শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার শুরু?

এম জে আকবর

নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার শুরু?

কাবুলের সূর্যাস্ত কিয়েভের গোধূলিতে নেমে গেছে এবং আমেরিকান যুগ অন্ধকারে ম্লান হয়ে যাবে যদি ওয়াশিংটন তার পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ : তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে সংঘর্ষের আগে ভেঙে পড়ে।

মাত্র তিন দশক আগে ১৯৯০ সালে, স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভের পর, ওয়াশিংটন এবং এর সমর্থকরা আত্মবিশ্বাসী ছিল যে প্যাক্স আমেরিকানা ২১ শতকেও ২০তম শতাব্দীর মতো প্রভাব বিস্তার করে রাখতে পারবে। কিন্তু ২০০৫ সাল নাগাদ ইরাকে পথ হারিয়ে ফেলেছিল আমেরিকা এবং সিরিয়ায় একটিও খুঁজে পায়নি, ভøাদিমির পুতিন সেই শূন্যতা দ্রুত পূরণ করলেন। ২০১৪ সালে, ইউরোপের জলসম্পদ পরখ করার উদ্দেশ্যে পুতিন সেবাস্তোপোলে নোঙর ফেলা কৃষ্ণ সাগরের রুশ রণতরি বহরের আস্তানা ক্রিমিয়া দখল করে নিলে বারাক ওবামা উদাসীনতার সঙ্গে দুর্বল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।

ইউক্রেনে নতুন করে স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠার পর, পুতিন তাঁর কূটনীতিকদের কাছ থেকে রুশ সীমান্তে ন্যাটোর এগিয়ে আসার সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ২০২১ সালের আগস্টে তিনি দেখলেন যখন আমেরিকা একটু শক্ত অবস্থানে দাঁড়ালেই তালেবানদের অগ্রযাত্রা থমকে যেত, সে সময়ই আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে গেল তারা। অবস্থাটা কাজে লাগালেন পুতিন।

২৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে, ইউক্রেনের তরুণ প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পাশ্চাত্য তাঁকে কেন পরিত্যাগ করল। শান্তির সময়কার জীবন জেলেনস্কিকে যতটা শিখিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি শিখিয়েছে কয়েক দিনের যুদ্ধ। ফেব্রুয়ারিতে তিনটি ফ্রন্টে রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করা হয়নি। ইউক্রেনকে আমেরিকা পরিত্যাগ করে ২০২১ সালের প্রথম সপ্তাহে, যখন তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধতার প্রতিক্রিয়া ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি ছাড়া আর কিছুই করল না। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো বাইডেনও পশ্চাদপসরণ আড়াল করতে সৃজনশীল ভাষায় বুলি কপচানোর আশ্রয় নিয়েছেন।

জো বাইডেন যতটা দুর্বল, ঠিক ততটাই শক্তিশালী ভøাদিমির পুতিন।

ইরাকে কঠিন ভোগান্তির পর সেনা মোতায়েন ছাড়াই কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণে নেওয়া মার্কিন কৌশলের গুরুতর গলদ হলো, তাদের এই বিশ্বাস যে, সরেজমিন সেনা মোতায়েন না করেও মার্কিন স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব। ধারণা করা যায়, পুতিন প্রিয় উদ্ধৃতি হচ্ছে লেনিনের সেই কথা-‘বেয়নেট দিয়ে নেড়ে চেড়ে যাচাই করো, যদি নরম পি- পাও, যাচাই করতেই থাকো।’ এটা স্পষ্ট যে, পুতিন তাঁর বেয়নেট থেকে যে বার্তাটি পেয়েছিলেন তা ছিল হোয়াইট হাউস এখন আরামপ্রিয় লোকদের হাতে নিয়ন্ত্রিত। পুতিন তাঁর সেনা পাঠানোর পর বাইডেন যখন ইউক্রেনে পাঠানো বার্তায় বিপদ মুক্তির জন্য দোয়া করেন, তখন রাশিয়ান নেতা অবশ্যই মজা পেয়েছিলেন।

পুতিন মজা পান জুডোয় কিন্তু খেলেন দাবা। জুডোর একটি লাথির প্রভাব নিশ্চয়ই আছে কিন্তু সেটা বড় ধরনের ক্ষতি করে না। দাবা আরও জটিল : এটি একজন খেলোয়াড়কে পৌঁছানো এবং মাত্রাধিক পৌঁছানোর মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য শেখায়। আমরা শিগগিরই জেনে যাব যে, লেনিন ছাড়াও পুতিন জার্মান দার্শনিক-কবি জোহান উলফগ্যাং ফন গ্যেটের লেখা পড়েছেন কি না; গ্যেটে বলেছেন, সে-ই বিচক্ষণ যে জানে কখন থামতে হয়।

পেছন ফিরে দেখলে ধরা পড়ে যে, আমেরিকা এবং রাশিয়া উভয়ই ১৯৪৫ সাল থেকে দ্বিমেরু বিশ্বের দুই প্রান্ত ধরে রেখেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিভিন্ন উপায়ে আমেরিকা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে : উভয়ই তাদের পরিণতি সামলাতে পারেনি। মনে হচ্ছে, দুই পক্ষকেই এখন ক্লান্ত এবং নিজস্ব উচ্চাকাক্সক্ষা আর ভ্রমণাত্মক হিসাবনিকাশজনিত রক্তক্ষরণে তারা ভুগছে।

১৯৯০-এর দশকে আমেরিকান জজবার তীব্রতা এতটাই প্রকট ছিল যাকে বলা যায়, ওয়াশিংটনের ফুকুইয়ামা পাগলামি। পেন্টাগন-ওয়াল স্ট্রিট-হোয়াইট হাউস উদারবাদের ত্রিশূলে সোভিয়েত কমিউনিজমের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস যেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। জয় করার জন্য অবশিষ্ট ছিল না আর কোনো পৃথিবী। আমেরিকান মডেল এবং এর সংবিধানের চেতনায় সমাজ পরিপূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিল।

স্ট্যানফোর্ডের অধ্যাপক ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা। তিনি ‘দ্য এন্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ নামে বহু বিক্রীত বইয়ের লেখক। বইতে আছে-হোয়াইট হাউস আত্মতৃপ্তির প্রবল স্রোতে ভাসতে ভাসতে একটি প্রাথমিক পাঠ ভুলে গিয়েছিল : প্রতিপক্ষ পরাজিত হলে নিঃশেষ হয় না, সে নিঃশেষ হয় যখন সে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। রাশিয়া ভøাদিমির পুতিনকে খুঁজে পেয়েছিল, যিনি পরাজয় মেনে নেবেন না, এমনকি যখন তাঁর চারপাশে ‘একদা শক্তিমান ছিলাম’ ধারণার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছুই নেই, তখনো।

আমেরিকা অসম্ভবকে চেয়েছিল, রাশিয়া চেয়েছে সাধ্যাতীত। ওয়াশিংটন কখনই একুশ শতকের স্থায়ী অভিভাবক, গ্যারান্টার, গভর্নর, দার্শনিক এবং বিশ্বব্যাপী পুলিশ হতে পারে না। পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত অঞ্চলের কার্যকর প্রত্যাবর্তন চেয়েছিলেন। এটি অসম্ভব, আমেরিকান বাধার কারণে নয়, অঞ্চলটি মৌলিক অর্থে খুব বদলে গেছে বলেই। স্বাধীনতার মানে কী, তা পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগুলো মর্মে মর্মে অনুধাবন করছে।

ইউক্রেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতার সীমা কতটুকু তা বুঝতে পারছে আমেরিকান মিত্ররা।

ইউক্রেনের সংকট চলতি বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠন শুরু করতে পারে, কারণ বিংশ শতাব্দীর উভয় স্তম্ভ (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া) গরিমাহীন হয়ে যাচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ওয়াশিংটনের ওপর ভরসার জায়গাটায় বিরাট ধাক্কা লেগেছে। আমেরিকান মিত্ররা বার্তা পেয়েছে। তুফানের গতি এবং শক্তি নিয়ে কোনো সংকট এলে জো বাইডেন ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ দিয়ে ছিদ্রযুক্ত পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকবেন, ক্ষেপণাস্ত্র না ছুড়ে বিবৃতি দেবেন। পরাক্রমশালী পেন্টাগন এখন চারণভূমির ন্যাড়া স্যামসন। স্যামসনের গল্পের সেই পোড়ো বাড়িটিতে যারা আশ্রয় নেয় তাদের এর কাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে হয়। এর কোনো বিকল্প নেই আশ্রিতদের জন্য।

এ নীতি নিয়ে দ্ব্যর্থহীন অ্যালার্ম বাজানো প্রথম বিশ্বনেতা জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, যিনি অসুস্থতাবশত আট বছর পর ক্ষমতা ছেড়েছিলেন। কিয়েভের জন্য যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আবে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ওয়াশিংটনকে তাইওয়ান নিয়ে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ পরিত্যাগ করতে এবং চীন আক্রমণ করলে দ্বীপ অঞ্চল রক্ষার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি দিতে বলেছিলেন। তাঁর আরও পরামর্শ ছিল। আবে আরও বলেছেন যে, জাপান হচ্ছে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের শিকার একমাত্র দেশ, এখন তাকে অবশ্যই পারমাণবিক শান্তিবাদ ত্যাগ করতে হবে এবং ‘পারমাণবিক বাঁটোয়ারা’র দিকে অগ্রসর হতে হবে, ন্যাটোর লাইনে কিছু ব্যবস্থার অংশ হয়ে উঠতে হবে যা জাপানের ভূখন্ডে পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি অনুমোদন করবে। তাঁর কথাগুলো ছিল : ‘জাপান পারমাণবিক অস্ত্র প্রসারণ রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী এবং এর তিনটি অ-পরমাণু নীতি রয়েছে।’ তাই বলে দুনিয়াকে কীভাবে নিরাপদ করা যায়-বিষয়ক আলোচনায় জাপান বসতে কেন পারবে না! জাপানের নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর আউটসোর্স করা চলবে না। পারমাণবিক বোতামে জাপানের নিজের আঙুল থাকা প্রয়োজন।

শিনজো আবের যে অভিমত তাতে পারমাণমিক অস্ত্র প্রসারণ রোধ চুক্তি (এনপিটি) সমাপ্তির চেয়ে কম কিছুর ইঙ্গিত করে না। ভারত কখনই এনপিটি স্বাক্ষর করেনি। কারণ এ চুক্তি স্বেচ্ছাচারী এবং বৈষম্যমূলক। ঘটনাক্রমে, জাপানের পর্যাপ্ত ফিসাইল প্লুটোনিয়াম এবং এক বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরি করার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তিগত দক্ষতা রয়েছে।

আমেরিকা ও রাশিয়ার রেখে যাওয়া শূন্যতা পূরণ করে নেতৃত্বে আসতে পারে জার্মানি ও জাপান, সেখানে ফ্রান্স এবং ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও আসতে পারে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হবে, যা শিগগিরই কোনো না কোনো সময়ে জাতিসংঘের (ইউএন) ফাঁপা খোলসটি নাড়াচাড়া করবে। তারা অবশ্যই জাতিসংঘের সংস্কারকে গুরুত্ব দেবে। ওটা সর্বদা ভারত, জার্মানি এবং জাপানের কূটনৈতিক এজেন্ডার শীর্ষে থাকবে। বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদ অনেক আগেই তার উপযোগিতা হারিয়েছে এবং একটি মতানৈক্যের জন্য গলাবাজির ক্ষেত্র হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়ে ওঠেনি। রূপান্তর এক কৌতূহলী প্রক্রিয়া : কিছুই ঘটে না এবং তার পরে হঠাৎ সবকিছু ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান-রাশিয়ান-চীনা জোটের দ্বারা জার্মানি এবং জাপান যেভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে তা ঐতিহাসিক এবং করুণ ঘটনা। অভিজ্ঞতা জার্মানি এবং জাপানকে শিখিয়েছে যে, ফ্যাসিবাদ আত্মঘাতী এবং আধিপত্যবাদ মৃত; একবিংশ শতাব্দীকে অবশ্যই একটি অংশীদারভিত্তিক বিশ্ব দেখতে হবে যতটা সম্ভব বাস্তব উদার, গণতান্ত্রিক দিগন্তের মাধ্যমে। সুস্থিতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে উঠবে ভারত, কারণ দেশটি উদার সংবিধানবিশিষ্ট একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং এর সীমানা ও মূল্যবোধ রক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে।

বিশ্বব্যবস্থা রক্ষায় যে বর্ম তার সুরক্ষা প্রয়োজন। শিনজো আবে স্পষ্টবাদী ছিলেন; জার্মানি বিচক্ষণতা পছন্দ করে, কিন্তু জার্মানি আবার সামরিকীকরণ করবে দীর্ঘকাল কৌশলগত নির্বুদ্ধিতার পরে, যে নির্বুদ্ধিতা চরমে ছিল চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের জমানায়। মেরকেল ইস্পাত চোখ আর প্লাস্টিক মুষ্টি দিয়ে ১৬ বছর জার্মানি শাসন করেছেন। তাঁর শাসনামলে আর্থিক সংকট যখনই হয়েছে প্রতিবার প্রতিরক্ষা বাজেট কমানো হয়েছে, ছাঁটাই করে নেওয়া অর্থ আর পূরণ করা হয়নি।

ইউক্রেন আক্রমণের পর জার্মান সেনাবাহিনী প্রধান আলফোনস মাইস তাঁর হতাশা ধরে রাখতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন : ‘যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমি বিশেষ সুবিধা পেয়েছি, তাদের হাত কমবেশি খালি। জোটের (ন্যাটো) সমর্থনে আমরা যে বিকল্পগুলো দিতে পারি তা অত্যন্ত সীমিত।’ মাইস এখন আরও ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন বাজারগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, BAE সিস্টেমের শেয়ার, ফাইটার জেট এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রের নির্মাণ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বাজারে সত্যিকারের হেভি লিফটাররা ইতোমধ্যে বোর্ড মিটিংয়ে ব্যস্ত। বাজারই জানে বাজার কী করছে।

ব্রিটেন আওয়াজ দিয়ে তার দুর্বলতা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু সত্যকে ঝাঁকুনি দেবে একটি তথ্য : দেশটিতে সম্ভবত ২০০টি যুদ্ধ-প্রস্তুত ট্যাংক রয়েছে। তারা ইউক্রেনে পর্যাপ্ত মাইন পাঠাতে পারেনি কারণ তত বেশি মাইন ছিল না। ইউরোপ তার ১৯৪৫-পরবর্তী দীর্ঘ কোমা থেকে জেগে উঠবে, যে কোমাও তৈরি করে রেখেছে আমেরিকান নিরাপত্তা ছাতা নামক একটি মায়া। পুতিন এমন কা-ই করলেন যে, তাতে ইউরোপজুড়ে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়বে। তার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন করার পরে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন তার অর্জনগুলো রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি করতে হবে।

রাশিয়াকে তার বিকল্পগুলো পুনর্নির্মাণ করতে হবে, তাদের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে হবে। সম্ভবত ন্যাটো ইস্যুতে কিয়েভের কাছ থেকে যে প্রতিশ্রুতি চেয়েছে রাশিয়া, তা পাবে। তবে এর দুঃসাহসিকতা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলোয় একটি দুর্বল প্রভাব ফেলবে। মস্কো নিষেধাজ্ঞা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়, কারণ আমেরিকা বা ইউরোপ কেউই রাশিয়ায় উৎপাদিত গ্যাসের প্রবাহ বন্ধ করতে প্রস্তুত নয়।

গত ডিসেম্বরে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলার থেকে ১১০ ডলারের ওপরে যাওয়ার মানে রাশিয়া তার দৈনিক মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ করেছে। তদুপরি আমরা ভুলে যাই যে রাশিয়া অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম। দেশটিতে সি৪এফ৬ গ্যাসের বৃহত্তম মজুদ রয়েছে, দেশটি পশ্চিম সাইবেরিয়ার ‘টাইটানিয়াম উপত্যকা’ থেকে বিশ্বের বৃহত্তম টাইটানিয়াম উৎপাদক এবং প্যালাডিয়াম মজুদের একটি প্রধান অংশ রয়েছে (প্যালাডিয়াম সেন্সর এবং কম্পিউটার মেমোরির জন্য ব্যবহৃত হয়)। পুতিন জানেন যে, ২০১৮ সালে, পশ্চিমারা রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনকারীর বিরুদ্ধে অনেক ধুমধাম করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ধাতবটির দাম চড়ে গেলে চুপচাপ ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

১৯৭৫ এবং ১৯৯১-এর মধ্যে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থায় পুতিন তাঁর কর্মজীবনে পশ্চিমাদের মোকাবিলা করেছিলেন। ভুল অনুমানে যুদ্ধটি শুরু করেন পুতিন, কিন্তু তিনি জানেন যে, এটি বন্ধ হয়ে যাবে কারণ আমেরিকা এবং ইউরোপ ন্যাটো সদস্যদের জন্য যেভাবে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত, ইউক্রেনের জন্য সেভাবে নয়। তদুপরি, হেনরি কিসিঞ্জারের মতো আমেরিকায় এমন ঋষি আছেন যাঁরা ইউক্রেন সম্পর্কে মস্কোর উদ্বেগ বোঝেন। তবে পুতিনও বুঝতে পারবেন যে, ঘটনাগুলো তাঁর নাগালের বাইরে চলে গেছে।

যদি প্রতিটি যুদ্ধের ফল শুধু অভিপ্রেত রেখায় যেত, তবে ইতিহাস একটি ভিন্ন গল্প হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের জন্য একটি প্রতিযোগিতা হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং ছয় শতাব্দী ধরে ইউরেশিয়াকে নিয়ন্ত্রণকারী তিনটি সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিচিত বিদ্রোহীদের মধ্যে আরেকটি দ্বন্দ্ব হিসেবে শুরু হয়েছিল কিন্তু পশ্চিম এবং প্রাচ্য উভয় ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিকতাকে ভেঙে দিয়ে ওয়াশিংটন এবং মস্কোর নেতৃত্বে দুটি নতুন পরাশক্তির জন্য পথ তৈরি করে শেষ হয়েছিল। ইউক্রেন বিশ্বযুদ্ধ শুরু করবে না, তবু এ যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।

বিশ্ব আবার পরিবর্তনের ধারার মধ্যে এসেছে। তাই আশাবাদীরা আশায় বিনিয়োগ করতে পারেন।

                লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর