শিরোনাম
শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিপদ-মুসিবত কর্মের ফল

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

মানব জীবনের প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি নড়াচড়ায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৌখিক নির্দেশনা কিংবা কর্মের নমুনা রয়েছে। খাওয়ার আগে দুই হাত ধৌত করতে হয়, টয়লেটে গেলে দোয়া পড়ে নিয়মানুযায়ী প্রবেশ করতে হয়, ইত্যাকার খুঁটিনাটি কাজেও সুন্নত তরিকা রয়েছে। কিন্তু এগুলো আমল করার প্রতি আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। আমরা যারা নিজেদের দীনদার বলে দাবি করি তারাই এসব আমল থেকে দূরে অবস্থান করি। তাহলে আমরা প্রতি কদমে কদমে নানা দুরবস্থার সম্মুখীন হব না কেন?

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমাদের ওপর যত বিপদাপদ ও মুসিবত আসে সব তোমাদের কর্মেরই প্রতিফল। অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে যেসব পেরেশানি বা দুরবস্থা আসে তার একমাত্র কারণ হলো- গুনাহ ও আল্লাহর নাফরমানি। পৃথিবীজুড়ে এখন মুসলমানদের ওপর যে জুলুম, নিষ্পেষণ দেখা যাচ্ছে তা কোরআনের এ আয়াতের দৃষ্টিতে মনে হয় সামাজিক মুসিবত সমাজের পাপের কারণে আর রাষ্ট্রীয় মুসিবত রাষ্ট্রের পাপের কারণে এসেছে।

আমরা বলে থাকি যে, ইহুদি-খ্রিস্টানদের অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের কারণেই আমাদের এ দুর্দশা, অথচ এটা চিন্তা করি না যে, আমাদের গুনাহ ও পাপের কারণেই আল্লাহপাক ইহুদি-খ্রিস্টানদের মাধ্যমে আমাদের ওপর মুসিবত চাপিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত আমরা মুসলমানরা নেকির কাজ ছেড়ে দিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানদের কৃষ্টি-কালচার গ্রহণ করে প্রতিটি মুহূর্তে পাপের সাগরে ডুবে থাকার কারণেই আল্লাহপাক স্বীয় সৃষ্টি ও শত্রুকে আমাদের জন্য মুসিবত, ধ্বংস ও আজাবের কারণ বানিয়ে পাঠিয়েছেন। আগুন, পানি, বাতাস ভূমিকম্প, হিংস্র প্রাণীকে যেভাবে আমাদের জন্য আজাব হিসেবে পাঠান তেমনি অনেক সময় আল্লাহপাক ইসলামের চিরশত্রুদের আমাদের জন্য আজাবের মাধ্যম বানান। আল্লাহর হুকুম ও নবীর সুন্নত তরক করার কারণে আমাদের ওপর আজাব আসে। মিছিল, মিটিং ইত্যাদি করে আজাব দূর করা যাবে না। আজাব দূর করতে হলে নেকির কাজ করতে হবে এবং পাপের কাজ বর্জন করতে হবে। আমি প্রায় জায়গায় বলে থাকি যে, বাংলাদেশের ৬০% মানুষ যদি সহিশুদ্ধ ও সুন্নত তরিকায় ফরজ নামাজ আদায় করত তাহলে দেশের পরিস্থিতি নির্ঘাত পাল্টে যেত।

দুঃখের কথা আর কী বলব- আমরা যারা নামাজ পড়াই তাদের নামাজই সুন্নত তরিকায় হচ্ছে না। দাঁড়ানোর সুন্নত তরিকা ঠিক নেই, বসার তরিকা ঠিক নেই ইত্যাদি। কেউ যদি বলে ভাই! তোমার আজান, নামাজ ইত্যাদি সুন্নত তরিকায় হচ্ছে না, তাহলে সে রাগ করে, তার কথা মানতে চায় না। ভাতের মধ্যে যদি পোকা থাকে আর কেউ ওই ভাত আহারকারীকে জানিয়ে দেয় যে, তোমার ভাতে পোকা তাহলে তাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়, অথচ কারও নামাজে যদি পোকা তথা গলদ থাকে আর তা ধরিয়ে দেওয়া হয় তখন রাগ করা হয়। এই পোকা নামাজে থাকলে কি তাকে পরিশুদ্ধ নামাজ বলা যায়? যে এই পোকার খবর দিয়ে তা সরানোর কাজে সহযোগিতা করল তাকে তো আন্তরিক বন্ধু ভাবার কথা! মনে রাখবেন, নামাজ যখন ত্রুটিমুক্ত হবে তখনই তা রুহানি শক্তি পয়দা করবে।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একদল লোক নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি আমলের বহু নেকি নিয়ে হাশরের ময়দানে আসবে কিন্তু অন্যের গিবত, পরনিন্দা, দোষচর্চা, বান্দার হক নষ্ট করার দরুন বদলা হিসেবে নেকি দিতে দিতে ভান্ডার খালি হয়ে যাবে, অতঃপর গুনাহের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে যাবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যক্তির ব্যাপারেই বলেছেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে এ ধরনের লোকই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নিঃস্ব-মিসকিন। মৃত্যু কার কখন আসে তা বলা যায় না। পূর্ব সংবাদ ছাড়াই এক দিন আজরাইল (আ.) এসে রুহ বের করে নিয়ে যাবেন। সামান্যতম সময়ের অবকাশ দেওয়া হবে না। তাই এ কঠিন মুহূর্ত আসার আগেই বান্দার হকের ব্যাপারে সবাইকে সজাগ হতে হবে। গুনাহে কবিরা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। নিজের পরিবার-পরিজনকেও এসব থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। বস্তুত গুনাহ থেকে বাঁচতে হলে সর্বদা হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো পাঠ করতে হবে এবং ফরজের সঙ্গে সুন্নত নফলের পাবন্দি করতে হবে। তাহলেই গুনাহ থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যাবে। আমি যখন আপনাদের আমলের উপদেশ দিই এ সময় আমার নিজের মধ্যেও এক ধরনের ভয় জারি থাকে। এটা এ কারণে যে, আমি যে আমলের কথা বললাম, তা যদি নিজে আমল না করি তাহলে এটা হবে আল্লাহপাকের এ কালামের বিপরীত যে, ‘তোমরা এমন কথা বল কেন যা তোমরা কর না?’ এমন হলে কাল কেয়ামতের দিন আমাকে আটকা পড়তে হবে এবং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে লজ্জিত হতে হবে। তখন তো আপনারাও বলবেন যে, এত বড় হুজুর! অথচ আজ তিনি আটকে গেলেন। নিজের আমলের কোতাহির তথা ত্রুটির কারণে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে লজ্জিত হলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তো উম্মতের গ্রেফতারের কারণে লজ্জিত হবেন। তাহলে জান্নাতের ফয়সালা কীভাবে হবে?

ইমাম মালিক (রহ.) এর ঘটনা আপনাদের আগেও শুনিয়েছি। ইমাম মালিক (রহ.)-কে ধরে নিয়ে জেলখানায় বন্দি করে যখন নির্যাতন করা হতো তখন তিনি প্রায় সময় বেহুঁশ হয়ে পড়তেন এবং হুঁশ আসার পরই বলতেন ‘যে আমাকে আঘাত করেছে তাকে মাফ করে দিলাম।’ এক দিন তাঁকে এমন আঘাত করা হলো যে, শত্রুরা মনে করেছিল তিনি মারা গেছেন; ফলে তাঁকে তারা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহর কুদরতে কিছু সময় পর বাড়িতে গিয়ে তিনি হুঁশ ফিরে পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমি যার আঘাতে বেহুঁশ হয়েয়েছি ত াকে ক্ষমা করে দিলাম।’

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর