মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

সড়ক ট্র্যাজেডির অবসান হোক

পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ

সড়ক ট্র্যাজেডির অবসান হোক

খ্রিস্টপূর্ব সময়ের গ্রিক নাট্যকারের একজন হলেন সোফোক্লিস। তাঁর জগৎবিখ্যাত নাটক হলো ‘রাজা ইডিপাস’। মূলত গভীর ট্র্যাজিক নাটক। রাজা ইডিপাস নাটকের মূলে গ্রিক মাইথলজি। গ্রিক মাইথলজিতে আছে বিশ্ববিধান। বিশ্ববিধানে মানুষের হাত নেই। নিয়তি যেভাবে মানুষকে নিয়ে খেলবেন, মানুষ সেভাবেই খেলবে। মানুষের জীবন তাই নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে কর্মের জন্য মানুষ দায়ী নয়। এখানেই মানবজীবনের ট্র্যাজেডি নিহিত। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে মানুষ কৃতকর্মের জন্য দায়ভার বহন করে না। এই পৌরাণিক কাহিনির বিশ্বাসকে ধারণ করে সোফোক্লিস তার বিশ্ববিশ্রুত নাটক ‘রাজা ইডিপাস’ নির্মাণ করেন।

তখনকার সময়ে এথেন্সে একটি আইন ছিল যে, সন্তান হত্যা বড় অপরাধ ও মহাপাপ। সোফোক্লিস এই অপরাধটির চিত্র নাটকে রূপায়িত করার জন্য প্রচলিত লোকবিশ্বাসকে অবলম্বন করে রচনা করেন ‘রাজা ইডিপাস।’ মূলত পৌরাণিক কাহিনি বা লোকগাথাকে অবলম্বন করে এ নাটক।

আমাদের সড়ক-মহাসড়ক যেন এখন গ্রিক ট্র্যাজেডি। কৃতকর্মের দায় নেই। আমাদের প্রত্যেক ঈদ উৎসবের সমাপ্তি হয় সড়ক ট্র্যাজেডি দিয়ে। দুর্ঘটনার নামে সড়কে নারী, পুরুষ, শিশু প্রাণ দেবে। প্রতি উৎসবে দেবে। কেউ দায় নেবে না। সড়কে মৃত্যু চলতেই থাকবে। এটাই যেন নিয়তি। সবাই যেন সেই গ্রিক মাইথলজিতে বিশ্বাস করে বসে আছেন। শেকসপিয়রের ট্র্যাজেডি পড়তে রাজি নন। শেকসপিরিয়ান ট্র্যাজেডিতে মানুষের কর্ম তার নিয়তি। মানুষ তার কর্মের জন্য দায়ী।

১৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জের ছাতকের সড়কে প্রাণ দিল তরুণ গীতিকার-শিল্পী পাগল হাসান। পাগল হাসান নামেই সে পরিচিত। গানের অসাধারণ সব লিরিক্সের জন্ম দিয়েছে হাসান। জল-জোসনার সুনামগঞ্জে অনেক গানের মহাজনের জন্ম হয়েছে। হাসন রাজা, রাধারমন, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিমের মতো গানের মানুষের জন্ম হাওরের সুনামগঞ্জে। জল-জোসনার সুনামগঞ্জের হাওরে মরমি গানের সুর ভেসে বেড়ায়। তরুণ হাসান পূর্বসূরিদের ধারণ করে উঠে এসেছিল। অল্প বয়সে অনেক গান রচনা করেছে। তাঁর লেখা, ‘আসমানে যাইওনারে বন্ধু, ধরতে পারবো না-তোমায়/পাতালে যাইওনারে বন্ধু, ছুঁইতে পারবো না-তোমায়/বুকের ভিতর রইওরে বন্ধু, বুকের ভিতর রইও, অন্তরে অন্তর মিশাইয়া পিরিতের গান গাইও/তুমি’ গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিল। বুকের ভিতর ভালোবাসার তুমুল আবেগ আর অসাধারণ মেধা না থাকলে, এমন গান লেখা যায় না। সুনামগঞ্জের হাওরে এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। শুরু হয়েছে সারা বছরের স্বপ্নের ধান কাটা। নতুন ধানে গোলা ভর্তি হবে। নববর্ষের দিন থেকে তাই মানুষ উৎসবের আমেজে রয়েছে। রাতভর গানের অনুষ্ঠানে ছিল হাসান। সকালে সিএনজি করে বাড়িতে যাচ্ছিল। বিপরীত থেকে আসা গাড়ির সঙ্গে সিএনজির সংঘর্ষে মারা যায় হাসান। সুনামগঞ্জের গানপ্রিয় মানুষ তাঁর অকালমৃত্যুতে শোকাহত। ১৭ এপ্রিল ঝালকাঠিতে একটি ট্রাক কয়েকটি ইজিবাইককে ধাক্কা এবং একটি প্রাইভেট কারকে চাপা দেয়। এ ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়। ঝালকাঠির রাজাপুর গ্রামের দুই বোন ঈদের ছুটিতে বাবার বাড়িতে এসেছিলেন। প্রাইভেট কারে দুই বোনের পরিবার বরিশাল যাচ্ছিল। গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় ইজিবাইকগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সিমেন্টবোঝাই ট্রাক তাদের প্রাইভেট কারকে চাপা দেয়। ভিডিও ফুটেজে সেই ছবি দেখলে গা শিউরে উঠে। ফুটেজে দেখা যায়, দ্রুতগতিতে ট্রাক এসে গাড়িগুলোর ওপর আছড়ে পড়ছে। কী ভয়াবহ দৃশ্য।

প্রাইভেট কারে বড় বোনের সঙ্গে তাঁর স্বামী আর দুই শিশু সন্তান ছিল। ছোট বোনের এক মাস আগে বিয়ে হয়েছে। স্বামীকে নিয়ে সে যাচ্ছিল। বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যাবে। যাওয়া হয়নি তাদের। চালকসহ সবার মৃত্যু হয়। যে ট্রাক ১৪ জন মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে সেটিতে ধারণক্ষমতার বেশি সিমেন্ট বোঝাই ছিল। ট্রাক ড্রাইভারের ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না। হালকা যানের লাইসেন্স নিয়ে ট্রাক চালাচ্ছিল। আগের দিন ১৬ এপ্রিল ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা পিকআপে ছিলেন। হয়তো কম ভাড়ায় যাওয়ার জন্য পিকআপের যাত্রী হয়েছিলেন। পিকআপ মাল পরিবহনের জন্য। যাত্রী নেওয়ার জন্য নিরাপদ নয়। জীবন দিয়ে এরা মূল্য দিয়েছেন। পিকআপ মহাসড়কে যাত্রী পরিবহন করে কীভাবে? পিকআপের সঙ্গে যে বাসের সংঘর্ষ হয় তার ফিটনেস ছিল না। রুট পারমিট ছিল না। অতিরিক্ত সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক কীভাবে চলে?

আমাদের সড়ক পরিবহন আইন আছে। মোটরযান আইন আছে। আইন প্রয়োগের জন্য হাইওয়ে পুলিশ আছে। বিআরটিএ আছে। হাইওয়ে পুলিশ থাকতে ফিটনেসবিহীন, রুট পারমিট ছাড়া হাইওয়েতে গাড়ি চলে কীভাবে? তারা ব্যবস্থা নেয়নি। বিআরটিএ এর মোবাইল কোর্ট করা উচিত। ঈদের সময় অন্তত বিশেষ ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল।

মালিকরা লাইসেন্স ভারী যানের লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারের কাছে ট্রাক দিতে পারেন না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে চালাতে পারেন না। বারবার সবাই এমন করবেন কেন? প্রত্যেক ঈদে আমাদের সড়ক ট্র্যাজেডি মানা যায় না। এভাবে মানুষের মৃত্যু হতে দেওয়া যায় না। মৃত্যুর কান্নায় উৎসবের সমাপ্তি নয়। নিরাপদ জীবনে উৎসবের সমাপ্তি হোক।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর