বুধবার, ১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইসলামে শ্রমজীবীদের অতুলনীয় মর্যাদা

আবদুর রশিদ

ইসলামে শ্রমজীবীদের অতুলনীয় মর্যাদা

১ মে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বাতিঘর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। মেহনতি মানুষের অধিকার সুরক্ষার দাবিতে এই দিনে দেশে দেশে বুলন্দ আওয়াজ ওঠে। অথচ ইসলাম ১৪০০ বছর আগেই মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়েছে। মেহনতি মানুষের ওপর জুলুম অনাচার অবিচার দূরীকরণে ইসলামী জীবনবিধান অনুসরণের বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ সুরা বালাদের ৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে।’ একজন শ্রমিক তার শ্রম বিক্রি করে জীবিকার প্রত্যাশায়। শ্রমের মূল্য সে যাতে প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে পায় এমনটিই নিশ্চিত করা হয়েছে ইসলামের বিধানে। এ সম্পর্কে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ কর।’ ইবনে মাজাহ। ইসলাম মালিককে শ্রমিকদের প্রতি মমত্ববোধের পরিচয় দিতে নির্দেশ দিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিককে তার সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি কাজ দিও না। যদি কখনো এমনটি করতেই হয় তবে তুমি নিজে তাকে সহযোগিতা করবে।’ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘কিয়ামতের ময়দানে আমি ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে মামলা করব যে শ্রমিকের কাছ থেকে পূর্ণ কাজ বুঝে নিল কিন্তু তাকে তার মজুরি দিল না।’ মুসলিম।

ইসলামে এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের কোনো পার্থক্য স্বীকার করা হয় না। ইসলাম পৃথিবীর সব খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের যাবতীয় সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান দিয়েছে। বৈধপথে খেটে খাওয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। বিশ্বনবী (সা.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। তিনি বলেছেন, যারা সৎপথে জীবিকা নির্বাহ করে তারা খোদার প্রিয় বন্ধু। যে কারণে শ্রমজীবীদের কোনোভাবেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। ইসলামে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় তাকওয়ার নিরিখে; ধনসম্পদ কিংবা পদমর্যাদার ভিত্তিতে নয়। শ্রমের মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান অতুলনীয়। মানব জাতির গাইডলাইন আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান করবে।’ সুরা জুমা, আয়াত ১০। পরিশ্রমের দ্বারা যারা জীবিকা নির্বাহ করে তাদের আল্লাহর বন্ধু অভিহিত করেছেন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদাকে আকাশছোঁয়া করা হয়েছে এ অভিধার মাধ্যমে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিবারের জন্য নিজে পানি বহন করতেন। নিজের জুতা নিজে সেলাই করতেন। মসজিদ নির্মাণ, পরিখা খননসহ সামাজিক কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আল্লাহর নবীর শ্রমের মাধ্যমে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে শ্রমিক নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছেন। নাসায়ি। শ্রমজীবীদের প্রতি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতটা দরদি ছিলেন তার প্রমাণ মেলে বায়হাকির একটি হাদিসে। জনৈক ব্যক্তি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ‘আমার খাদেম (গৃহপরিচারক) আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অন্যায় করে, (এখন আমি তার সঙ্গে কেমন আচরণ করব?) উত্তরে তিনি বললেন, দৈনিক তাকে সত্তরবার ক্ষমা করবে।’ হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, ‘একদা আমি আমার কাজের লোককে চাবুক দ্বারা প্রহার করছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন রাগের স্বরে আমার নাম ধরে ডাকছিল, হে আবু মাসউদ! হে আবু মাসউদ! প্রচন্ড রাগত স্বরের কারণে আমি বুঝতে পারিনি কে আমাকে ডাকছে। কাছে আসার পর দেখলাম রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন। এরপর আমাকে বললেন, আবু মাসউদ! তুমি এই শ্রমিকের ওপর যতটা শক্তিশালী, মহান আল্লাহ কিন্তু তোমার ওপর তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী।’ রসুল (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন কাবা ঘরে প্রথম প্রবেশের সময় শ্রমজীবী বেলাল (রা.) ও খাব্বাব (রা.)-কে সঙ্গে রেখেছিলেন। হজরত বেলাল (রা.)-কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বানিয়েছিলেন তিনি। অথচ ইসলামপূর্ব যুগে হাবশী গোলাম বেলালের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। ইসলাম শ্রমজীবী বেলাল (রা.)-কে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। হজরত আনাস (রা.) বলেন, আমি ১০ বছর নবিজী (সা.)-এর খেদমত করেছি। অথচ দীর্ঘ এ সময়ে তিনি কখনো আমাকে ধমক দেননি। তিনি খেতে বসলে আমাকে সঙ্গে নিয়েই খেতেন। একই প্লেটে খেতাম আমরা। ইসলামে শ্রমে নিয়োগের ক্ষেত্রে শ্রমিকের যোগ্যতা, সক্ষমতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অধীনদের জন্য খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করবে, তাদের ওপর সাধ্যাতীত কাজ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।’ মুসলিম। সোজা কথায় কোনো শ্রমিকের ওপর সাধ্যাতীত কাজ চাপানো ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর