সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইসলাম ফোবিয়া জিইয়ে রাখছে কারা!

মোশাররফ হোসেন মুসা

ইসলাম ফোবিয়া জিইয়ে রাখছে কারা!

ইসলাম ফোবিয়া শব্দটির অর্থ ইসলাম নিয়ে অযৌক্তিক ভীতি। বাংলাদেশে যেসব বুদ্ধিজীবী একসময় ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে ছিলেন তাঁরাও বলা শুরু করেছেন এটি পশ্চিমাদের বানানো শব্দ। তাঁরা কোনো কোনো সময় এডওয়ার্ড সাঈদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ ও ‘কাভারিং ইসলাম’ নামে দুটির বইয়ের কথা ব্যবহার করেন। এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন, ‘পশ্চিমাদের বিভিন্ন করপোরেশন ভিন্ন ধারায় ইসলামিক দৈত্যের উপকথা হাজির করে। ...ইসলাম একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। ...ইসলাম হচ্ছে হাইজ্যাকিং আর চরমপন্থার আরেক নাম। ...মধ্যপ্রাচ্যে স্বাধীনতাকামীদের এরা সন্ত্রাসী বলে। আর যখন তাদের নিজ দেশগুলোতে মুসলিম হত্যা হয়, তখন হত্যাকারীকে মানসিক রোগী হিসেবে আখ্যায়িত করে।’ সাঈদ আরও বলেন, ‘ইসলাম একটি অনুকরণ যোগ্য ধর্ম, যার শক্তিশালী সংস্কৃতি রয়েছে, এটি অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত ও স্বাতন্ত্র্য আভিজাত্যমন্ডিত।’ উল্লেখ্য, তিনি বই দুটি লিখেছেন ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে। এরপর পৃথিবীতে বহু ঘটনা ঘটে গেছে। কুয়েত দখল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, টুইন টাওয়ারে হামলা, পরিণতিতে আফগানিস্তানে আক্রমণসহ আরও কত কী! ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ আরব দেশগুলোতে আরব বসন্তের নামে বিদ্রোহীদের সরাসরি অস্ত্র প্রদান করা হয়। সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে প্রহসনমূলক বিচারের নামে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। এসব ইতিহাস সবার জানা রয়েছে। গত বছর হামাস ইসরায়েলে হামলা করলে প্রায় ১১০০ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হন। এর জের ধরে এখনো ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে। ফলে অগণিত শিশুসহ প্রায় ৩২ হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এগুলোকে যারা সাদা চোখে দেখেন- তারা বলবেন এগুলো আমেরিকার পাতানো ষড়যন্ত্র। এমনকি তাদের মুখে শোনা গেছে, নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার হামলাও নাকি ইহুদিদের চক্রান্ত (এসব বক্তব্য ওয়াজকারীরা সর্বক্ষণ প্রচার করছেন)। এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বে এত জাতি থাকতে আমেরিকা মুসলিমদের কেন বেছে নিয়েছে? সোজা উত্তর, এদের ব্যবহার করা সহজ। সামান্য কৌশলে এদের উত্তেজিত করা যায়, তথা মুসলিম দেশগুলোর জমি উর্বর। এসব জমিতে উগ্রতার চাষাবাদ করতে বেশি সারের প্রয়োজন পড়ে না। দেখা যায়, আল-কায়েদা, নুসরা, বোকো হারাম, এনটিজে, ইআইজে নামে হাজার রকম উগ্রবাদী দলের জন্ম ঘটেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে পরাজিত করতে আমেরিকা মুজাহিদীন বাহিনী গড়ে তোলে (লক্ষণীয় গণতান্ত্রিক পার্টি নয়)। মুজাহিদীন বাহিনীর লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত বাহিনী হটিয়ে আফগানিস্তানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ৯ বছর যুদ্ধ করে তালেবান আফিগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। আমেরিকা সিরিয়াকে দখল করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে। রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ার পক্ষে দাঁড়ালে ‘আইএস’-এর জন্ম দেওয়া হয়। সমগ্র বিশ্ব আমেরিকার চালাকি বুঝলেও মুসলিমরা কেন বোঝে না! কারণ মুসলিমদের মতো ধর্মপাগল মানুষ পৃথিবীতে অন্য কোনো জাতিতে দেখা যায় না। ধর্মের নামে এদের যে কোনো দিকে ব্যবহার করা সম্ভব। রাশিয়ার কনসার্ট হলে হামলা করে ১৩৯ জনকে হত্যা তার সর্বশেষ উদাহরণ। অর্থাৎ উগ্রবাদীরাই যৌক্তিক ভীতির পক্ষে মতামত সৃষ্টি করছে। ১৯৮১/৮২ সালে পাকিস্তান আমেরিকার সহযোগিতায় আফগান সীমান্তে হাজার হাজার মাদরাসা তৈরি করে। মাদরাসার ছাত্ররাই পরবর্তীতে তালেবান হয়। উগ্রবাদ চাষাবাদের ফল কী হতে পারে তা বর্তমান পাকিস্তানের দিকে তাকালেই প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশেও  সর্বক্ষণ প্রচার করা হচ্ছে, আপনার সন্তানকে মাদরাসায় পাঠান। ট্রেন-বাস-লঞ্চ যে যানবাহনেই ওঠেন না কেন, সেখানেই ওয়াজ শুনতে পাবেন। মানুষের বাঁচতে হলে পরিশ্রম করতে হয়, প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে হয়, চিকিৎসা নিতে হয়। কোনো দোয়া দরুদ, মন্ত্র-টন্ত্র পাঠ করে রোগমুক্তি হয় না। আবিষ্কার করতে হলে বিজ্ঞান পড়তে হয়, ভালো চিকিৎসার জন্য দক্ষ চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, এসব জানা থাকার পরও কেন তারা তাদের সন্তানদের বিজ্ঞানবিমুখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছে! এর পেছনে রয়েছে উর্বর মস্তিষ্ক। যে কোনো ধর্মের উদ্ভবকালে সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের ইতিহাস থাকে। এসব যুক্তি তারা বুঝে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল পণ্যের বাজার দখল নিয়ে। এখন সারা বিশ্বে যে অস্থিরতার  পেছনেও রয়েছে অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনাকে আড়াল করার বিভিন্ন কৌশল। ভারতে হিন্দুত্ববাদ ও ইউরোপে রক্ষণশীলতা উত্থানের  পেছনেও একই কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতায় থাকার জন্য ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে। দুঃখের বিষয় যাবতীয় পশ্চাৎপদতাসহ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যেরকম আন্দোলন থাকার কথা, যেরকম বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থাকার কথা, সেরকম প্রগতিশীল দল ও বুদ্ধিজীবী কোনোটাই নেই। সলিমুল্লাহ খানও ইদানীং ফরহাদ মজহারের পথে হাঁটা শুরু করেছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এ দেশ বহু রকম সংকটের মুখে পড়তে বাধ্য। শেষে একটি গল্প বলা যায়, একটি গ্রামে একটি বড় জামে মসজিদ ছিল। সে মসজিদের উঁচু মিনারে ৮টি মাইকের হর্ন লাগানো ছিল, যেন দূর থেকে আজানসহ যে কোনো আহ্বান শোনা যায়। এক দিন গভীর রাতে পশ্চিম গ্রামে ডাকাত পড়ে। এর আগে ডাকাতের কয়েকজন সদস্য মুয়াজ্জিনকে বেঁধে রেখে মসজিদের মাউথ স্পিস দখলে নেয়। তারা মাইকে বলতে থাকে- ‘ভাইসব সবাই বেরিয়ে আসেন, পূর্ব গ্রামে ডাকাত পড়েছে।’ শত শত মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে পূর্ব গ্রামে ছুটতে থাকে। প্রগতিশীল দলের কয়েকজন যুবক তাদের পথরোধ করে বোঝানোর চেষ্টা করে, পশ্চিম গ্রামে ডাকাত পড়েছে, আপনারা পূর্ব গ্রামে যাচ্ছেন কেন? জনগণের সঙ্গে মিশে থাকা কয়েকজন ডাকাত চিৎকার করে বলে উঠে- ‘এরা ডাকাত দলের সদস্য। মারো এদের।’

 

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর