শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

জাপানের চার শহরে আমার বক্তৃতা

ইমদাদুল হক মিলন

জাপানের চার শহরে আমার বক্তৃতা

‘বাঙালি জীবনে বিশাল দুটো অঙ্ক আছে।’ সঙ্গে সঙ্গে বাক্যটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করলেন আনোয়ার জাহিদ। বক্তৃতা শুনতে আসা শ্রোতারা এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। একটি জাতির জীবনে অঙ্ক? বুঝতে পারি তারা বেশ অবাকই হয়েছেন। আমি বসে আছি হিরোশিমা শহরের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। ২০০৬ সালের মার্চ মাসের ৯ তারিখ। জাপান ফাউন্ডেশান প্রতিবছর একটি বক্তৃতামালার আয়োজন করে। ‘তাকেশি কায়েকো মেমোরিয়াল এশিয়ান রাইটার্স লেকচার সিরিজ’। লেখক সাংবাদিক তাকেশি কায়েকোর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এই বক্তৃতার আয়োজন। ভদ্রলোক এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছিলেন, বেশ কিছু জনপ্রিয় বই লিখেছিলেন। জাপানিরা দীর্ঘজীবী হন কিন্তু এই ভদ্রলোক একটু অল্প বয়সেই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে জাপান ফাউন্ডেশান এই বক্তৃতামালার আয়োজন করে আসছে। প্রতিবছর এশিয়ার কোনো একটি দেশের একজন লেখককে নির্বাচন করা হয়। সেই লেখক জাপানে এসে তাঁর নিজের লেখা এবং তাঁর দেশের সাহিত্য নিয়ে চারটি বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাগুলো আগেই লিখে জাপান ফাউন্ডেশানকে পাঠিয়ে দিতে হয়। সেই বক্তৃতা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। লেখক তাঁর নিজের ভাষায় বক্তৃতা পাঠ করেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পাশে বসা জাপানি ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ সেই বক্তৃতার জাপানি অনুবাদ পাঠ করেন।

জাপান ফাউন্ডেশান ২০০৫ সালের জন্য বাংলাদেশকে নির্বাচন করল। লেখক হিসেবে নির্বাচন করল আমাকে। ফাউন্ডেশানের একজন কর্মকর্তা হিরানো মাসিক এবং বাংলাভাষা প্রেমিক অধ্যাপক কিয়োকি নিওয়া ঢাকায় আমার ফ্ল্যাটে এলেন ২০০৫ সালের শেষদিকে। বক্তৃতার আমন্ত্রণ জানালেন। ডিসেম্বরের মধ্যেই জাপানে গিয়ে কাজটা সেরে আসতে হবে। অর্থাৎ ২০০৫ সালের বক্তৃতা ওই বছরের মধ্যেই শেষ করতে হবে। আমি বললাম, ‘এ সময় আমি পারব না। সামনে একুশের বইমেলা। ফেব্র“য়ারির পুরো মাস বাংলা একাডেমিতে দেশের সবচাইতে বড় বইমেলা হয়। এই মেলায় বেশ কয়েকটি নতুন বই বেরোয় আমার। দুটো বই এখনো লেখা হয়নি।’ এত বড় সম্মানীয় একটি ব্যাপার, আর আমি এতটা নির্বিকারভাবে বলছি ডিসেম্বরে যেতে পারব না। ওঁরা দুজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। কী ভাবলেন কে জানে। হিরানো সাহেব বললেন, ‘তাহলে তুমি কবে যেতে পারবে?’

‘মার্চে পারব। ফেব্র“য়ারির ২৮ তারিখে বইমেলা শেষ। তারপর যে কোনো দিন।’

‘বইমেলার আগে তো নিশ্চয় তোমার লেখা শেষ হয়ে যাবে। তাহলে জানুয়ারির শেষ দিক কিংবা ফেব্র“য়ারির প্রথম দিকে পারবে না?’

‘না। ফেব্র“য়ারি হচ্ছে আমাদের ভাষার মাস। ভাষা নিয়ে উৎসবের মাস। এই মাসে আমি দেশের বাইরে যাই না।’ ওঁরা আমার কথা মেনে নিলেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। ২০০৫ সালের বক্তৃতা দিতে আমি গেলাম ২০০৬ এ। ঘণ্টা দুয়েকের একেকটা বক্তৃতা। প্রথম বক্তৃতা হবে হিরোশিমায়, তারপর টোকিও, ওসাকা, সেন্দাই। তবে চারটা ভিন্ন ভিন্ন বক্তৃতা আমি লিখলাম না। যেহেতু চারটি ভিন্ন শহরে, ভিন্ন শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা, সুতরাং একটা লিখলেই তো হয়! একটাই লিখলাম। বেশ কয়েকদিন সময় লাগল লিখতে। জাপান ফাউন্ডেশান অস্থির হয়ে গেল। ঘন ঘন মেইল করছে, দু-তিনবার ফোনও করল। আমাকে নিয়ে জাপানি ভাষায় একটা সুভ্যেনির বের করবে, সেটার জন্যও কয়েক লাইনের একটি লেখা দরকার। সব মিলিয়ে বেশ দিশাহারা ভাব ওদের। শেষ পর্যন্ত সব কাজই হলো। বক্তৃতার অনুবাদ করলেন জাপানি ভাষার বাঙালি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার জাহিদ। তিনি কাজ করেন, ‘এন এইচ কে’ তে। প্রথম দিন বক্তৃতা পাঠ করতে উঠেছি, আমার পাশে বসেছেন আনোয়ার জাহিদ, তাঁর পাশে কিয়োকি নিওয়া। তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যের জাপানি পন্ডিত। আমি বক্তৃতা এক প্যারা পাঠ করি সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার জাহিদ তাঁর জাপানি অনুবাদ থেকে সেই প্যারাটি পড়ে ফেলেন। কিয়োকি নিওয়া তাঁর হাতের কপি থেকে মিলিয়ে দেখছেন বাংলার সঙ্গে জাপানি ঠিক আছে কী না! বক্তৃতা শুরুর আগে শ্রোতাদের কাছে আমার পরিচয় তুলে ধরলেন কিয়োকি নিওয়া। আমার ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটির কথা বললেন বারবার। জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে আমার গল্প ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’ সেই পুস্তিকাটি দেওয়া হয়েছে শ্রোতাদের। স্যুভেনিরটি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সাহিত্য এবং বাংলাদেশের একজন লেখকের বক্তৃতা শুনতে সেদিন হিরোশিমা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে অনেক সাহিত্যপ্রেমী জাপানিজ। কিছু প্রকাশক আছেন। নবীন প্রবীণ লেখক আছেন। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা আছেন। বক্তৃতা শেষে প্রশ্ন-উত্তরের একটা পর্ব রাখা হয়েছে। শ্রোতাদের মধ্য থেকে প্রশ্ন আসছে। আনোয়ার জাহিদ সেই প্রশ্ন বাংলায় তরজমা করে আমাকে বলছেন। আমি বাংলায় জবাব দিচ্ছি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জাপানি ভাষায় তরজমা করে যাচ্ছেন। একজন প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের মানুষদের জন্য, ‘তাদের জাতীয় জীবনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী?’

এই প্রশ্নের উত্তরে অঙ্ক প্রসঙ্গটা এলো। বললাম, ‘বাঙালি জীবনে বিশাল দুটো অঙ্ক আছে। একটি ১৯৫২ আরেকটি ১৯৭১। ’৫২তে আমরা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছি। বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। আর ১৯৭১-এ আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এই পর্যায়ে আমি যদি আমার বক্তৃতার কিছুটা অংশ আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই তাহলে ব্যাপারটা একেবারেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

‘আমি সেই দেশ থেকে এসেছি, যে দেশের নাম বাংলাদেশ। যে দেশের মানুষ নিজের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বুকের রক্ত দেয়, ভাষার জন্য শহীদ হয়। ভাষার প্রতি মমত্ববোধের কারণে যে দেশের একুশে ফেব্র“য়ারি তারিখটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমি সেই দেশ থেকে এসেছি, ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশটি স্বাধীন হয়। যে দেশের ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দেয় মুক্তিযুদ্ধে, যে দেশের ৩০ লাখ নারী নির্যাতিত হয় মুুক্তিযুদ্ধে। আমি সেই দেশ থেকে এসেছি, যে দেশের বেশির ভাগ মানুষই অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র কিন্তু মনের দিক দিয়ে, আবেগ এবং ভালোবাসার দিক দিয়ে, অতিথিপরায়ণতার দিক দিয়ে তাদের তুলনা শুধুই তারা। যে দেশের গ্রামগুলো ছবির মতো। যে দেশের শস্যের মাঠ বছরভর সবুজ এবং সোনার বর্ণে আলোকিত হয়ে থাকে। যে দেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। যে দেশের নদী নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের জীবন। আমি সেই দেশ থেকে এসেছি, যে দেশের লোকসাহিত্য, রূপকথা এবং গ্রাম্য প্রচলিত উপাখ্যানগুলো যুগ যুগ ধরে সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় সম্পদ। যে দেশের মানুষ ভালোবাসার কারণে হাসতে হাসতে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। আর যে ভাষায় জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক। আমি সেই ভাষার একজন প্রতিনিধি হিসেবে, সেই দেশের একজন লেখক হিসেবে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। এ আমার পরম সৌভাগ্য।’

‘বাংলাদেশের সাহিত্য এবং আমার নিজের লেখালেখি সম্পর্কে কথা শুরুর আগে বাংলাদেশের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ভূখন্ডটি স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে। জন্ম নেয় দুটো আলাদা রাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান দেশটি বিভক্ত হয় দুভাগে, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান, মাঝখানে ভারত, তারপর পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান নামের একই দেশের দুটো ভাগের দূরত্ব বারো শো মাইল। পূর্ব পাকিস্তান নামের দেশটি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির দেশ। তাদের ভাষা বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দু। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরেও দেশটিকে সার্বিকভাবে পরিচালনা করত, শাসন করত পশ্চিম পাকিস্তানিরা। শাসনের নামে নানা ধরনের সামাজিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার তারা চালিয়ে যেত বাঙালিদের ওপর। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নানাবিধ উপায়ে ছিনিয়ে নিয়ে যেত দেশটির যাবতীয় সম্পদ। ফলে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। ভিতরে ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ ও ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল তাদের। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিকে দাঁড়াতেই দিচ্ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানিরা। সাতচল্লিশের মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রকাশ্যে বিশাল আঘাত হানল বাংলাভাষিদের ওপর। ভাষার ষড়যন্ত্র তারা শুরু করেছিল আটচল্লিশ সাল থেকেই। সংখ্যালঘু হয়েও তারা চাইল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে অবরুদ্ধ করতে। তারা চাইল উর্দুভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে। সেই প্রথম ক্ষোভে ফেটে পড়ল বাঙালি জাতি। দেশের সুধী সমাজ, ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে এলো প্রতিবাদে। তারা চাইল রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। পাকিস্তান সরকার নির্বিচারে গুলি চালাল আন্দোলনরত মানুষের ওপর। ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিল চার বাঙালি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার। সেই তারিখটি ছিল একুশে ফেব্র“য়ারি। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার নত হলো, বাংলাকেই করল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আপাতদৃষ্টিতে বাঙালিদের দাবি মেনে নিয়েছিল পাকিস্তান সরকার কিন্তু সূক্ষ্মভাবে চালাতে শুরু করল তাদের অত্যাচার, নিপীড়ন। অর্থাৎ বাঙালি জাতি যেন কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে লাগল। ফলে বাঙালি জাতি শুরু করল একের পর এক আন্দোলন। তারা বুঝে গেল পাকিস্তানিদের কবল থেকে বাঙালিকে রক্ষা করতে হলে, বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। এই চিন্তা-চেতনা থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। যে আন্দোলন ব্যাপক রূপলাভ করে ১৯৬৯-এ। ১৯৬৯-এ দেশটি এগোতে থাকে একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। তখন অত্যাচার উৎপীড়নের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন পাওয়ার পরেও বাঙালি জাতিকে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি। এটা ১৯৭০ এর শেষ দিককার কথা। তার পরই বাঙালি জাতি দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালির ওপর। রাতের আঁধারে তারা হত্যা করে হাজার হাজার বাঙালিকে। পরদিন থেকে বাঙালি শুরু করে তাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। ন’মাস যুদ্ধ করে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তারা অর্জন করে স্বাধীন বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের পর থেকে প্রতিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ যে ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর সঙ্গে অন্যরাও শুনলেন আমার কথা। বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা হয়ে গেল তাঁদের। একুশে ফেব্র“য়ারি তারিখটি শোকের, চেতনা জাগ্রত করার। ’৫২ সালের পর থেকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা সমীহ এবং সম্ভ্রমের সঙ্গে পালন করা হয় দিনটি। ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তৈরি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে তৈরি করা হয়েছে শহীদ মিনার। দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে, আন্দোলন এবং প্রতিবাদের দিনে, দাবি আদায় এবং দেশের কৃতিসন্তানদের শেষযাত্রা শুরু হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। বিদেশের কোনো কোনো শহরের প্রাণকেন্দ্রেও স্থাপন করা হয়েছে শহীদ মিনার। টোকিওর শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে দুবার দাঁড়িয়েছি আমি।

দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য, এই মিনারের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন যেন ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকরা ভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসাটা অনুধাবন করেন। দিনে অন্তত একবার যেন প্রিয় বাংলাভাষার কথা ভাবেন। ভাষার জন্য শহীদ হওয়া সেসব বীরযোদ্ধার কথা স্মরণ করেন এবং তাদের চারপাশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন, বাঙালিই পৃথিবীর একমাত্র গৌরবময় জাতি যাঁরা বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের ভাষা। বাংলাভাষার ইতিহাস লেখা হয়েছে রক্ত দিয়ে। শোক থেকেই একুশে ফেব্র“য়ারি তারিখটিকে আমরা চেতনায় গেঁথে নিয়েছি। ফেব্র“য়ারি মাসটিকে শোকের মাস থেকে রূপান্তরিত করেছি ভাষার মাস হিসেবে। ভাষা উৎসবের মাস হিসেবে। বিশ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ১২টা এক মিনিট থেকে শুরু হয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে দেশের সর্বস্তরের লাখ লাখ মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন এখানে। বিভিন্ন সংগঠন আসে ফুল এবং ব্যানার নিয়ে। প্রত্যেকের খালি পা, বুকের কাছে কালো ব্যাজ, কণ্ঠে সেই অবিস্মরণীয় গান।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি আমি কি ভুলিতে পারি!

কোথাও কোনো ব্যানার লেখা ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। কোথাও লেখা ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলাভাষা’। আমাদের সবচাইতে বড় গৌরবের ধন বাংলাভাষা। এই ভাষা নিয়ে এখন আমাদের উৎসবেরও শেষ নেই। পুরো ফেব্র“য়ারি মাসজুড়ে চলে উৎসব। উৎসব শুধু ঢাকায়ই নয়, সারা দেশে। দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা থানা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সমাজের প্রতিটি স্তরে ফেব্র“য়ারি মাসজুড়ে চলে ভাষা উৎসব। কত অনুষ্ঠান, কত আলোচনা সভা। ফেব্র“য়ারির প্রতিটি অনুষ্ঠানই শুরু হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’ গানটি দিয়ে। এই গান লিখেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সুর করেছেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন আমাদের কিংবদন্তি শিল্পী আলতাফ মাহমুদ। ওই একটি গান তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের নাম ‘একুশে পদক’। বাংলা একাডেমি প্রবর্তন করেছে দেশের সবচাইতে বড় সাহিত্য পুরস্কার ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’। ফেব্র“য়ারি মাসটিকে ঘিরেই প্রদান করা হয় এসব পুরস্কার। দেশের প্রতিটি সংবাদপত্র এই দিনে প্রকাশ করে ‘বিশেষ সংখ্যা’। রেডিও টেলিভিশনে দিনব্যাপী প্রচারিত হয় বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান। ‘একুশে’ শব্দটি দিয়ে কত প্রতিষ্ঠানের যে নামকরণ করা হয়েছে। ‘একুশে টেলিভিশন’ নামে একটা টিভি চ্যানেলও আছে। আমরা যে আমাদের চেতনায় এই দিনটিকে আমূল গেঁথে নিয়েছি এসব কর্মকান্ড হচ্ছে তার প্রমাণ। শুধু দেশেই না, বিদেশের মাটিতেও দিনটি পালন করা হচ্ছে একই অনুভূতি নিয়ে, একই উদ্দীপনায়।

বাংলাদেশের প্রায় লাখ লাখ মানুষ এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। যেখানে যেভাবেই আছেন তাঁরা, নিজ নিজ অবস্থান থেকে যতেœ শ্রদ্ধায় এবং গভীর ভালোবাসায় পালন করছেন দিনটি। ভাষার মাসে আরেকটি বিশাল ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। বাঙালির মননের পীঠস্থান হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ‘বাংলা একাডেমি’। পুরো ফেব্র“য়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বসে দেশের সবচাইতে বড় বইমেলা। ফেব্র“য়ারির এক তারিখ থেকে আটাশ তারিখ পর্যন্ত। মেলা উদ্বোধন করেন সরকারপ্রধান। মাসব্যাপী চলে সাহিত্য সংস্কৃতির আলোচনা, গান, কবিতা পাঠ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ লাইন দিয়ে ঢোকে বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় উৎসবের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বইমেলা হয়ে উঠেছে মানুষের মিলনমেলা। লেখক পাঠক প্রকাশকের একত্র হওয়ার জায়গা। সারা বছর নতুন বই বলতে গেলে আমাদের দেশে এখন আর প্রকাশিতই হয় না। সব বই প্রকাশিত হয় ফেব্র“য়ারি মেলায়। লেখকরা সারা বছর ধরে যা লিখেন সব বেরোয় ফেব্র“য়ারি মেলার সময়। পাঠকরাও অপেক্ষায় থাকেন এই মেলা থেকে তাঁদের পছন্দের বইটি সংগ্রহ করবেন। পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন থাকে বইমেলার সংবাদ। টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান। কোনো কোনো টিভি চ্যানেল মেলা প্রাঙ্গণ থেকে প্রতিদিন সরাসরি সম্প্রচার করে অনুষ্ঠান। মানুষ লাইন ধরে বই কিনে। গত ফেব্র“য়ারি মেলায় খুচরা বই বিক্রি হয়েছিল আট কোটি টাকার। সব মিলিয়ে বিশাল এক উৎসব।

ফেব্র“য়ারি মাসে জেলা শহরগুলোতেও বইমেলা হয়। নানা রকম অনুষ্ঠানে আনন্দময় হয়ে ওঠে দেশের প্রতিটি অঞ্চল। সারা বছর মানুষ অপেক্ষা করে ফেব্র“য়ারি মাসের। কবে আসবে ফেব্র“য়ারি, কবে শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শুরু হবে উৎসব। ভাষার জন্য পুরো একটি মাস এ রকম আয়োজন পৃথিবীর আর কোনো দেশেই হয় না। ভাষা নিয়ে এত উৎসব আর কোথাও দেখা যায় না। ফেব্র“য়ারি মাসের প্রতিটি দিনে আমার অন্তত একবার মনে পড়ে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। এসব কথাই আমি আমার বক্তৃতায় জাপানিদের সামনে তুলে ধরেছিলাম। বিদেশিদের কাছে নিজের দেশের গৌরবের কথা প্রাণখুলে বলতে পারার চেয়ে বড় আনন্দ আর হতে পারে না।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর