শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমার দুঃখী ভাইটি

ইমদাদুল হক মিলন

আমার দুঃখী ভাইটি

কোনো কোনো মানুষ বড় দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। অযত্ন অবহেলা তাদের আমরণ সঙ্গী হয়ে থাকে। হয়তো এ বেদনাবোধ থেকে নিজের সম্পর্কে চরম উদাসীন হয়ে যায়। আমার ভাই বাদলের জীবনটাও ছিল তেমন। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে হঠাৎ হঠাৎ বাদলের কথা মনে পড়ে। পেছনে ফেলে আসা জীবনের কত স্মৃতি জেগে ওঠে মনের ভিতর। কৈশোরকালের সেই রাতটির কথা মনে পড়ে। গভীর রাতে প্রচ- কাশতে শুরু করল বাদল। এমন শব্দ কাশির, মনে হলো বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে পাঁচ সাত বছরের শিশুটির। কাশির দমকে শ্বাস নিতে পারছে না সে। কথা বলতে পারছে না। কাঁদতে পারছে না। বহুদূর পথ প্রবল বেগে ছুটে আসার পর যেমন করে হাঁপায় মানুষ, তেমন করে হাঁপাচ্ছে। বুজি খুবই ভয় পেয়ে গেলেন। বুজি মানে নানি। আমরা নানিকে ডাকতাম বুজি বলে। বাংলাদেশের কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে নানিকে বুজি বলে। আমাদের বিক্রমপুরেও বলে। বাদলের কাশির শব্দে একে একে ঘুম ভেঙেছে আমাদের সবার। ঘরে আমরা পাঁচজন মানুষ। বুজি পুনুআম্মা আমি বাদল আর গ্রামের এক অসহায় মহিলা, ফতির মা। ফতির মা আমাদের ঘরে কাজ করত কি না পরিষ্কার মনে নেই আমার। তবে রাতে যে আমাদের ঘরে থাকত তা মনে আছে। তার ছিল মৃগিরোগ। গভীর রাতে কখনো কখনো রোগটা চাগা দিত তার। অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাঁপতে থাকত সে। বাড়ির লোকে রোগটার নাম জানত না। বলত ‘ফতির মার ব্যারাম উটছে’। একবার রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কুপি হাতে বেরিয়েছে ফতির মা, ব্যারামটা উঠল। কাঁপতে কাঁপতে নিজের শাড়িতে আগুন ধরিয়ে ফেলল সে। ঘটনাটা আমার জন্মের আগের।

ফতির মাকে যখন থেকে দেখেছি, গলা এবং মুখের একটা দিক পোড়া দেখেছি তার। বোধহয় ফাতেমা নামে কোনো মেয়ে ছিল তার। সেই মেয়ের নামের একটা সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ফতি’ তার মাতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাম ধারণ করেছিল ফতির মা। বিক্রমপুর অঞ্চলে নাম ভাঙার এরকম একটি প্রবণতা আছে। মেদিনীমন্ডল গ্রামে যে হাজাম বাড়ি আছে সেই বাড়ির কয়েকজনের নাম আজিজ মজিদ শফি হাফিজদ্দি রব। কিন্তু এলাকার লোকরা বলত, আইজ্জা, মইজ্জা, শইপ্পা, হাইপ্পা, রবা। এই প্রবণতাটা প্রত্যেকের নামের ক্ষেত্রেই ছিল। ফতির মা হয়তো গ্রাম সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হবে। অসহায় বলে আমার বুজি তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

মেদিনীমন্ডল গ্রামের সেই বাড়ি আমার নানাবাড়ি। আমরা থাকতাম নানাবাড়িতে। আমার কোনো আপন মামা ছিল না। মা আর একমাত্র খালা পুনু আম্মা। খালা চাচি মামি ফুফুদেরকে ‘আম্মা’ বলে ওই অঞ্চলে। যেহেতু কোনো মামা নেই আমার সেহেতু মা খালাই নানার যাবতীয় সম্পত্তির মালিক। আর আমার বাবা ছিলেন অনাথ এতিম একজন মানুষ। মা বাবা ভাই বোন কেউ ছিল না তাঁর। সৎমা ছিলেন, সেই সংসারে তিনটি ভাই বোন ছিল। তাদের সঙ্গে বনিবনা ভালোই ছিল। তবু বাবা থাকতেন তাঁর এক চাচার কাছে। গ্রামের নাম ‘পয়সা’। লৌহজংয়ের পুবে। বিয়ের পর পাকাপাকিভাবে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন তিনি। বুজি প্রচ- ভালোবাসতেন বাবাকে। নিজের ছেলে ছিল না বলে ছেলের স্নেহ পুরোটা দিয়েছিলেন বাবাকে। বাবাকে আমরা ডাকতাম আব্বা। আজকের বিশাল সিটি করপোরেশান তখন সদ্য হয়েছে। নাম ছিল ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কমিটি’। সংক্ষেপে ‘ডিএমসি’। লক্ষ্মীবাজারে টিনের ঘরে অফিস। বাবা সেখানে চাকরি করেন। বাসা হচ্ছে জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। বাড়ি নম্বর সাত। এ বাড়িতে এক দুরন্ত বর্ষায় একটি বোনের হাত ধরে জন্মেছিল বাদল। অর্থাৎ যমজ ভাইবোন। বোনটির নাম পলি। ওদের জন্ম হয় আমার দুই বছর পর। মোট এগারোটি ভাই-বোন জন্মেছিলাম আমরা। একটি ভাই জন্মের আঠারো দিন পর মারা যায়। জন্মমুহূর্ত থেকে অসুস্থ ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে টানাটানি চলছিল বলে তার নাম রাখারও সুযোগ হয়নি। সেই ভাইটির মুখ আমার দেখা হয়নি। কারণ এতগুলো ছেলেমেয়ে সামলাতে পারতেন না বলে মা আমাকে বুজির কাছে, গ্রামে রেখেছিলেন। নানাবাড়িতে থেকে কাজির পাগলা হাইস্কুলে পড়তাম আমি। সেবার বাদলও ছিল বুজির কাছে। আমার নানাবাড়িটি তিন শরিকের। নানারা তিন ভাই। আমার নানা বড়, বাড়ির দক্ষিণের দিকটা তাঁর। পুবেরটা মেজো নানার, উত্তরেরটা ছোট নানার। জাহাজের মতো বিশাল বিশাল ঘর বাড়িতে। নানারা তিন ভাই-ই জাহাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বড় নানা মেজো নানা ব্রিটিশ জাহাজের সারেং, ছোট নানা কেরানি। আমার জন্মের অনেক আগে বড় নানা মারা যান। মেজো নানা রিটায়ার করে বাড়িতে ঘর গেরস্থালি করছেন, ছোট নানা তখনো চাকরিতে। থাকেন কলকাতায়। এক বছর পর পর শীতকালে বাড়ি আসেন। সেবার তিনি বাড়িতে ছিলেন। শীতকাল শেষ হতে চলেছে। এমন এক রাতে বাদল কাশতে শুরু করল। জন্মের পর থেকেই বাদল একটু কমজোরি, একটু পেটরোগা। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। অসুখ-বিসুখ তার লেগেই থাকত। এজন্য বুজির কাছে থাকলে বাদলকে নিয়ে বুজি খুবই উদ্বিগ্ন থাকতেন।

সেই রাতের উদ্বিগ্নতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। দেখতে দেখতে পুরো বাড়ি জেগে ওঠল। বুজি কান্নাকাটি শুরু করলেন। পুনুআম্মা হারিকেনের তাপে তেল গরম করে বাদলের বুকে পিঠে মালিশ করতে লাগলেন। কিন্তু বাদলের কোনো পরিবর্তন নেই। কাশি বাড়তেই লাগল। দুই নানা সিদ্ধান্ত নিলেন ডাক্তার আনতে হবে। বাড়ির কাছে মনীন্দ্রঠাকুর আছেন, ডাক্তার, তবে পাস করা নন। তবু চিকিৎসা ভালো করেন। কেন যে সেই রাতে তাকে ডাকা হলো না। শীতবস্ত্রে শরীর ঢেকে, এক হাতে লাঠি আরেক হাতে হারিকেন, আমার দুই নানা এবং মায়ের চাচাতো ভাইদের কেউ কেউ কাজির পাগলা রওনা দিলেন। কাজির পাগলার বিখ্যাত ডাক্তার জলধর, সেই শীতরাত্রির দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় যামে জলধরকে আনা হলো। জলধর ডাক্তারের কল্যাণে নিউমোনিয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল বাদল। দিন সাতেক পর উঠে দাঁড়াল।

এভাবে প্রথম মৃত্যু আক্রমণ করেছিল বাদলকে। দ্বিতীয় মৃত্যু বাদলকে আক্রমণ করে সাতাত্তর সালে। গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডে লঞ্চ কোম্পানির বাড়ি নামে পরিচিত বাড়িটায়, পুরনো আমলের একটি দোতলা কাঠের ঘরের দোতলায় থাকি আমরা। বিশাল বিল্ডিংয়ের ঘেরাটোপের ভিতর ওরকম একটি কাঠের ঘর আছে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বাড়িটির আদি মালিক ছিলেন বিক্রমপুরের ওয়াহিদ সাহেব, লঞ্চের ব্যবসায় যিনি খুব বিখ্যাত ছিলেন। এজন্যই বাড়ির নাম হয়েছিল ওয়াহিদ কোম্পানির বাড়ি কিংবা লঞ্চ কোম্পানির বাড়ি। ওয়াহিদ সাহেবের এক ছেলে গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ। আমরা যখন ওই বাড়িতে থাকি তারও অনেক আগে শাজাহান সাহেব নামে এক ভদ্রলোক বাড়িটি কিনে নেন। যা হোক বাড়িওয়ালা এবং কোনো কোনো ভাড়াটের গাড়ি সার ধরে থাকত গ্রাউন্ডের ভিতর। একপাশে বাইরের দিককার দেয়াল আরেক পাশে বিল্ডিংয়ের দেয়াল, মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়িগুলো। লোকজনকে বেরোতে হয় গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে। দুপুরের মুখে মুখে বাদলও ওরকম বেরুচ্ছিল। বাদলের হাঁটাচলা ছিল ধীর, শান্ত ধরনের। এবং মানুষের জন্য ছিল তার অপরিসীম মায়া মমতা, টান ভালোবাসা। নিজের দিকে না তাকিয়ে মানুষের কাজ করে দেওয়ার অসাধারণ এক গুণ ছিল তার। সেদিন বাদল বেরোচ্ছিল আমার ছোট নানার মেজো ছেলে হামিদ মামার কোনো কাজে। সঙ্গে হামিদ মামাও ছিলেন। বাদল আগে আগে হাঁটছে, হামিদ মামা তার পেছনে, একটু দূরে। এক ভাড়াটের গাড়ি পরিষ্কার করার ছলে ড্রাইভারকে ম্যানেজ করে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছিল কাজের ছেলে। আচমকা স্টার্ট হলো গাড়ি এবং প্রবল গতিতে বিল্ডিংয়ের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল। বাদলের কী দুর্ভাগ্য, সে পড়ে গেল মাঝখানে। দুই পায়ের হাঁটু প্রায় গুঁড়িয়ে গেল বাদলের।

পঙ্গু হাসপাতাল এবং রজনী চৌধুরী রোডের সেই বাড়িতে বহুদিন পড়ে থাকল বাদল। প্রায় অথর্ব। চার-পাঁচ মাস পর আবার উঠে দাঁড়াল। কিন্তু মৃত্যুর তৃতীয় ছোবল বাদলকে আর দাঁড়াতে দেয়নি। বিরানব্বই-তিরানব্বই সালের দিকে গোপনে ডায়াবেটিস হলো বাদলের। গোপনে বলছি এজন্য, প্রথমদিকে বাদল কাউকে জানতে দেয়নি। নিজের মতো করে চলত, খেত। কারও কথা তেমন শুনতে চাইত না সে। যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যেত। আমরা চিনি না এমন লতায় পাতায় আত্মীয় খুঁজে বের করত। নিয়মিত যাতায়াত করত সেসব আত্মীয়বাড়ি। তাদের সামাজিক কাজকর্মে বাদল সবার আগে। নিজের পকেটের পয়সা খরচা করে অমুকের মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করছে, তমুকের বাড়িতে বাজার করে দিচ্ছে। নিজের পকেটে টাকা না থাকলে ধার করেও এসব কাজ করত। এক সময় সিটি করপোরেশনে কন্ট্রাকটারি করেছে। ব্যবসার ঘোরপ্যাঁচ, ছলচাতুরি তেমন বুঝত না বলে একটি লোক বাদলকে যাচ্ছেতাই রকমের ঠকায় এবং একেবারেই নিঃস্ব করে দেয়। তার পরও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা বাদলের কখনো কমেনি। প্রচুর বন্ধুবান্ধব ছিল বাদলের। লোকে কী যে ভালোবাসত তাকে! ডায়াবেটিস যখন বেশ কাবু করে ফেলে তখন বারডেমে যাতায়াত শুরু করে সে। মায়ের সঙ্গে গেন্ডারিয়াতে থাকত। প্রেম বিয়ে কোনো কিছুই করা হয়নি। আমরা একেকজন একেকদিকে, সুতরাং বাদলকে দেখেশুনে রাখার তেমন কেউ ছিল না। আমার সেজবোন ডলির স্বামী থাকে বিদেশে। দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে মায়ের কাছে থাকে ডলি। যতটা সম্ভব বাদলকে সে আগলে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু ছোটবোনের কথা তেমন পাত্তা দিত না বাদল। ডায়াবেটিস একটু কন্ট্রোলে এলে আবার অনিয়ম। এই করে করে পঁচানব্বই-ছিয়ানব্বই সালের দিকে একবার বিছানা থেকে আর উঠতে পারে না। আমার একেবারে ছোটভাই খোকন তখন আমেরিকায়। আমি আমার এক খালাতো ভাই ডালু, বোনজামাই মাওলা মান্না দুলাল সবাই মিলে বারডেমে নিয়ে ভর্তি করালাম বাদলকে। আমার প্ল্যান ছিল পুরোপুরি ভালো করে বাড়ি নিয়ে যাব ওকে। কদিন পর শুনি বাদল পালিয়ে বাড়ি চলে গেছে। আমার খুব রাগ হলো। আমি আর বাদলের খবর নিই না, বাদলের ওপর রাগ করে মার বাসায় যাই না। আমার বড় বোন মনি তার দুই মেয়ে এবং স্বামী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায়। দুলাভাই তখন ঢাকায়। মায়ের বাসায় এসে তিনি আমাকে খবর দিলেন। যাওয়ার পর বাদল আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমার ভুল হয়ে গেছে। দুলাভাই বললেন, ওর শরীর খারাপ। ওকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করো। আবার বারডেমে ভর্তি করালাম বাদলকে। প্রায় মাসখানেক বারডেমে থেকে ভালো হয়ে বাড়ি ফিরল সে। সেই সময়, বাদলের হাসপাতাল বাসের দিনগুলোর শেষদিকে খোকন এলো আমেরিকা থেকে, ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য আমার পাশে দাঁড়াল। এভাবে বাদলকে নিয়ে আমাদের দিন কাটছিল। সাতানব্বইয়ের মাঝামাঝি একদিন স্পাইনালকডে ব্যথা শুরু হলো বাদলের। প্রচ- ব্যথা। উঠে দাঁড়াতে পারে না সে। শান্তিনগরে আমার পরিচিত একটা ক্লিনিক আছে, গার্ডেন ক্লিনিক। সেখানে নিয়ে গেলাম। এক্স-রে ইত্যাদিতে জানা গেল স্পাইনালকডে টিবি হয়েছে। তিন চার মাস সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। একদিকে ডায়াবেটিস আরেকদিকে স্পাইনালকডে টিবি, খুবই মুমূর্ষু অবস্থা আমার ভাইটির। দিন বিশেক ক্লিনিকে থেকে বাড়ি ফিরে গেল সে। সারাক্ষণ শুইয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। দেখাশোনার জন্য বারেককে রেখে দিলাম আমি।

সত্তর সাল থেকে বারেকের মা আমাদের সংসারে কাজ করে। বারেককে কোলে নিয়ে ঢুকেছিল। এখনো আছে। কিন্তু বারেক নেই। ১৮/১৯ বছর বয়সে বিয়ে করে ঘোরতর সংসারি সে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে। কিছুদিন আগে নানাও হয়ে গেছে। এখন মিরহাজিরবাগ বস্তিতে থাকে, রিকশা চালায়। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনে ডাকলেই বারেককে পাই। বাদলকে দেখাশোনার জন্য রিকশা চালানো ছেড়ে দিল বারেক। আমিও তখন গেন্ডারিয়াতে থাকি। প্রতিদিন একবার বাদলকে দেখতে যাই। বাড়ি ফিরে আসার দিনবিশেক পর বাদল আমাকে একদিন বলল, মিলনদা, আমার শরীরটা খুব চুলকায়। মাথাটা কেমন ঘোরে। আমার ভাইবোনরা আমাকে সবাই মিলনদা বলে ডাকে। আসমা, সবচেয়ে ছোটবোন, এখন ক্যালিফোর্নিয়ার গ্লেনডেলে থাকে, সে আমার নামের লয়ের উচ্চারণটা আর করে না। আসমা আমাকে বলে ‘মিনদা’। সেদিন বাদলের কথা শুনে আমার মনে হলো, তাই তো, প্রায় দেড় মাস বাদল গোসল করে না বলেই শরীরে এই অস্বস্তি ওর। বারেককে নিয়ে বাদলের গোসলের ব্যবস্থা করলাম। কোলে করে বাথরুমে নিয়ে, চেয়ারে বসিয়ে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করালাম। গোসলের পর একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেল বাদল। নিজের বিছানায় এসে বলল, আমি একটু বসি? শুনে আমার এত মায়া লাগল। বললাম, বস। বসেই আমার দিকে তাকাল সে। মিলনদা, আপনি আমার কাছে আসেন। গেলাম। শিশুর মতো দুহাতে আমার পেটের কাছটা জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। বললাম, কাঁদছিস কেন? তোর কোনো কষ্ট হচ্ছে? মাথা নেড়ে না বলল। আসলে বাদল তখন কাঁদছিল শারীরিক আরামে। এতদিন পর গোসল করার ফলে শরীর ঝরঝরে লাগছিল ওর। গোসলের ব্যবস্থাটা আমি করেছিলাম বলে ওভাবে জড়িয়ে ধরে আমার কাছে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিল। কৃতজ্ঞতার ভাষা ছিল চোখের জল।

এভাবে দিন কাটছিল। আটানব্বইয়ের সাতই মার্চ সকালবেলা ডলির ছেলে শাওন ছুটতে ছুটতে এলো আমার ফ্ল্যাটে। বাদল মামার শরীর খুব খারাপ। রাত তিনটার দিক থেকে কেমন করছে। প্রায়ই হাতপা বাঁকা হয়ে আসছে। ছুটে গেলাম। বাদল তখন মার রুমে থাকে। এক খাটে মা, আরেক খাটে বাদল। গিয়ে দেখি দরজার দিকে পেছন ফিরে নিজের খাটে শুয়ে আছে বাদল। আমি গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাকলাম, বাদল। বাদল। মাথা ঘুরিয়ে আলতো করে তাকাল। তাকিয়ে কী কী বলতে লাগল কিন্তু একটি কথাও আমি বুঝলাম না। আমার আটশো সিসির মারুতি মায়ের বাসার সামনে রেখে নিজের ফ্ল্যাটে এসেছি, বাদলকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছি, শাওন আবার ছুটতে ছুটতে এলো। বাদল মামা বমি করছে, আর হাত পা ওরকম বাঁকা হয়ে আসছে। দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি ডালু ডলি বারেক ওরা ততক্ষণে বাদলকে আমার গাড়িতে তুলে ফেলেছে। বাদলের জ্ঞান নেই। মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে। গার্ডেন ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। তখন অভিজ্ঞ কোনো ডাক্তার ছিল না। সদ্য পাস করে বেরিয়েছে এমন একজন ডাক্তার দেখছে বাদলকে, ঠিক সেই সময় হাত পায়ে ওরকম খিঁচুনি হতে শুরু করল, মুখে ফেনা, কী যে অসম্ভব যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগল আমার ভাই। একসময় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল তার। আমি চিৎকার করে বললাম, বুকে পাম্প কর। সেই ডাক্তার ডালু খোকন যে যেভাবে পারে পাম্প করতে লাগল। ডলি তখন শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদছে। তরুণ ডাক্তারটিও ততক্ষণে নার্ভাস হয়ে গেছে। বলল, বোধহয় হার্ট অ্যাটাক। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান। ক্লিনিকের অ্যাম্বুলেন্সে তুললাম বাদলকে। সেই মুহূর্তে আবার ওরকম একটি খিঁচুনি। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, আমার ভাইটি মারা গেল। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা বলল, হার্ট অ্যাটাক নয়, ঢাকা মেডিকেলে নয়তো কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যান। নিয়ে এলাম মনোয়ারা হাসপাতালে। হাসপাতাল এ ধরনের রোগী গ্রহণ করতে রাজি হলো না। অ্যাম্বুলেন্স ঘুরে গেল ঢাকা মেডিকেলের দিকে। এসব হাসপাতাল যারা কখনো ফেস করেননি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না, একজন রোগীকে এসব জায়গায় ভর্তি করানো কী জটিল এবং বেদনাদায়ক। যাই হোক আমি পারলাম। বাদলকে একটা ওয়ার্ডে দেওয়া হলো। স্ট্রেচারে করে বাদলের জন্য পাওয়া সিটের দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, দূরে একটি টেবিল ঘিরে ইন্টার্নি করছেন এমন ডাক্তার, ছেলেমেয়েরা বসে গল্প গুজব করছেন। আমি তাদের কাছে ছুটে গিয়ে বললাম- আমার নাম ইমদাদুল হক মিলন। আমার ভাইয়ের এই অবস্থা। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। আমি তাদের কাছে গভীর কৃতজ্ঞ। পুরো দলটি ছুটে এলেন। জানা গেল বাদলের ওই খিঁচুনির নাম ‘হাইপো’ এবং বাদল ততক্ষণে ‘ডায়াবেটিক কোমায়’ চলে গেছে। পরদিন সকালবেলা একজন প্রফেসর দেখলেন বাদলকে। সেই সময় আমি দাঁড়িয়ে আছি প্রফেসরের পাশে, হঠাৎ করে চোখ মেলল বাদল। চোখ মেলে অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে কেমন চঞ্চল হয়ে গেল। কথার বলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই মুখ দিয়ে শব্দ হচ্ছে না তার। শেষ পর্যন্ত কথা বলতে না পেরে অসহায় হাত দুটো তুলে আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে লাগল। একে একে আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা সবাই তখন আসছে। বাদলের যমজ পলি বসে আছে বাদলের শিয়রে। চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে তার। ওয়ার্ডের বারান্দায় একটা বেঞ্চ পাতা। আমি গিয়ে সেই বেঞ্চে বসে থাকি। বাদলকে নিয়ে ফেলে আসা দিনের কত স্মৃতি যে মনে পড়ে! দুই-একদিন পর বাদল থেকে থেকে কেমন চিৎকার চেঁচামেচি করে ওঠে। দুই-একটি বাক্য পরিষ্কার বলে ফেলে। আমাদের মনে আশা জাগে, বাদল বুঝি ভালো হয়ে গেল। কিন্তু ডাক্তারদের মুখে কোনো আশার আলো দেখি না। চৌদ্দ তারিখ বিকালের দিকে বাদলের অবস্থা এমনই নিস্তেজ, আমি বুঝে গেলাম আজ রাতটি হয়তো ভোর করতে পারবে না আমার ভাই। একজন তরুণ ডাক্তার ছিলেন ডিউটিতে, তিনি বললেন, সম্ভব হলে বারডেমে নিয়ে যান, একটা শেষ চেষ্টা করুন। রাত এগারোটার দিকে আমি খোকন পলির জামাই মাওলা হামিদ মামা আমার মামাতো ভাই লুৎফর, কাইয়ূম, আমার নাটকে অভিনয় করে শহিদ আলমগীর, জাহাঙ্গীর আমরা ছুটে গেলাম বারডেমে। রিসেপশনের একজন ডাক্তারকে খুলে বললাম সব। ভদ্রলোক এত সহৃদয় ব্যবহার করলেন। ভিভিআইপিদের জন্য আইসিইউতে একটা সিট সব সময় রাখা থাকে, সেটি ম্যানেজ করে দিলেন তিনি। আধা ঘণ্টার মধ্যে বাদলকে আমরা বারডেমে আইসিইউতে নিয়ে এলাম। এখানকার ব্যবস্থা দেখে মনে আশা জাগল, বাদল ভালো হয়ে যাবে। তখন পালা করে বাদলের কাছে থাকে খোকন হামিদ মামা, বারেক, আমাদের গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার হাসান আমার পিয়ন রফিক। দিনেরবেলা ঘুরে ফিরে আমরা সবাই। যে ক’রাত বাদলের কাছে ছিলেন, সারা রাত বাদলের শিয়রে একটা টুল নিয়ে বসে থাকতেন হামিদ মামা। কোনো কোনো রাতে তিনটার দিকে নাকি সামান্য জ্ঞান ফিরত বাদলের। মামার সঙ্গে টুকটাক কথা বলত সে। কিন্তু দিনেরবেলায় বাদলের আর কখনো জ্ঞান ফেরেনি। আমি গিয়ে উন্মুখ হয়ে বসে থাকতাম, যদি বাদল একটু তাকায়, একটু কথা বলে আমার সঙ্গে। তবে বাদলের সামনে বেশিক্ষণ থাকতে পারতাম না আমি। আমার বুক তোলপাড় করে উঠতো, চোখ ফেটে আসতো তীব্র কষ্টের কান্নায়।

শেষদিকে আইসিইউ থেকে চৌদ্দতলার ওয়ার্ডে দেওয়া হলো বাদলকে। ঘোরের ভিতর দুই-একদিন চৌদ্দতলায় হেঁটে উঠে গেছি আমি। একপলক বাদলকে দেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। নিচে চলমান ঢাকা শহর, লাখ লাখ মানুষ। ওপরে নিঃসীম নীল আকাশ। এসবের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য এক অনুভূতি হতো। পলির হাত ধরে এ পৃথিবীতে এসেছিল বাদল। এখন তাকে চলে যেতে হচ্ছে একা। বাদল চলে গেল চব্বিশে মার্চ। তখন বিকাল চারটা দশ। দুপুর থেকেই নিস্তেজ হয়ে আসছিল সে। একে একে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে তার চারপাশে। মুহূর্তের জন্য আমিও দাঁড়িয়েছিলাম। বাদল তখন জীবনের শেষ শ্বাস টানছে। সেই দৃশ্য আমি সইতে পারি না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু আমার কান্না পায় না। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। আমরা এতগুলো ভাইবোন জড়াজড়ি করে বেঁচে ছিলাম, আজ একজন বিদায় নিল। আমার ‘প্রিয়’ উপন্যাসে বাদলের কথা লিখেছি। বইটি বাদলকে উৎসর্গ করা। উৎসর্গপত্রে লিখেছি- ‘বাদল, আমার ভাই, তোর কথা আমি কেমন করে ভুলি’।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর