শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভারতের নির্বাচনে কী ঘটছে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের নির্বাচনে কী ঘটছে

আজ থেকে বিশ্বের অন্যতম গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা। সাত দফার নির্বাচনের প্রথম দফা শুরু হচ্ছে ১৯ এপ্রিল। শেষ হচ্ছে ১ জুন। গণনা ৪ জুন। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার শাসক বিজেপি স্লোগান দিয়েছে এবার ৪০০ পার। শাসক দলের ব্যাখ্যা হলো- ৫৪৩ আসনের লোকসভার বর্তমান সংবিধান সংশোধন করতে হলে দুই- তৃতীয়াংশ আসন দরকার। তা তারা পেলে পরেই সংবিধান সংশোধন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করে- একনায়কতন্ত্র ও হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠন করতে উদ্যোগী হবে। স্বয়ং দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হিন্দি বলয়ের আটটি রাজ্যে প্রচারে গিয়ে বলছেন, তাদের কর্মসূচি অনুযায়ী রামমন্দির তৈরি হয়ে গেছে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে কাশ্মীরকে কুক্ষিগত করেছেন, ভারত থেকে কংগ্রেসকে হটানোর কর্মসূচি ধীরে ধীরে পালিত হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন- এই এক অলীক স্বপ্ন, ভারত কখনো হিন্দু রাষ্ট্র হতে পারে না। কারণ ভারতের ১৪০ কোটি নাগরিকের মধ্যে প্রায় ৪৫ কোটি সংখ্যালঘু মুসলমান। তারা তবে কোথায় যাবেন? এ প্রশ্নের জবাব আরএসএস বা বিজেপির কাছে নেই। যদি থাকত তবে কদিন আগে হিমাচল প্রদেশে মোদি কী বলেছেন তা খতিয়ে দেখা যাক। তিনি বলেছেন, হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদকে তিনি মেলাবেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্য যখনই দেশে দুর্বল সরকার এসেছে আমাদের শত্রুরা তার সুযোগ নিয়েছে। আমার সরকার ঘরে ঘরে ঢুকে শত্রুদের খতম করেছে। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা হামলার স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন মোদি। বিরোধীরা বলেছিল উত্তরাখন্ডে মোদির এ বক্তব্যের পর তারা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে মোদি তার সরকারের চারটি এজেন্সি দিয়ে অর্থাৎ সিবিআই, ইডি, আয়কর এবং এনআইএকে দিয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। ২৭টি বিরোধী দলের জোট থেকে ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিহারের নীতিশ কুমারের জেডিইউকে নিজের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছেন। তার নেপথ্যেও অনেক নাটক আছে, যা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। মোদির একটি বক্তব্য এখন গোটা দেশে চর্চার বিষয়। তার বক্তব্য হলো- জানুয়ারিতে অযোধ্যায় রামমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠার দিনে কংগ্রেস বয়কট করেছে। সুতরাং কংগ্রেস হিন্দুবিরোধী, সেজন্য কংগ্রেসকে একটি ভোটও নয়।

মোদির এ বক্তব্যের উত্তরে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, ভারতের সংবিধানে জাতপাতের কোনো তফাৎ নেই। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে। মোদির এ বিভ্রান্তিকর প্রচারে সাধারণ মানুষ কতটা বিভ্রান্ত হচ্ছে বা আদৌ হচ্ছে কি না তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ৪ জুনের পর ভোটের ফলাফল বেরোলে। তবে এটা ঠিক, মোদি, শাহ বা ভগবতের বিরুদ্ধে যতই নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করার অভিযোগ উঠুক না কেন নির্বাচন কমিশন নিশ্চুপ। অথচ বিরোধী কোনো নেতা বা নেত্রীর নামে অভিযোগ উঠলে তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তবে এ কথা বলা যায় এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে হিন্দিবলয়ের ১৪টি রাজ্যে রাম আবেগ কাজ করছে না। সেখানকার সাধারণ মানুষ রুটি-রুজিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তেমনটাই মনে করছেন। যদিও তারা সংবাদপত্রে এসব কথা লিখতে পারছেন না। একটা অদৃশ্য ভয় সব সময় তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষ চায় রুটি, কাপড়া, অউর মোকান এবং বিজলি পানি। কিন্তু বিজেপির নির্বাচনি প্রচারে এগুলো একদম প্রাধান্য পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তারা মুখে কুলুপ এঁটেছে। মোদি বলেছেন, চাকরি দেওয়া কঠিন ব্যাপার। অথচ আগের নির্বাচনে বলেছিলেন বছরে ২ কোটি লোককে চাকরি দেবেন। মোদি আরেকটি জঘন্য খেলায় মেতে উঠেছেন। তা হলো- অগ্নিপথ। দেশে প্রায় ৬৫টি সামরিক স্কুল তুলে দিয়ে  সেগুলো বেসরকারিকরণ করে আরএসএসের হাতে তুলে দিয়েছেন- বিরোধীদের এমনটাই অভিযোগ।

মোদির গত ১০ বছর রাজত্বে কোথায় কতদূর এগোল, নানা দিক থেকে এ প্রশ্ন উঠেছে। প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ প্রায়। আসন্ন নির্বাচনের আগে হিসাবের খাতাতে একটি বিষয় উজ্জ্বল- বিদেশনীতি যেভাবে ভারতের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে এর আগে কখনো এরকম হয়নি এবং সেই পরিবর্তন ভালোর দিকে, শক্তির দিকে। আসলে মূল উদ্দেশ্য দুই শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কূটকৌশল। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের মতুয়া শ্রেণির মানুষকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টাও চলছে। তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে এনআরসি বা সিএএ করে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এতে বিজেপির ভোটব্যাংক পুষ্ট হবে।

সম্প্রতি আসামে এক নির্বাচনি সভায় মোদির ডেপুটি অমিত শাহ বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের দেখার দায়িত্ব তার। কিন্তু বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা জানিয়েছেন, অমিত শাহ অসত্য কথা বলেছেন। এখানে হিন্দুরা নির্যাতিত নয়। বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, অমিত শাহ অসত্য কথা বলেছেন। এখানে আমরা সবাই একত্রে বসবাস করছি। ছোটখাটো কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগুলো প্রশ্রয় দেন না এবং কিছু ঘটলে কড়া অবস্থান নেন। অমিত শাহের এ বক্তব্যে দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

♦ লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর