মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

রোজা শেষেও রেশ থাকুক নেক আমলের

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রোজা শেষেও রেশ থাকুক নেক আমলের

মাহে রমজানের এক মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিটি মুমিনেরই আত্মপর্যালোচনা করা উচিত, আমি কতটুকু মুত্তাকি তথা আল্লাহ সচেতন হতে পেরেছি। রমজানের আগের জীবন আর রমজান-পরবর্তী জীবনের আচার ব্যবহার, চালচলন, কথাবার্তায় আমার বিশেষ কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না। আল্লাহর হক ও বান্দার হকের ব্যাপারে আগে যদি উদাসীন থাকি, রমজানের প্রশিক্ষণ শেষে যত্নবান হতে পেরেছি কতটুকু? আগে যদি এসব বিষয়ে যত্নশীল থাকি তাহলে এ রমজানে আন্তরিকতা কতটুকু বেড়েছে। পূর্ববর্তী আল্লাহর ওলিগণ মাহে রমজানের শেষ দশক থেকেই এ ধরনের আত্মপর্যালোচনায় নিমগ্ন হতেন। নিজের পক্ষ থেকে যথার্থ ইবাদত-বন্দেগি করার পরও চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মাবুদের দরবারে বলতেন, হে পরওয়ারদিগার! তোমার বিশেষ মেহমান রমজানের যথার্থ সম্মান আমি করতে পারিনি। আগামী রমজান পর্যন্ত হায়াত পাব কি না জানি না। এ রমজানে যদি তোমার ক্ষমা-রহমত ভাগ্যে না জুটে তাহলে অন্ধকার কবর দেশে কীভাবে আলোর দেখা পাব। এভাবে কেঁদেকেটে মাবুদের দরবারে তারা প্রিয় থেকে আরও প্রিয় বান্দার মাকামে উঠে যেতেন।

আফসোস! আজকাল আমরা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, কখন রমজান আসে কখন চলে যায় বুঝতেই পারি না। রমজান আসবে আসবে করতে করতে হুট করে একদিন পশ্চিম আকাশে বাঁকা চাঁদ মাহে রমজানের খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে দেয়- রমজান এসেছে। তখনো আমাদের হুঁশ হয় না। ইবাদত করব করব করে কেটে যায় রমজানের প্রথমার্ধ। তারপর আসে ঈদের আমেজ। ঈদের নানান ধরনের প্রস্তুতি থাকে আমাদের। দেখতে দেখতে শাওয়ালের চাঁদও আকাশে উঁকি দিয়ে বলে দেয়, আলবিদা মাহে রমজান। হায়! তখনো গাফিলতিতে ডুবে থাকে আমাদের আত্মা-মন-মস্তিষ্ক।

প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজা রেখে তোমাদের কেউ যেন অশালীন ও অর্থহীন কথাবার্তা উচ্চারণ না করে। কেউ যদি তাকে উদ্দেশ্য করে অশালীন কথাবার্তা উচ্চারণ করে কিংবা তার সঙ্গে বাদানুবাদ-ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতে চায় সে যেন জবাবে এ কথা বলে দেয়, ‘আমি রোজাদার।’ (বুখারি) আরেকটি হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে রোজা রাখল অথচ মিথ্যা বলার অভ্যাস এখনো তার রয়ে গেছে, জেনে রেখো, তার না খেয়ে থাকা আল্লাহর কাছে সিয়াম হিসেবে কবুল হবে না। বরং এভাবে না খেয়ে থাকাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজনও নেই।’ (বুখারি) আরও কঠিন কথা রসুল (সা.) বলেছেন, ‘এমন অনেক রোজাদার আছে, যার রোজা কবুল হয় না, শুধু না খেয়ে থাকার কষ্টই তার ভাগ্যে জোটে। আবার এমন অনেক রাতজাগা ইবাদত-গোজার মানুষ আছে, যার ইবাদত, সালাত, তেলাওয়াত কিছুই কবুল হয় না, শুধু বিনিদ্ররজনী কাটানোর কষ্টই সে ভোগ করে।’ (বুখারি)। পবিত্র কোরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ মনে করা হয় বুখারি শরিফকে। সে গ্রন্থের এ তিনটি হাদিসই আমাদের আত্মপর্যালোচনার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করি। মাহে রমজানকে বিদায় দিয়ে আমাদের প্রতি মুহূর্তেই খতিয়ে দেখতে হবে, আচার-আচরণ, কথাবার্তায় কোথাও মিথ্যার জীবাণু আছে কি না। আমাদের চরিত্রে কোথাও ঝগড়া-ফ্যাসাদ করার প্রবণতা লুকিয়ে আছে কি না। শুধু মুখে বললেই মিথ্যা হয় না, মিথ্যা দেখে চুপ থাকলেও মানুষ মিথ্যাবাদীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলেও মানুষ মিথ্যাবাদী হয়। সুতরাং আমাদের দেখতে হবে, এক মাসের সিয়াম সাধনা আমাদের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা মিথ্যা নামক পাহাড়টাকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পেরেছে কি না। যদি পারে তাহলেই আমাদের সিয়াম সাধনা সার্থক হয়েছে, কবুল হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।

আর যদি মিথ্যার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থেকেই যায়, তাহলে রমজান শেষেও সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে মিথ্যা থেকে দূরে রাখার জন্য সজাগ-সচেতন থাকতে হবে। মনে করতে হবে আল্লাহ সব সময় সব কিছু দেখছেন। প্রতিটি কথাই আমলনামায় লেখা হচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপের জন্যই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রকৃত সিয়াম সাধক হিসেবে কবুল করে নিন। মিথ্যা-অন্যায় থেকে দূরে থাকার তৌফিক আপনি আমাদের দিন। আমিন।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর