বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

নারীবিরোধী আইনের বিলুপ্তি চাই

তসলিমা নাসরিন

 নারীবিরোধী আইনের বিলুপ্তি চাই

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনগুলোর মধ্যে কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত আইন আছে, যে আইনগুলো আজও অক্ষত রয়ে গেছে। নারীর সমানাধিকারের বিরুদ্ধে আইন তো ছিলই, সমকামিতার বিরুদ্ধেও ছিল, এমনকি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধেও ছিল। কিছু আইন তো ৫০০ বছরের পুরোনো। ১৫৩৩ সালে ব্রিটেনে এবং এর কলোনিগুলোয় সমকামিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অষ্টম হেনরির শাসনামলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সেই আইনটি জারি করে। ভিক্টোরিয়ার আমলেও, ১৮৮৫ সালে, পরস্পরের সম্মতি থাকলেও সমকামিতাকে ‘পুরুষে পুরুষে চরম অশ্লীলতা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তখনো পুরুষের সমকামিতার বিরুদ্ধেই আইন ছিল। নারীর সমকামিতার বিরুদ্ধে আইন পরে তৈরি হয়। এখন বিশ্বের ৬৭টি দেশে সমকামিতা নিষিদ্ধ। এই দেশগুলোর অধিকাংশই পুরোনো ব্রিটিশ কলোনি এবং কমনওয়েলথের সদস্য দেশ। কিছুদিন আগে উগান্ডা সমকামিতার বিরুদ্ধে নতুন একটি আইন পাস করে। এই আইনে সমকামীরা তো বটেই, সমকামীদের বন্ধু-বান্ধবও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। ৪১টি দেশে কিন্তু নারীর সমকামিতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে।

ব্রিটেনে গৃহহীনতার বিরুদ্ধেও আইন আছে। আইনটি ৫০০ বছরের পুরোনো। আইনটির নাম ‘ভেগ্রেন্সি আইন’। রাস্তায় গৃহহীন দরিদ্র মানুষ বসে থাকলে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো পুরোনো কলোনিগুলোয়, ৩৩টি দেশে, এই আইন বলবৎ আছে। এই আইনের কারণে দরিদ্রদের ওপর অত্যাচার চলে। দেশে দেশে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই আইনের বিলুপ্তি চেয়ে আন্দোলন করছে।

আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, এশিয়া, আফ্রিকার ৪৮.৫ কোটি লোককে শাসন করতো ব্রিটেন। নিজেদের আইন প্রতিটি কলোনিতে চাপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। সেই সময় কলোনিগুলোর কিছু ধার্মিক এবং সামাজিক রীতি নারীবিরোধী ছিল। সেগুলোর বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন  যুক্তিবাদী এবং উদার ব্রিটিশরা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের আইন তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ভারতীয় মুক্তচিন্তক বুদ্ধিজীবীরা। রাজা রামমোহন রায় আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তখন ৫/৬ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত, কিন্তু ১৮৯১ সালে ব্রিটিশরা মেয়েদের বিয়ের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে বেঁধে দিয়েছিলেন। বিধবা মেয়ের বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ বৈধ করেছিলেন ব্রিটিশরা। বিবাহিতা মেয়েরা স্বামীর সম্পত্তি পেতেন না, তাদের নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছিল না। ১৮৭৪ সালে বিবাহিতা মেয়েরা স্বামীর সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার লাভ করেন। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ শাসক নিষিদ্ধ করেছিলেন কন্যাশিশু হত্যা। ১৮৭২ সালে পাস হয় স্পেশাল বিবাহ আইন, যে আইনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নারী পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। ১৮৭২ সালে খ্রিস্টান বিবাহ আইনও পাস হয়, যে আইনে খ্রিস্টান মেয়েরা নিরাপত্তার যে অধিকার আগে পায়নি, সেই অধিকার পায়। ১৮৬৯ সালে খ্রিস্টান মেয়েদের বৈধভাবে ডিভোর্স দেওয়ার অধিকারকে মেনে নেওয়া হয়। ১৮৮৫ সালে পাস হয় মেয়েদের ওপর নির্যাতন করাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার আইন। মেয়েদের অপহরণ আর ধর্ষণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। মেয়েদের উত্তরাধিকার পাওয়া নিয়েও আলোচনা শুরু করেন ব্রিটিশরা। ১৯২৮ সালে হিন্দু মেয়েদের পিতার সম্পত্তি পাওয়ার পথে যেসব বাধা আছে তা সরিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী মেয়েরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারতো না।  ১৮৫৯ সালে শ্রমিকের যে চুক্তিপত্রে সই করে মেয়েদের শ্রমিকের কাজ করতে হতো, সেসব চুক্তি যদি মেয়েদের দ্বারা লঙ্ঘন হতো, তাহলেও মেয়েদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হতো না। ব্রিটিশরা তো মেয়েদের পক্ষেই ছিলেন, তখন যতটা সম্ভব নারীবিরোধী সমাজের বিপক্ষে গিয়ে আইনের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা কিছুটা হলেও রক্ষা করেছেন অথবা করতে চেয়েছেন।

কিন্তু ১৮৯০ সালে করা অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইনের ১৯ ধারায় যা বলা হয়েছে তা হলো- সন্তানের অভিভাবক তিনি, যিনি কোনো নাবালকের শরীর অথবা সম্পত্তির  উভয়ের তত্ত্বাবধান এবং ভরণপোষণ প্রদানে আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। ওই আইন অনুযায়ী নাবালকের স্বাভাবিক এবং আইনগত অভিভাবক পিতা। শিশুর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পুরুষের, মেয়েদের নয়। এই আইনটি এখনও সংশোধনবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যান্য দেশে এই আইনের সংশোধন হলেও বাংলাদেশে হয়নি। বাংলাদেশের কিছু মানবাধিকার সংস্থা এই আইনটির বিলুপ্তি চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন। সম্ভবত উনিশ শতকে মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পুরুষের চেয়ে তুলনায় নগণ্য ছিল বলে নারীর অভিভাবকত্ব স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু নারী সেই যোগ্যতা অর্জন করেছে। উচ্চ আদালত পুনর্বিবেচনা করছে আদৌ এই আইনকে মান্য করা হবে কি হবে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’। অর্থাৎ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান, সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার, সকল নাগরিকের চাকরি লাভের সুযোগ সমান, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার সমান। সংবিধান নারীপুরুষের সমান অধিকারের কথা বলছে। ঔপনিবেশিক কোনও আইন বা অন্য কোনও বিশ্বাসের ভিত্তিতে তৈরি আইনের সংবিধানকে তুচ্ছ করার অধিকার নেই। ১৮৯০ সালের অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইনটিকে কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত মুসলিম আইন কিছুটা হলেও পরিবর্তন করেছে। ঔপনিবেশিক আইন বলছে সন্তানের অভিভাবকত্ব পিতার, পিতার বৈ অন্য কারোর নয়। ওদিকে প্রচলিত মুসলিম আইন সন্তানের মাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার দিয়েছে, এক্ষেত্রে ছেলেশিশু হলে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মা তার জিম্মায় রাখার অধিকারী। কিন্তু ১৮৯০ সালের অভিভাবকত্ব আইনটিকে সংশোধন করে সন্তানের অভিভাবকত্বে নারী ও পুরুষের অধিকার বা পিতা এবং মাতার অধিকার সমান করলে, ধর্ম বর্ণ জাত নির্বিশেষে নারী এবং পুরুষ সমানাধিকার ভোগ করবে। এরকমই তো হওয়া উচিত। সভ্য দেশে কানুন অবশ্যই সভ্য হয়, সেই কানুনে কোনও বৈষম্যের অস্তিত্ব থাকে না। বাংলাদেশকে সভ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নারীবিরোধী সব আইনের বিলুপ্তি অবশ্যই দরকার।

বাংলাদেশের পারিবারিক আইন ধর্ম এবং শাস্ত্র অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। এই পারিবারিক আইনের আওতায় আছে বিবাহ, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব, আর উত্তরাধিকার। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখি বৈষম্যের বিকট উপস্থিতি। এই বৈষম্যকে দূর করতে চাইলে পারিবারিক আইনকে অবশ্যই ন্যায়বিচার ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে তৈরি করতে হবে। তা না হলে সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদকে চরম অপমান করা হয়। একটি রাষ্ট্রের সংবিধান রাষ্ট্রের সকলের কাছে অতি পবিত্র। এই পবিত্র সংবিধানকে অসম্মান করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যখনই ঘরে বাইরে নারীর বিরুদ্ধে নানা কায়দায় বৈষম্য রচিত হয়, তখনই পবিত্র সংবিধানকে অসম্মান করা হয়।  ঘরে বাইরে প্রতিনিয়ত অপদস্ত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছে নারী। সংবিধান নারী পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলছে, তারপরও সংবিধানের মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাচীন ধর্মীয় আইন, যা প্রাচীনকালে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত হলেও আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। আইনকে ধর্মভিত্তিক না করে সমানাধিকারভিত্তিক করলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা রে রে করে ছুটে আসে। ছুটে আসে কারণ তারা চায় নারীরা মধ্যযুগীয় আইন দ্বারা এই একবিংশ শতাব্দিতেও নিষ্পেষিত হোক, নির্যাতিত হোক। তারা নারীবিরোধী বলেই এমন চায়। সাধারণ জনতাকে তারা এই বলে উত্তেজিত করে যে ধর্মের সর্বনাশ করা হয়েছে। কে তাদের বোঝাবে, রাষ্ট্র এবং আইনকানুনকে ধর্ম থেকে আলাদা করার অর্থ মানুষের বিশ্বাস থেকে ধর্মকে কেড়ে নেওয়া নয়, ধর্মের সর্বনাশ করাও নয়। মানুষ যার যার ধর্ম নিভৃতে বিশ্বাস করুক, এতে রাষ্ট্র বাধা দিচ্ছে না। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাষ্ট্রকে ধর্ম পালনে বাধ্য না করাটাই সভ্য লোকের আচরণ। অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে বরণ করা সভ্য লোকের দায়িত্ব।

আপাতত ১৮৯০ সালে রচিত অভিভাবকত্ব আইন সংশোধন হোক। তারপর না হয় মধ্যযুগে রচিত নারী-পুরুষের বৈষম্যভিত্তিক আইন নির্মূল করা যাবে, নিদেনপক্ষে সংশোধন করা যাবে। সংবিধানকে যথাযোগ্য সম্মান করে আইন প্রণয়ন করার জন্য শুধু কিছু নারীবাদী সংগঠনকে এগিয়ে এলে হবে না, প্রগতিশীল সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সমতা আর সমানাধিকারকে সজোরে সমর্থন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের অধিকাংশ মানুষ নারীবিদ্বেষী, তারা নারীর সমানাধিকার চায় না। তারা নারীকে পদদলিত করে, পদাঘাত করে আনন্দ পায়, তারা এক একজন নারী হেনস্তাকারী, এক একজন ধর্ষক, ধর্ষকের সমর্থক। রাষ্ট্রে এবং সমাজে এবং পরিবারে নারীর সমানাধিকার কার্যকর করা ভীষণই দুরূহ কাজ। আর আজ এই দুরূহ কাজটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসে সম্পূর্ণ করাই এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

সর্বশেষ খবর