বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ

আতিক হেলাল

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ

উপমহাদেশের স্বনামধন্য আইনবিদ, মানবতাবাদী সমাজতিহৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম ‘সার্ক’-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের আজ ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। বিচারপতি মোর্শেদ একজন আইনবিদ ও বিচারপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব, যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন।

সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অথচ স্বাধীন পেশা হিসেবে তখনো সমাজে আইন পেশার গুরুত্ব ছিল অসামান্য। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমলে তারা রাজনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিতে পারতেন অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের পূর্ব পুরুষ স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল ১৮৪৯-    ৩ আগস্ট ১৯২৮) কলকাতা হাই কোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তার পুত্র সৈয়দ তারেক আমীর আলীসহ আরও অনেক বাঙালি মুসলমান হাই কোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাই কোর্টে বিচারপতি হিসেবে তার এ সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। তবে বিচারপতিগণ কর্মজীবনে সবাই সমান খ্যাতি অর্জন করেননি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাদের সবার অংশগ্রহণ সমান সপ্রতিভ নয়। এক্ষেত্রে বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন তার কর্মক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। তাই তো একপর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধাবোধ করেননি। বিচারপতিজীবনে তিনি অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন।

বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরবি-ফার্সি ভাষায় তার দখল ও পান্ডিত্য ছিল। অইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখন্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি আসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা এবং উজ্জ্বলতাকেও অতিক্রম করেছে।

জন্ম ও পরিবার : পারিবারিক সূত্রমতে, হজরত ইমাম হোসেনের বংশধরদের একজন, মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের প্রথমদিকে সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারক ছিলেন। তিনি তাদের পূর্ব পুরুষদের একজন বলে জানা যায়। মাহবুব মোর্শেদের পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে তিনি বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় নিযুক্ত ছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার বেশ খ্যাতি ছিল। মাহবুব মোর্শেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজী ওয়াজেদ আলী ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইন গ্র্যাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতিভাই। পিতা ও মাতা, উভয় দিক থেকেই মোর্শেদ ছিলেন ঐতিহ্যসম্পন্ন পরিবারের উত্তরাধিকারী। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র এ কে এম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোর্শেদ। তাদের ৪ সন্তানের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা সাঈদা মোর্শেদ। দ্বিতীয় সন্তান (জ্যেষ্ঠ পুত্র) সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন-সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তৃতীয় পুত্র সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ লন্ডন কলেজ অব মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ মানসুর মোর্শেদ বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর পদে কর্মরত আছেন।

১৯৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন দেশের উচ্চ আদালতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতরও বটে। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে।

                লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর