিনি বলেছেন, ‘জনগণের শক্তি’ প্রতিদিন উনাকে মুগ্ধ করে। খুবই উৎসাহব্যঞ্জক এবং উদ্দীপক কিন্তু ‘জনগণের শক্তি’ বলতে উনি কী বুঝাতে চেয়েছেন বা কাদের বুঝাতে চেয়েছেন তা আমাদের কারও কাছেই মনে হয় পরিষ্কার নয়। কারণ আমাদের জনগণ এখন দুটি ভাগে সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত। যদিও আমাদের জনগণের সহনশীলতাও মান্যবর রাষ্ট্রদূতকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করতেই পারে কারণ সহনশীলতা ছাড়া আমাদের আর আছেইবা কী!

(২) ‘২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির সংসদীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছিল, যা বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করবে। কিন্তু তা ঘটেনি।’ একটি অতীব চমৎকার বক্তব্য, যার মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে বিগত নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চানক্যময় একটি অবস্থান। তবে তাদের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার পুরো দায়দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হলো এদেশের শক্তিশালী ও সহনশীল জাতির কাঁধে। পিটার হাস সাহেবের বক্তব্যে নতুন একটি ধোঁয়া উঠল যে, জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হতে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। বক্তব্যটির সঙ্গে জনগণ একমত, কিন্তু সরকার তা স্বীকার করে না। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রকাশ্যে সরকারের অবস্থান স্বীকার করে নিয়ে এখন রাষ্ট্রদূতের এহেন বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থানের বিপরীত হয়ে গেল না! অবশ্য এ ধরনের কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রদূত বলতেই পারেন যে এটি উনার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত! তবে এটি স্পষ্ট যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাষ্ট্রদূত কেউ-ই সম্ভবত বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে নয়- উনারা মূলত উনাদের স্বার্থের পক্ষে!

(৩) ‘যুক্তরাষ্ট্র এখনো বাংলাদেশ ও বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে। সহজ করে বলতে গেলে, আমরা বিশ্বাস করি, দেশের মানুষের কল্যাণে গণতন্ত্র হলো স্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সর্বোত্তম উপায়।’ রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের এ বক্তব্যটি খুবই চানক্যময়। একদিক দিয়ে বলছেন, দেশের মানুষের কল্যাণে গণতন্ত্র হলো স্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সর্বোত্তম উপায়, আবার বলছেন গত নির্বাচনে বাংলাদেশে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি, তাহলে এখন আমরা কোনটাকে সত্য বলে মেনে নেব?

(৪) ‘আমরা সাহসী নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখব।’ এখানে তিনি তার বক্তব্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তিনি জনগণের প্রতি তার কোনো সমর্থন বা দায়বদ্ধতা প্রকাশ না করে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ভাষায় সাহসী নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বক্তব্যটি অতীব পরিষ্কার, এতে কারও কোনো সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় এবং আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ‘সমর্থন অব্যাহত রাখব’ বলে যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তাতে জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণ চায় কি না সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। মনে হতে পারে এদেশের জনগণের স্বার্থের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। (৭) ‘আমরা আরও উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজের পথকে সুগম করতে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানানো অব্যাহত রাখব।’ এখানে মোটা দাগে যা বলেছেন তা গৎবাঁধা বুলি যার কোনো সুস্পষ্ট অর্থ নেই এবং কোনো পক্ষপাতিত্বেরও সুযোগ নেই। একদম কূটনৈতিক ভাষায় মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের কাছে সমার্থক বাক্য, যা যে যার মতো বুঝে নিতে পারে এমনভাবে বলে দিয়েছেন। তবে সরকারের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে তা প্রকারান্তরে বুঝাতে কোনো ত্রুটি রাখেননি। পিটার হাস রাজনীতিতে আন্দোলন সংগ্রামের পথ পরিহার করে আরও উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজের পথকে সুগম করতে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়ে উনার বা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। উনার এহেন বক্তব্যের পরে রাজপথে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেল। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমেই উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজের পথকে সুগম করতে হবে।

(১১) ‘আমাদের দুই দেশ এবং এ অঞ্চলের মধ্যে নিরাপত্তার সম্পর্কও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ (১২) ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কমাতে একসঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা বাড়ানোর আরও উপায় খুঁজে বের করছেন।’ উল্লিখিত বক্তব্যটি খুবই রহস্যময় ও অর্থবহ, যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখা হয়েছে এবং বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জন করার জন্য নিষেধাজ্ঞার লাগাতার হুমকি দেওয়া হচ্ছে সেখানে এ বক্তব্যের মোজেজা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বোঝার ক্ষমতার বাইরে। আমাদের দুই দেশের নিরাপত্তার সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমাদের ক্ষুদ্র দেশ হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বড়। তাই আমরা অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়লে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি। একইভাবে আমাদের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়লে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পাশে দাঁড়ালে আমরা অবশ্যই অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করতে পারি। কিন্তু এ অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়লে কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের অনেকের কাছে বোধগম্য নয় বলেই অনেকে মনে করেন। তাই পিটার হাস সাহেবের বক্তব্যটির উদ্দেশ্য অনেকের মনে অহেতুক বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ রয়েছে। (১৩) ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রেও আমরা ভূমিকা রাখতে পারব বলে আশা করছি।’ বক্তব্যটি ভীষণ স্পর্শকাতর। কারণ শুধু সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের বিষয়টি ভবিষ্যতে অনেক ভুল  বোঝাবুঝি সৃষ্টি করতে পারে। সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ কোনো অবস্থাতেই দেশের বাইরে থেকে কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার সামর্থ্য বৃদ্ধি বুঝায় না। আন্তসীমানা নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করতে হলে গোটা সশস্ত্র বাহিনীসহ সব নিরাপত্তা বাহিনীর আধুনিকীকরণ ও নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তবে এরকম উচ্চাভিলাসী প্রতিরক্ষা কার্যক্রম কোনো অবস্থাতেই নিকট প্রতিবেশীরা ভালো চোখে দেখবে না। যার ফলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ সৃষ্টি হবে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াতে সরাসরি সহায়তা করবে। তা ছাড়া শুধু সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ ভবিষ্যতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এবং সরকারের স্থিতিশীলতা বা নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। (১৬) ‘সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন সহায়তা প্রদানসহ শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে সমর্থন দিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ শ্রম অধিকারের পূর্ব শর্তই হলো ন্যায্য পারিশ্রমিক, স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, চাকরির নিরাপত্তা, চাকরি থেকে অবসর-উত্তর মানসম্পন্ন জীবনের নিশ্চয়তা। কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা ও ক্রয়ক্ষমতায় শিল্প উন্নয়নের তেমন বড় সুযোগ নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ অনেক কম মূল্যে ভোক্তাপণ্য উৎপাদন করতে পারে। যার ফলে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে আমাদের টিকে থাকা কঠিন। ভোক্তাপণ্য হিসেবে আমাদের বিশাল পোশাক শিল্প রয়েছে কিন্তু মনোপলি চাহিদা রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তারা যদি আমাদের পোশাক আমদানি না করে তাহলে একদিনেই পোশাক শিল্প বসে যাবে। তখন পোশাক শিল্পে নিয়োজিত সব শ্রমিক শুধু কর্মহীনই হবে না তারা চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে যাবে। পোশাক শিল্পের অস্তিত্ব শতভাগ নির্ভরশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের মন-মর্জির ওপর। এখন যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাহেবের নির্দেশ মোতাবেক আমরা বৈশ্বিক শ্রমকৌশল নির্ধারণ করে শ্রম অধিকারকে অগ্রাধিকার দেই তাহলে বাংলাদেশ থেকে একটি মার্কিন কোম্পানিও কোনো পোশাক আমদানি করবে না। কারণ হলো বৈশ্বিক শ্রমকৌশল মেনে এবং শ্রম অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে শ্রমিকদের বেতন ও ভাতা বাড়াতে হবে এবং শ্রমিকদের উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে হবে, যার ফলে পোশাকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি উৎপাদন খরচ দিতে যদি মার্কিন কোম্পানিগুলোকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাহেব রাজি করাতে পারেন তাহলে পিটার হাস সাহেবের কথামতো বাংলাদেশের আইন, নীতি ও অনুশীলনকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে এক মাসও সময় লাগবে না। কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো ন্যায়সংগত শ্রমমূল্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে পোশাক আমদানি করতে রাজি হবেন কি না? যদি রাজি থাকেন তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা লাগবে না, বাংলাদেশের মাটিতে উন্নত ও বিশ্বমানের শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা জনগণই করে ফেলবে।

(১৮) ‘পারস্পরিক সুবিধার জন্য আমরা আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কার্যকর করতে পারি এবং তা করা উচিত।’ এ বক্তব্যটি খুবই সাদামাটা কিন্তু বাক্যটির শেষে ‘উচিত’ শব্দটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে যা জনগণ মেনে নিতে পারছে না। তবে যদি পিটার হাস মহোদয় ‘উচিত’ বলতে তাদের উচিত বলে মনে করে থাকেন তাহলে জনগণ অবশ্যই সাধুবাদ জানাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশ থেকে ন্যায্যমূল্যে পোশাক আমদানি আরও বৃদ্ধি করে, পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ বাড়ায়, ডিসকাউন্টেড বা তাদের উৎপাদন মূল্যে তেল, চিনি, ভুট্টা, গম, তেলবীজ ও শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল, তুলা, খনিজ ও রাসায়নিক দ্রব্য, লোহা, ইস্পাত, সার ও উচ্চ প্রযুক্তি বিশেষ সুবিধায় বাংলাদেশে রপ্তানি করে তাহলে বাংলাদেশের জনগণ তার জনবল দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে সবসময় থাকবে। প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে বা অন্য যে কোনো নিরাপত্তা সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ তাদের পাশে জনবল নিয়ে থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বশস্ত্র বাহিনীসহ তাদের মিল-কারখানা, বড় বড় স্থাপনা, পৌর কর্মকান্ডে ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় সৈনিক, পুলিশ, শ্রমিক ও শ্রম ও পেশাজীবীর সর্বস্তরে ন্যায্য ও ডিসকাউন্টেড শ্রমমূল্যে ৫ থেকে ১০ বছরের ফ্রি ভিসায় জনগণ বাংলাদেশ থেকে সহায়তা করবে। এ ব্যাপারে ব্যক্তি পর্যায়ে আলোচনা করতে রাজি আছি।

(২০) ‘মিয়ানমারের নিরাপদ পরিস্থিতি সাপেক্ষে সবার নিরাপদ, স্বেচ্ছায়, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাব।’ বক্তব্যটি খুব ধোঁয়াশাপূর্ণ। প্রথমত ‘টেকসই মানবিক সহায়তা প্রদান’ বলতে কোন সহায়তাকে বলা হয়েছে নির্দিষ্ট করা হয়নি। ‘টেকসই মানবিক’ শব্দগুচ্ছ খুবই উচ্চমাত্রার বিভ্রান্তিকর শব্দ। পৃথিবীতে কোনোকিছুই টেকসই নয়। সবকিছুরই একটি পরিসমাপ্তি বা রূপান্তর আছে। তেমনি পরিসমাপ্তি বা রূপান্তর আছে ‘মানবিক সহায়তার’। অনন্তকাল ‘মানবিক সহায়তা’ চলতে পারে না। কাজেই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় বাস্তবসম্মত নয়। বক্তব্যটির তাৎপর্যও ভয়াবহ। মিয়ানমার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। সে দেশের ‘নিরাপদ পরিস্থিতি’ দেখার দায়িত্ব কোনো অবস্থাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা বাংলাদেশের ওপর বর্তায় না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের এহেন বক্তব্য উসকানিমূলক যার সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশ একমত পোষণ করতে পারে না। রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র পথ মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধম্যে চিরস্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবর্তন সম্ভব বলে বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে। পিটার সাহেব যেভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পথ খুঁজছেন তাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে যা প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন।

(২২) ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের পাশে রয়েছে এবং আপনারা সেই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের পাশে রয়েছে তা অতীব সত্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জনগণ অসীম কৃতজ্ঞ। তবে আমরা কোনো ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বলে যে তিনি ইঙ্গিত করেছেন তা জনগণের কাজে বোধগম্য নয়। (২৩) ‘আপনাদের এ যাত্রায় আমরা সব সময় আপনাদের সমর্থন করব।’ কাজেই তিনি কোন যাত্রায় আমাদের নিয়ে যেতে চাচ্ছেন তাও জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। তারপরেও জনগণের পক্ষ থেকে অজস্র সাধু ও ধন্যবাদ উনার সুচিন্তিত যা আমাদের হয়তোবা মঙ্গলজনক কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা বুঝতে পারছি না ওই সুলিখিত বক্তব্যের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পাশে আছে এ জন্য জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ।

                লেখক : স্বতন্ত্র মনোভাবাপন্ন

সর্বশেষ খবর