ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস সুইজারল্যান্ডের একটি মিডিয়াতে সম্প্রচারের জন্য একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। কিন্তু তা আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারের আগেই প্রকাশ হয়ে যায়। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনের শান্তি আলোচনার সাহস থাকা উচিত। মৃত্যু ও ধ্বংস বন্ধ-রোধে তাদের সেটা করা উচিত। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হওয়ার পর ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ‘ন্যায়সংগতভাবে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তির উপায় হচ্ছে, পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরানো।  তাকে গণহত্যাকারী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘অত্যাচারীর পতন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি আসবে না।’ 

গার্ডিয়ানের মতামত কলামে সাইমন ট্রিসডেল বিষয়টি তুলে ধরে একটি বিশ্লেষণ হাজির করেন। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে পশ্চিমাশক্তি প্রধান যুক্তিটি তুলে ধরে, তা হলো- ‘রাশিয়ার এই আগ্রাসনকে যদি প্রতিহত করা না যায়, তাদের পরাজয় যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে পৃথিবীর কোনো দেশ নিরাপদ থাকবে না। রাশিয়ার এই কর্ম বৈধ হলে বিশ্বে এই উদাহরণ তৈরি হবে যে, যার ক্ষমতা আছে সে শক্তি দিয়ে যে কোনো দেশ-অঞ্চলকে দখল করে নিতে পারবে’। সাধারণ যুক্তিতে তাদের এ বক্তব্য যুক্তিসংগত মনে হলেও বিষয়টি কি আসলে এতটা নিরীহ ও সরল? মোটেই তা নয়।

কাহিনি নিশ্চয়ই অন্য কিছু? এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি হোক সেটা পশ্চিমারা চায় না, তাকে তারা মেনে নেবে না। সেটাই এই দ্বন্দ্ব ও শত্রুতার মূল কারণ নয় কী?

ম্যাক্রোঁর বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, তারা পুতিনের পতন চান, প্রত্যাশা করেন। তাঁরা কি শুধু সেই কথা বলে ক্ষান্ত? সেই চেষ্টা কি করেননি, করছে না? তাঁরা পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যত তৎপর, পুতিন তত শক্তপোক্ত হয়ে ক্ষমতায় জেঁকে বসছেন। সেখানে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি পুতিনের এককেন্দ্রিক শাসন ও ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকাকে সমর্থন করি না। কিন্তু এটা তো মানতে হবে যে, রাশিয়ায় তার জনপ্রিয়তা আছে। তারা মনে করেন, এ মুহূর্তে রাশিয়ার তার কোনো বিকল্প নেই। সে দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাকে সমর্থন করে। রুশ জনগণ মনে করেন পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিভক্ত ও ক্ষতি করতে তাদের অনুগত শাসক চায়। তারা বিশ্বশক্তি হিসেবে রাশিয়ার উত্থানকে ঠেকাতে চায়। সুতরাং রাশিয়ার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পুতিনের হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। সর্বশেষ মধ্য মার্চের তিন দিনের নির্বাচনের ফলাফল সে কথাই প্রমাণ করেছে। পশ্চিমারা মনে করে, পুতিনের দেশে তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই। তিনি গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছেন। বিষয়টি কি আসলেই তাই?

কিন্তু পুতিনের পতন কবে, কীভাবে হবে? তারা কি সেটা বলতে পারেন? আপাতত ২০৩০ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর ক্ষমতায় থাকাকে নিশ্চিত করেছেন। যদি কোনো দৈব না ঘটে তিনি আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তার মানে ইউক্রেনকে আরও আগামী পাঁচ বছর যুদ্ধ টেনে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারপরও সেটা শেষ হবে- তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাহলে? যুদ্ধের দুই বছরেই পশ্চিমাশক্তি হাঁফিয়ে উঠেছে। মার্কিন সাহায্য আটকে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের টানাপোড়েন, ন্যাটোতে দ্বিধা ইত্যাদি। সম্প্রতি জেলেনস্কিই তার বক্তব্যে এমন অভিযোগ, অভিমানের কথা উল্লেখ করেছেন। যে মার্কিন নেতৃত্বে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রযোজিত হচ্ছে, সেখানেও পরিবর্তন অত্যাসন্ন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাইডেনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প যুদ্ধ ও সাহায্য বন্ধের আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। জেলেনস্কি সে কারণে মিডিয়াতে তার উদ্বেগের কথাও প্রকাশ করেছেন।

পুতিনের পতন হলে ইউক্রেন যুদ্ধ হবে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান- সেই সুখ-স্বপ্নের ঘোরে ম্যাক্রোঁ, জেলেনস্কিরা থাকুক। কিন্তু ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা করে ধুলায় মিশিয়ে দিল, কিমা-গ্রিল বানিয়ে ফেলল সেটা বন্ধ হবে কীভাবে, কার পতনে? কার কোমরের শক্তিতে নেতানিয়াহু এতটা বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন? জাতিসংঘ ও বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে? জাতিসংঘের কারা, কোন শক্তি চারবার ভেটো প্রদান করল? তাহলে সেই শক্তির পতন না হলে কী গাজার মুক্তি আসবে না?

সাইমন টিসডেলরা সে কথা বলেন না, লিখতে পারেন না, তাদের দম ফুরিয়ে যায়। গাজার যুদ্ধ শুরু হয়েছে গত বছর ৭ অক্টোবর। তার মনে এই যুদ্ধ চলছে প্রায় ছয় মাস। আর ইউক্রেনের যুদ্ধ তিন বছরে পড়ল। ইসরায়েলের হামলা-আক্রমণে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩২ হাজারের ওপরে আহতের সংখ্য প্রায় ১ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ নারী-শিশু, সাংবাদিক শতাধিক, মানবাধিকার কর্মী কয়েক শ যাদের সঙ্গে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীনতার এমন কোনো নজির নেই যে, মার্কিন সমর্থিত এই ইসরায়েল শাসক গাজায় করেনি।

২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার ৭০৩ জন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৫৯৪ জন। দুই বছরে রুশ বাহিনীর আক্রমণে যে পরিমাণ ইউক্রেনি নাগরিক নিহত হয়েছে ছয় মাসে তার তিন গুণ নিহত হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে গাজায়। তাহলে এই যুদ্ধ দুই বছর টানলে নিহতের সংখ্যা কত হবে? সে কথা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। তার মানে তাদের উদ্দেশ্য কী? ইউক্রেনে শান্তি না পুতিনের পতন? পুতিনের পতন না হওয়া অবধি কি হত্যা, ক্ষতি, ধ্বংস অব্যাহত থাকবে?  মানচিত্র থেকে দেশটাকে মুছে ফেলে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে? সেটা কি সম্ভব? রাশিয়া কি ইরাক, লিবিয়ার মতো কোনো দেশ? পুতিন কি সাদ্দাম-গাদ্দাফির মতো কোনো শাসক-নেতা? কিন্তু তারা স্বপ্ন দেখেন মাটির কোনো গর্ত বা মরুভূমির ধুলো থেকে তাকে আবিষ্কার করবেন? পুতিনের তর্জনি উঁচানো হুংকার কি পশ্চিমারা বুঝতে অক্ষম? এতটা নাদান কি তারা? তাহলে কীসের ভরসায়, কোন ছকে-সিংহের সামনে মেষ শাবককে ছেড়ে দিলেন?

                লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক