শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

কীভাবে বাঁচবে আমাদের সেই কুমিল্লা

গাজীউল হাসান খান

কীভাবে বাঁচবে আমাদের সেই কুমিল্লা

শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরীই নয়, কালের বিবর্তনে সারা দেশের বিভিন্ন প্রাচীন শহরগুলো ক্রমে ক্রমে এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। কুমিল্লাসহ কয়েকটি ঐতিহাসিক শহরকে এখন প্রশাসনিকভাবে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হলেও ইতোমধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে তাদের নগর জীবন। অপরিকল্পিত বিনির্মাণ ও সম্প্রসারণের ফলে পরিবেশগতভাবে অস্বস্তিকর ও অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে কুমিল্লা শহরের সামগ্রিক পরিবেশ! ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় তখনকার লোকসংখ্যা, যোগাযোগব্যবস্থা এবং অবস্থানগত কারণে যেসব শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সে দৃশ্যপট এখন আমূলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ থেকে দেশের জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল থেকে যে হারে শহর নগরে মানুষ স্থানান্তরিত হয়েছে, তার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে পরিকল্পিতভাবে ধারাবাহিক উন্নয়ন বা সম্প্রসারণ সাধিত হয়নি।

ফলে অপরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনীয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই বাসস্থান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তার ধারাবাহিকতায় প্রাচীন ঐতিহাসিক কুমিল্লা এখন একটি অবরুদ্ধ জঞ্জালের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কুমিল্লা হারিয়ে ফেলেছে তার দীর্ঘদিনের চিরাচরিত ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক শোভা এবং সামগ্রিক পরিবেশ। নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থল কিংবা বাণিজ্যিক এলাকায় গেলে বহু অপেক্ষার পরও যানজটকবলিত মান্ধাতা আমলের সংকীর্ণ রাস্তাগুলো এদিক থেকে সেদিকে পার হওয়া যায় না। তা ছাড়া পথচারী মানুষের ভিড়ে ফুটপাতে স্বাচ্ছন্দ্য গতিতে সামনে এগোনো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। শহরের বিভিন্ন অংশে বাসাবাড়ির সামনের রাস্তা সম্প্রসারণ কিংবা পয়ঃনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপারই বলা চলে। তার পরও দিন দিন বাড়ছে গ্রাম থেকে আগত শহরমুখী মানুষের ক্রমবর্ধমান চাপ।

বৃক্ষরাজি শোভিত ছায়াঘেরা সড়ক, উন্মুক্ত খেলার মাঠ এবং অসংখ্য বিশাল দিঘি ও পদ্মপুকুর নিয়ে গড়ে ওঠা কুমিল্লা শহর ব্রিটিশ রাজের আমলে আধুনিক রূপলাভ করে। তবে এর অনেক আগেই অর্থাৎ ষষ্ঠ শতকে কুমিল্লার প্রান্ত ঘিরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন, ‘শালবন বৌদ্ধবিহার।’ বর্তমান কুমিল্লা শহরের পশ্চিম ও দক্ষিণ প্রান্ত অর্থাৎ ময়নামতি ও লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে তখন ঘটেছিল এক ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠের বিস্তার। গুপ্ত বংশীয় সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের বিজয় বিবরণীতে বঙ্গের সমতট অঞ্চলের সেই সমৃদ্ধ লোকালয়ের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে চীন দেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সেই সমতট অঞ্চল সফর করে একটি তথ্যবহুল বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তখন কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত বড় কামতা ছিল সে রাজ্যের কেন্দ্রস্থল। তার বহু পরে এ কেন্দ্রটি স্থানান্তরিত হয়ে গড়ে উঠেছিল অপেক্ষাকৃত আধুনিক কুমিল্লা শহর। সে শহরই কালক্রমে আবার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য খ্যাতি লাভ করে। সেই শহর বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, আশরাফ উদ্দীন চৌধুুরী, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং শান্তি ও সুনীতিসহ শত শত কীর্তিমান মানুষের অবদানে আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে অঞ্চলে নওয়াব ফয়জুন্নেছা নারী জাগরণে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তা মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার চেয়ে কোনো অংশ কম নয়। তা ছাড়া কুমিল্লা শহর শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছে, সমগ্র বাংলা কিংবা উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে তা কোনো দিনই মুছে ফেলা যাবে না। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তার বংশধররা, উস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, শচীন দেব বর্মণ ও সুধীন দাসসহ অসংখ্য প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি কুমিল্লার সংগীতের জগৎকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। সে কারণে মুঘল শাসনামলের শেষদিক থেকে কুমিল্লা শহরকে বাংলার অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শহর বলা হতো। সে শহরে ‘বাংলা গানের বুলবুল’ কবি নজরুলের পদচারণা ছিল অবারিত। তা ছাড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্রে ছুটে এসেছিলেন বারকয়েক।

ঐতিহাসিক সেই কুমিল্লা শহরকে নিয়ে এত কথা বলার অর্থ একটিই, চারদিক থেকে অবরুদ্ধ এবং মৃতপ্রায় সে শহরের এখন একটি সর্বাত্মক পুনর্জাগরণ প্রয়োজন। তার মধ্যে নতুন করে শক্তিশালীভাবে একটি প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। সে শহরকে যুগোপযোগীভাবে নতুন করে স্থানান্তর কিংবা সম্প্রসারণ এবং তার যোগাযোগ ও আবাসিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কার্যক্রম ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন জোয়ার বইয়ে দেওয়া এখন একটি সময়ের দাবি মাত্র। সেই ঐতিহাসিক প্রাচীন শহরকে পর্যায়ক্রমে একটি আধুনিক মহানগরীর রূপ দিতে হবে। সে লক্ষ্যে এখন ‘কুমিল্লা বাঁচাও মঞ্চ’ নামে দল মত নির্বিশেষে একটি নাগরিক প্ল্যাটফরম গঠন করা হয়েছে। সে অরাজনৈতিক নাগরিক মঞ্চের উদ্যোগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা বীরেন্দ্র কিশোর নগর মিলনায়তনে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে সাবেক সংসদ সদস্য ও জননেতা মনিরুল হক চৌধুরী ‘স্বপ্নের মেগা সিটি’ শিরোনামে একটি ধারণাপত্র (কার্যপত্র) উপস্থাপন করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সমাজ সংগঠক আবদুল হক এবং প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ শেখ শহিদুল ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন স্থানীয় সরকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ ড. তোফায়েল আহমেদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট গাজীউল হাসান খান, বিশিষ্ট আইনজীবী এবং গ্রন্থপ্রণেতা গোলাম ফারুকসহ কুমিল্লার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সমাজসেবীরা। তা ছাড়া তাতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরাও ধারণাপত্রের ওপর মত প্রকাশ করেন। বক্তাদের অধিকাংশই বলেন, উত্তর ও দক্ষিণ কুমিল্লার দুটি পৌরসভা মিলিয়ে একটি সিটি করপোরেশন করা হয়েছে। তাতে এখন ৬৮ লাখ বাসিন্দা বসবাস করছেন। সেই সিটি করপোরেশনের পুরাতন উত্তরাংশের ব্যবস্থাপনার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ বা ব্যয় করা হয়েছে তার তুলনায় দক্ষিণাংশের জন্য বরাদ্দ অতি নগণ্য। কুমিল্লা মহানগরের পরিকল্পিত সম্প্রসারণপূর্বক বঞ্চিত পাঁচথুবী ও আমড়াতলী ইউনিয়ন এবং তৎসংলগ্ন এলাকার জন্য বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেওয়া জরুরি বলে মনিরুল হক চৌধুরী তার ধারণাপত্রে উল্লেখ করেন। তিনি তার দীর্ঘ ধারণাপত্রে কুমিল্লা সাউথ স্কোয়ার, পদুয়ারবাজার বিশ্বরোড ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে অবকাঠামোগত সংস্কার, উন্নয়ন ও বহুমাত্রিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলকে পৃথিবীর একটি অন্যতম সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক হাব ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল কেন্দ্রে রূপান্তরের পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি আশা করেন বর্তমান কুমিল্লা মহানগরী এক দিন লালমাই পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

কুমিল্লা সম্প্রসারণের নতুন পরিকল্পনায় জনগণের পাশাপাশি সরকারকে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। সে লক্ষ্যে জনাব চৌধুরী একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরির ওপর জোর দেন। তবে কুমিল্লা নগর উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা চলবে না। কুমিল্লা মহানগরের উত্তর সম্প্রসারণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পূর্ণাঙ্গ ৮ লেনে রূপান্তর, পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের পূর্বাঞ্চলকে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একট গুরুত্বপূর্ণ হাবে পরিণত করার ব্যাপারেও তিনি আলোকপাত করেন। সমৃদ্ধ কুমিল্লা গড়তে কুমিল্লা সাউথ স্কয়ার, আখতার হামিদ খান স্যাটেলাইট সিটি, উত্তর-পূর্ব লিঙ্ক, বিবিরবাজার এবং দক্ষিণ লিঙ্কে টমসম ব্রিজ, উত্তর-পূর্ব স্কোয়ার, চকবাজার এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে মনোযোগী হতে অনুরোধ জানান। তা ছাড়া কুমিল্লা নগরবাসীর ভোগান্তি নিরসনকল্পে জলাবদ্ধতা, পয়ঃপানি নিষ্কাশন এবং যানজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেন। অবিলম্বে কুমিল্লা নামে একটি বিভাগ বাস্তবায়ন, মেট্রোপলিটন নগরী গঠনপূর্বক মেট্রোপলিটন পুলিশ, বিচারিক আদালত, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ওয়াসা গঠনের কথাও উল্লেখ করেন। তা ছাড়া আরও একটি বিশেষ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে জনাব চৌধুরী বলেন, সড়ক বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত ‘রাজগঞ্জ থেকে নোয়াখালী-চৌমুহনী’ সড়কটি পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করে নির্বিঘ্ন সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে বৃহত্তর কুমিল্লা দক্ষিণ, বৃহত্তর নোয়াখালীর সামগ্রিক এলাকা কুমিল্লা দক্ষিণের মহানগরে প্রবেশ ও প্রস্থান সে অঞ্চলের জনগণের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে। কুমিল্লা মহানগরীর পরিকল্পিত সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন ছাড়া বর্তমান নগরী খুব শিগগির অচল হয়ে পড়বে। গ্রাম থেকে মানুষের অধিক হারে শহরে বা বর্তমান নগরীতে আসার কারণে পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি একটি অস্বাস্থ্যকর ও নিম্নমানের বসতি গড়ে উঠবে। তাতে পরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যাহত হবে, কাক্সিক্ষত সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। সে জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘কুমিল্লা বাঁচাও’ আন্দোলন শুধু কুমিল্লাকে বাঁচানোর জন্যই নয়, এটি সারা বাংলাদেশকে বাঁচানোর একটি আন্দোলন। কারণ কুমিল্লা শহর ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহরেরও এখন একই অবস্থা।

উপরে উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে, ‘কুমিল্লা বাঁচাও’ কার্যক্রমে জনপ্রতিনিধি এবং সরকার সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সুচিন্তিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা সরকারের নতুন বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখবে না। সে কারণেই কুমিল্লাকে একটি আদর্শ মহানগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হলে অন্যরাও তাতে উৎসাহিত হবে। রাজধানী ঢাকা কিংবা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে একটি পরিকল্পিত যোগসূত্র স্থাপিত হবে। সে জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি সুচিন্তিত এবং গবেষণালব্ধ উন্নয়ন পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনিরুল ইসলাম সাক্কু একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে হাত দিয়েছিলেন।

কিন্তু সেটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী প্রণীত ধারণাপত্রের (কার্যপত্র) নিরিখে একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি বলে দলমত নির্বিশেষে সবাই মত প্রকাশ করেছেন।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক [email protected]

সর্বশেষ খবর