ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পরলোকগমন করেছেন গত বছর এপ্রিলের ১১ তারিখে। মৃত্যুর ২৩ দিন আগে ১৮ মার্চ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্য দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল টোয়েন্টিফোর যৌথ উদ্যোগে নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করে। জানা না থাকার কারণে এরকম একটি মহতী অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে পারিনি। তবে তার সর্ব কনিষ্ঠ বোন সেলিনা চৌধুরী মিলি আপা আমার জন্য সংবর্ধনা উপলক্ষে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ওপর প্রকাশিত সংকলনের একটি কপি পাঠিয়ে ঋণী করেছেন। উল্লেখ্য, আমাদের মিলি আপাও গত বছর ২৪ ডিসেম্বর গত হয়েছেন। ছুটির দিনে বড় ভাইকে দেওয়া গুণীজন সম্মাননার সংকলনটি পড়ে ফেলি। জানলাম অনেক কিছু। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তথা জাফর ভাইয়ের নামের সঙ্গে পরিচিত হই ১৯৮২ সালে, যখন ওষুধ নীতি নিয়ে অনেক কথা চলছিল। আমি তখন বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে মহাবিদ্যালয়ে। লেখকদের লেখার ওপর কিছু বলা আমার ক্ষমতার বাইরে। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখার সঙ্গে আমি ’৭৮ সাল থেকে পরিচিত। উনি ‘গাছ পাথর’ ছদ্মনামে লিখতেন- ‘বৈহাশ্বিকের পার্শ্ব চিন্তা।’ ছাপা হতো দৈনিক সংবাদে। গাছ ও পাথর, দ্বন্দ্ব সমাস। ওনার লেখায় সাহিত্য বিবেচনায় ভিন্ন মাত্রা আছে। আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ি, বারবার পড়ি। অনেক সময় অনেক লাইন মুখস্থ করে ফেলি। তিনি উল্লেখ করেছেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চেয়েছিলেন, যারা চিকিৎসক হবেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন তারা যেন সমাজমনস্ক থাকে। ফরহাদ মজহার সাধারণত সমাজ রাজনীতি বিশ্লেষণধর্মী লেখা লেখেন। তিনি বলেছেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সবচেয়ে বড় অবদান, গণমানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কী ভাবা উচিত এবং সময়ের বাস্তবোচিত কাজ কীভাবে সময়ে করতে হবে তা তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন। ইতিহাসবিদ আসিফ নজরুল, রাষ্ট্র বিনির্মাণে নারীর অংশগ্রহণ যে জাফর ভাইয়ের জীবন দর্শনের অংশ তা চমৎকার করে বলেছেন।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আবু সাঈদ খান লিখেছেন- দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের সেবা করাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হলো। তাই, ১৯৭২ সালে দরিদ্র মানুষের সেবায় রাজধানীর অদূরে সাভারে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এক সুতোয় গাঁথা। তিল তিল ভালোবাসায় প্রতিষ্ঠানটি গড়েছেন তিনি। সে আরেক সাহসী যুদ্ধ। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হয়েছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশে গণবিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। যেখানে স্বল্প খরচে গরিব ও নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা চিকিৎসাসহ নানা বিষয়ে পড়ার সুযোগ লাভ করছে।
দেশের জনশক্তির অর্ধেকই নারী। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নারী জাগরণে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। যা শিক্ষাবিদ আসিফ নজরুল উল্লেখ করেছেন। সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেলেই যেটা চোখে পড়ে সব সময় সেটা হচ্ছে- সিকিউরিটি গার্ড, ড্রাইভার, লেদমেশিন চালক, ফার্মাসিউটিক্যালের কাজ সব নারীই করছে। এরা একেবারে সাধারণ ঘরের মেয়ে। এখানে এসে কাজ শিখে কাজ করছে। কে পারবে, কে পারবে না এমন কথা শোনার সময় যেন জাফর ভাইয়ের নেই। তার এখানে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে গ্রামে যাচ্ছে, জিপ চালাচ্ছে। এসব নারী আন্দোলন বা নারী উন্নয়ন নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের বিষয় হওয়ার কথা ছিল। নারী আন্দোলনের সংগঠক ফরিদা আখতার বলেন, এনজিওগুলো নারীদের ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া, সেলাই মেশিনে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দিতে যখন ব্যস্ত তখন জাফর ভাই সরাসরি নারীদের এনজিও সেবাগ্রহীতা না বানিয়ে তাদের নিজেদের স্বাধীন সত্তা তৈরিতে সাহায্য করেছেন।ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যক্তিগত যে গাড়ি ব্যবহার করতেন তার চালক ছিল একজন নারী। লিখেছেন- সমকালের সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন।
জাফর ভাই সম্পর্কে সবাই যথার্থ লিখেছেন। সবার লেখায় উঠে এসেছে জাফর ভাই, আমাদের বড় ভাই সর্বজনীন, বিশ্বজনীন। দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল টোয়েন্টিফোর অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী কাজ করেছিল বড় ভাইকে সংবর্ধনা দিয়ে। তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ।
বড় ভাই, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনেক পুরস্কার আর সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছিলেন। তন্মধ্যে স্বাধীনতা পুরস্কার, যা দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’-এর ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৭৭ সালে। আর ১৯৭৭ সাল থেকেই স্বাধীনতা পুরস্কার প্রবর্তন হয়। তখন সামরিক আইন চলছিল। কাকতালীয় হলেও আমার আব্বা, মরহুম সৈয়দ ফজলুল হক, গণপরিষদ ও জাতীয় পরিষদ সদস্য, যিনি ফজলুল হক বিএসসি হিসেবে সমাধিক পরিচিত, ১৯৭৭ সালে কারা অন্তরিন হন এবং বিনা বিচারে নয় মাস কারা নির্যাতন ভোগ করেন। কারা নির্যাতনে তাঁর ডান হাত ভেঙে যায়। দেশ স্বাধীনের আগেও কারা অন্তরিন হয়েছিলেন, তবে তা ভাষার জন্য, স্বাধিকারের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, কিন্তু এরকম নির্যাতিত হননি।
শাস্তির কারণ, সামরিক শাসককে রাজনৈতিক দল গঠনে সহায়তা না করা, বিপুল অর্থ বৈভবের অধিকারী হওয়া (?)। আমার আব্বা আমৃত্যু বাঙালি জাতীয়তাবাদে, ধর্মনিরপেক্ষতায় সিক্ত সৎ, নির্ভীক রাজনৈতিক ছিলেন। হামলা মামলা কোনো কিছুই তাকে ন্যায়নীতি, দেশপ্রেম থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। বলছিলাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথা। তিনি একজন সফল মানুষ। তার জীবনসংগ্রাম আর জীবনদর্শনকে উপলব্ধি করতে হবে আমাদের। আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে এ দেশের সেরা সন্তানদের অর্জন, অবদান ও আত্মত্যাগের কথা। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, কর্মবীরের প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
লেখক : প্রাবন্ধিক
ইমেইল : [email protected]