মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেন এত আত্মহনন?

তপন কুমার ঘোষ

কেন এত আত্মহনন?

মন খারাপ করা খবর। একটি-দুটি নয়, বারবার ঘটছে একই ঘটনা। প্রায় নিত্যদিন সংবাদের শিরোনামে ওঠে আসছে তরুণ-তরুণীদের আত্মহননের খবর। কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে, কিছু অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা। উদ্বেগের বিষয়ই বটে! এ নিয়ে আলোচনা করতেও বেদনায় মন সিক্ত হয়ে যায়। অকালেই ঝরে গেছে কত সম্ভাবনাময় প্রাণ! চোখের জলে ভাসছে গোটা পরিবার। পুরো সংসার পড়েছে অকূলপাথারে। অনেক ক্ষেত্রেই কেন সন্তান আত্মহত্যা করেছে তা ভেবে কূলকিনারা পান না অভিভাবকরা। কিছু বিষয় মানুষ সহজে মানতে পারে না। আপনজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু তেমনই একটি বিষয়। পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষিতরা বেশি আত্মহননে। আবার এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। জীবন সম্পর্কে কোনো বোধ তৈরি হওয়ার আগেই ঝরে গেছে অনেক প্রাণ। সাম্প্রতিককালে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। অধিকাংশ আত্মহত্যার নেপথ্যে হতাশা ও মানসিক অবসাদের তত্ত্বই ওঠে আসে। এ কথা হলফ করে বলা যায়, একমাত্র শিশু ও পাগল ছাড়া বাকি সবাই কমবেশি হতাশায় ভুগছে। মনোবিদরা বলছেন, এমন কোনো মানুষ নেই যার মানসিক উদ্বেগ নেই। দুশ্চিন্তা তাড়া করে সব সময়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের খবর- দেশে মানসিক রোগের ভয়াবহতা বাড়ছে। তুচ্ছ কারণে ঘটছে খুনোখুনি। দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। নেপথ্যে আছে অর্থনৈতিক চাপ, পেশাগত চাপ, ধর্ষণ, সম্পর্কের জটিলতা, পারিবারিক অশান্তিসহ নানা কারণ। প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন তরুণীরা। কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের দুনিয়ায় প্রবেশের পর অনেকের স্বপ্নভঙ্গ হয়। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা সহ্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না। তখনই গোল বাঁধে। সংসারে অশান্তির একটা বড় কারণ দারিদ্র্য। বেঁচে থাকতে হলে অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন আছে, এটা অনস্বীকার্য। আবার অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ অনেক ক্ষেত্রে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কথায় বলে না, ‘অর্থই অনর্থের মূল।’ সম্পর্কের টানাপোড়েন ও বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের কারণেও পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। বিচ্ছেদে আছে দহন। এ দহন অনেকেই সহ্য করতে পারেন না। তখন জীবন অর্থহীন মনে হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় কুরুচিকর ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ ও হেনস্তা করা হচ্ছে। এটাই যেন হাল আমলের স্ট্যান্ডার্ড! অশ্লীল মন্তব্য ও কটাক্ষের (বুলিং) শিকার হয়ে সমাজে মুখ দেখাতে পারেন না অনেক তরুণী। দুঃখজনকভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে অনেক তরুণী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াই যেন কাল! বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত আসক্তি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সুস্থ বিনোদনের অভাব প্রকট। আছে একাকিত্ববোধের যন্ত্রণা। ঋণের চাপে বা রোগযন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়।

মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। বাইরের চাকচিক্য দেখে মানুষের মনের অবস্থা বোঝা কঠিন। অকারণে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কোনো কিছুই তখন ভালো লাগে না। মনোবিদরা বলছেন, এর পেছনে থাকে কিছু সুপ্ত কারণ। নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কাজ করে। মানসিক চাপ বা স্ট্রেস থেকেই এমনটা হয়। জীবন চলে না সোজা পথে। জীবনের হিসাব সব সময় মেলে না। দুয়ে দুয়ে চার সর্বক্ষেত্রে হয় না। সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। কোনো মানুষেরই সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। সাফল্য ও প্রাপ্তির পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের জীবনে আছে ব্যর্থতা, গ্লানি, অপ্রাপ্তির বেদনা ও দহন। এটা জীবনেরই অংশ। এ সত্যকে সহজভাবে মেনে নিতে হয়। কবিগুরু বলেছেন- ‘ভালোমন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে।’ চ্যালেঞ্জ যেখানে নেই, সেখানে কোনো আনন্দও নেই। কবিগুরু জীবনের জয়গান গেয়েছেন। গলা মেলাতে হবে তার সুরে, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’

দুঃখ-কষ্টের স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু হটে না। বারবার মনের দুয়ারে এসে ভিড় করে। এ অবস্থায় সুখস্মৃতিগুলো স্মরণ করতে হবে। জীবনের সাফল্যগাথা সামনে আনতে হবে। মনোবিদরা বলে থাকেন সবকিছুর জন্য নন্দ ঘোষ ‘ভাগ্য’কে দোষারোপ করে লাভ নেই। ব্যর্থতাকে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মনোবল অটুট রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরলে সর্বনাশ। পরিবর্তন আসবেই। সাফল্য এক দিন ধরা দেবেই। ফিরে আসবে জীবনের ছন্দ- এ মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ভয়কে জয় করে বিপরীত শক্তির মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতাটা মনে পড়ে? ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়’। নিজের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে। যে ব্যক্তি মনের দুঃখে আত্মহননের পথ বেছে নেন, তিনি হয়তো ভাবেন মৃত্যুতেই সবকিছুর সমাধান। একবারও পরিবারের কথা ভাবেন না। যারা হতাশায় ভুগছেন তাদের মানসিক সাপোর্ট দরকার। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কের যত্ন নেওয়া দরকার। সামাজিক মাধ্যমে কারও অযাচিত ও কদর্য মন্তব্যে মন খারাপ করার কিছু নেই। সবার সব কথা গায়ে মাখতে নেই। সবার জীবনেই ঝড়ঝাপটা আসে। এ কথাগুলো মাথায় রাখতে হবে। ধর্মের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা মহাপাপ। সামাজিকভাবেও এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। ইতিবাচক ভাবনার মধ্যে থাকলে মন ভালো থাকে। সৃষ্টিশীল কাজে মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যা সমস্যার সমাধান নয়। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মধ্যেই যত আনন্দ!

লেখক : সাবেক পরিচালক পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন

সর্বশেষ খবর