শনিবার, ৪ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

জার্মানির শ্রমিক জীবন

জার্মানির শ্রমিক জীবন

বন্ধুদের মধ্যে মুকুল এবং বজলু প্রথমে বিদেশে চলে গেল। সাতাত্তর সালের কথা। আমি জগন্নাথে ইকোনমিকসে অনার্স পড়ছি। প্রায়ই ক্লাস করা হয় না। একাত্তর সালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে দশটি ভাইবোন আমরা ভয়াবহ জীবনযুদ্ধে নেমেছি। মাথার ওপরে আছেন মা। আব্বা চাকরি করতেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। আব্বার জায়গায় চাকরি হলো বড়ভাইয়ের। কেরানির চাকরি। ওই চাকরিতে এত বড় সংসার চলার কথা না। আমাকে দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা করানোর বুদ্ধি করল ভাই। ‘মিলন ট্রেডিং কোম্পানি’ নামে তৃতীয় শ্রেণির একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স বের করা হলো। এদিক-ওদিক থেকে টাকা-পয়সা ধার করে তিয়াত্তর চুয়াত্তর সাল থেকেই ছোটখাটো ঠিকাদারির কাজ শুরু করি। ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা। লেখালেখির পোকাও ততদিনে ঢুকে গেছে মাথায়। কিছুদিন আগে কবি রফিক আজাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। যখন-তখন আড্ডা দিই তাঁর সঙ্গে। সবমিলে অতি ব্যস্ততার দিন। এ সময় শুনি মুকুল আর বজলু পশ্চিম জার্মানিতে চলে যাচ্ছে। ওরা দুজন আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। পরে আমি আর মুকুল জগন্নাথেও একসঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছি। বজলু চলে গিয়েছিল আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে।

এসএসসি পাস করার পর পরই আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো কামালের। সেও গেন্ডারিয়ার ছেলে। আমাদের সঙ্গে সেও ভর্তি হয়েছিল জগন্নাথ কলেজে এবং অল্প দিনের মধ্যেই তুমুল বন্ধুত্ব। মুকুল আর বজলু জার্মানিতে চলে যাচ্ছে এ কথা শুনলাম কামালের মুখে। তখনো তেজগাঁওয়ের পুরনো এয়ারপোর্ট সচল। মুকুল বজলুর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমি আর কামাল গিয়ে ওদের সিঅফ করে এলাম। ফেরার সময় দুজনেরই খুব মন খারাপ। বজলু ততটা নয় কিন্তু মুকুল আমাদের অতি প্রিয়বন্ধু। লক্ষ্মীবাজারে মুকুলদের ছোট্ট একটা প্রেস ছিল। ‘মুকুল প্রেস’। এক সময় মুকুল তার বাবার সঙ্গে সেই প্রেসেই থাকত। ওদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে। ওর বাবা প্রায়ই বাড়ি চলে যেতেন। তখন আমি আর কামাল গিয়ে মুকুলের সঙ্গে গাদাগাদি করে প্রেসের চৌকিতে ঘুমাতাম। মুকুলের সঙ্গ আমরা খুব পছন্দ করতাম। সেই মুকুল বিদেশ চলে গেল? কবে তার সঙ্গে আবার দেখা হবে, কত বছর পর, কে জানে! দেখা হলে আগের মুকুলকে আর খুঁজে পাব কি না কে জানে! এসব ভেবে আমি আর কামাল বেশ কয়েক দিন উদাস হয়ে থাকলাম। তারপর যা হয় আর কি, যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে গেলাম।

তখন আমাদের বয়সী যুবকদের বিদেশ যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। আরবের দেশগুলোতে যে যেভাবে পারে যাচ্ছে। একটু লেখাপড়া জানা, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির যুবকরা যেতে শুরু করেছে ইউরোপের দেশগুলোতে। বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানিতে। সে দেশে রোজগার খুব ভালো। জীবন ব্যবস্থা মহাউন্নত। তার ওপর ভিসা লাগে না। পোর্ট এন্ট্রি। একবার কোনো মতে গিয়ে ঢুকতে পারলেই হলো, পরদিন থেকেই রোজগার। চাকরি-বাকরি না হলেও অসুবিধা নেই। ‘সোসিয়ালামথ’ বলে একটা সংস্থা আছে, তারা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। যতদিন চাকরি না হয় থাকার জন্য হোটেল দেবে, খাওয়া-দাওয়া হাতখরচা এবং জামা-কাপড়ের জন্য যে টাকা দেবে সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে দেশেও টাকা পাঠানো সম্ভব। স্বপ্নের মতো ব্যাপার। তবে জার্মানিতে পৌঁছেই একজন উকিল ধরতে হবে। তার মাধ্যমে জার্মান সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করতে হবে। যতদিন আবেদনের কোনো সুরাহা না হবে ততদিন জার্মানিতে থাকা এবং কাজের কোনো অসুবিধা নেই। আবেদনের প্রথম রেজাল্ট পেতে দুই-তিন বছর লেগে যায়। তারপর আরও দুবার আবেদনের সুযোগ থাকে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে চার/পাঁচ বছর থেকে যাওয়া যায়। ওই চার/পাঁচ বছর একটানা কাজ করলে কয়েক লাখ টাকা জমানো সম্ভব। সেই টাকা নিয়ে দেশে ফিরলে সারা জীবনের জন্য একটা পুঁজি হয়ে গেল। ওইটা নেড়েচেড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবন ভালোভাবে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। এই রাজনৈতিক আশ্রয় কিংবা পলিটিক্যাল এসাইলামের ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। পরে জেনেছিলাম। জার্মানিতে গিয়ে।

যা হোক এসবের কিছুদিন পর আমার বড়বোন নিজের পছন্দমতো একজনকে বিয়ে করে ফেলল। বিয়ের দেড় দুই মাসের মধ্যেই শুনি বর ভদ্রলোকটি উধাও হয়ে গেছেন। তাঁর কোনো খোঁজখবর নেই। পাত্তা নেই। তাঁর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ কিছু বলতে পারে না। আমার বোন গোপনে কান্নাকাটি শুরু করল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে যা হয়, আমার বোনটির ওপর এক ধরনের মানসিক নির্যাতন চলতে লাগল।

আমার মাথায় তখন পুরোদস্তুর লেখক হওয়ার চিন্তা। ইত্তেফাক ভবন থেকে ‘রোববার’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার প্রস্তুতি চলছে। পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্বে আছেন রাহাত খান, রফিক আজাদ। আমিও সারাক্ষণ লেগে আছি তাঁদের সঙ্গে। পড়াশোনায় মন নেই, কন্ট্রাকটরি কাজের অনেকখানিই চাপিয়ে দিয়েছি আমার ছোটভাই বাদলের ওপর। আমাদের পারিবারিক দুরবস্থা কাটতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় আমার বোন জেনে ফেলল তার বর পশ্চিম জার্মানিতে চলে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। আর ‘রোববার’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করল। সেই পত্রিকার আমি একজন প্রতিবেদক নিয়োজিত হয়েছি। বেতন চার শ টাকা। আমার চিন্তায় তো নয়ই, কল্পনায়ও নেই বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন। লেখালেখির এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্য দিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে। এক ফাঁকে অনার্স পরীক্ষা শেষ করলাম। কামাল ততদিনে পড়াশোনোর ফাঁকে ফাঁকে তার এক পরিচিত ভদ্রলোকের ট্রাভেল এজেন্সিতে বসতে শুরু করেছে। আমার চোখজুড়ে লেখক হওয়ার স্বপ্ন। ক্যারিয়ার গড়তে চাচ্ছি সাংবাদিক হিসেবে। উনআশি সালের মাঝামাঝি এসব স্বপ্ন কল্পনা ওলটপালট হয়ে গেল।

কামাল ভিতরে ভিতরে চেষ্টা করছিল পশ্চিম জার্মানিতে চলে যেতে। মুকুলের সঙ্গে চিঠিপত্রের যোগাযোগ আছে। হয়তো মুকুলই ওকে বলেছে চলে যেতে। জার্মানির মতো দেশে যেতে পারলে নিশ্চিত সুন্দর ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমার সঙ্গে মুকুলের কোনো যোগাযোগ ছিল না। এ সময় কামাল আমাকে পটাতে লাগল। ‘চল দোস্ত, চলে যাই। এখানে থেকে কী করবি? এসব লেখালেখি, সাংবাদিকতার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আর লিখতে চাইলে বিদেশে বসেও লেখা যায়। না হয় পাঁচ/সাত বছর পর ফিরে এসে আবার লিখবি। ততদিনে তোর অনেক টাকা হয়ে যাবে। কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না।’ দোনোমোনো করতে করতে মাকে কথাটা বললাম। মা চট করেই রাজি হয়ে গেলেন। কারণটা বুঝলাম দু-একদিন পর। যেহেতু বড় মেয়ের বর আছে জার্মানিতে, সেই দেশে গিয়ে আমি যদি তার খোঁজখবর করতে পারি, দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি অথবা বোনটিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি জার্মানিতে তাহলে আমাদের পরিবারের বড় একটি সমস্যার সমাধান হয়। বোনও চাইছিল আমি যাই। একদিকে মা বোন আরেকদিকে কামাল, তার ওপর ইউরোপের অত সুন্দর টাকাঅলা দেশের হাতছানি, আমি রাজি হয়ে গেলাম। দেখতে দেখতে পাসপোর্ট হয়ে গেল। পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় হয়ে গেল। এরোফ্লটের টিকিট কাটা হয়ে গেল। রিটার্ন টিকিট। ঢাকা ইস্টবার্লিন ঢাকা। ইস্ট জার্মানি এবং বুলগেরিয়ার ভিসা জোগাড় করল কামাল। ইস্ট বার্লিন থেকে ওয়েস্ট বার্লিনে ঢুকব আমরা। সেখান থেকে ট্রেনে করে চলে যাব বনে। বনে থাকে মুকুল, বজলু এবং আমাদের আরেক বন্ধু সাইফুল্লাহ। ওদের ওখানে গিয়ে উঠব। সঙ্গে ক্যাশ দুই হাজার ডলার। তখন ডলারের রেট বোধহয় এগারো/বারো টাকা। অক্টোবরের ২০ তারিখে প্লেনে চড়লাম। ১৯৭৯ ঢাকা-দিল্লি, দিল্লি-মস্কো, মস্কো-ইস্ট বার্লিন। সেদিনের আগে আমি কখনো প্লেনে চড়িনি। সে দিনের আগে আমি কখনো দেশের বাইরে যাইনি। একদিন শৈশবে বিক্রমপুর থেকে ঢাকা এসেছিলাম, আজ ঢাকা থেকে যাচ্ছি জার্মানিতে। মনে আছে, প্লেন যখন উড়ল, হঠাৎ করে আমার সবকিছু কেমন শূন্য মনে হলো। মনে হলো, নিজের সবকিছু ছেড়ে আমি যেন কোনো অচিনলোকে চলে যাচ্ছি। এই জীবনে নিজের দেশে, পরিচিত পরিবেশে, নিজস্ব মানুষজনের কাছে আমার আর ফেরা হবে না।

দিল্লি এয়ারপোর্টে দুই ঘণ্টা থেমেছিল প্লেন। এয়ারপোর্টে নেমে ঘোরাঘুরি করলাম। কামাল বেশ উৎফুল্ল কিন্তু আমি আছি বিষণ্ন হয়ে। দিল্লি এয়ারপোর্টকে আমার বিদেশ মনেই হলো না। বিদেশ এবং শীত কাহাকে বলে টের পেলাম মস্কো এয়ারপোর্টে নেমে। সেখানে নেমেছিলাম সন্ধ্যার পর। প্লেন থেকে নেমে কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে বাসে চড়তে হবে। বাস নিয়ে যাবে টার্মিনালে। ওই কয়েক কদম হাঁটতে গিয়ে আমার শুধু মনে হলো, মৃত্যু কি এর চেয়েও শীতল? অক্টোবরেই মস্কোতে সেদিন মাইনাস সিক্সটিন। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতো নিঃশব্দে ঝরছে তুষার। মস্কো এয়ারপোর্টে প্রায় সারা রাত বসে থাকতে হয়েছিল। এয়ারপোর্টের বাইরে যাওয়ার পারমিশান নেই। এরোফ্লট থেকে ডিনারে দেওয়া হলো অচেনা সব খাবার। আমার প্রায় কিছুই খাওয়া হলো না। মনটা একেবারেই অন্যরকম হয়ে আছে। কামাল প্রফুল্লচিত্তে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করছে। আমি থাকি উদাস হয়ে। কত মানুষের কথা মনে পড়ে! কত প্রিয়মুখ। নিজের অজান্তে নিঃশব্দ কান্নায় ভেসে যায় চোখ। মস্কো এয়ারপোর্টের অচেনা বেঞ্চে বসে আছি। পায়ের কাছে ব্যাগ। পাশে কাত হয়ে শুয়ে গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছে কামাল। চোখের জলে ভেসে কোন ফাঁকে যে রাত কেটে যায়, টের পাই না। ইস্ট বার্লিনে এলাম পরদিন দুপুরবেলা। বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে বহু আগেই উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে বিদেশি সময়। আমার সেসব খেয়াল থাকে না। সব কিছুতেই আমি আছি কামালের ওপর নির্ভর করে। কামাল খুবই স্মার্ট। ডলার ভাঙিয়ে লোকাল কারেন্সি করল। আমাকে নিয়ে চড়ে বসল ট্রেনে। ট্রেনে দু-একজন জার্মানের সঙ্গে বাঙালি স্টাইলের ইংরেজি বলে জেনে নিল কোন স্টেশানে নামতে হবে! কোথা দিয়ে কেমন করে ক্রস করতে হবে বর্ডার! কেমন করে পৌঁছতে হবে ওয়েস্ট বার্লিনে।

ট্রেনের কামরায় বেশ গরম তার পরও শীতে থরথর করে কাঁপছি আমি। আর এত নার্ভাস হয়ে আছি- কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না। স্টেশানের নামগুলোও পড়তে পারছি না। সবই জার্মান ভাষায় লেখা। আমার মতো অবস্থা কামালেরও। তবু আমাকে সে কিছু বুঝতে দিচ্ছে না। সাহস দিচ্ছে। এক সময় আন্দাজেই একটা স্টেশানে আমরা নেমে পড়লাম। আমাদের গেন্ডারিয়া স্টেশানের মতো হতদরিদ্র ধরনের স্টেশন। কিন্তু এই স্টেশানের কোথা দিয়ে কেমন করে যেতে হবে ওপারে? ওয়েস্ট বার্লিনে? বর্ডারটা কোথায়? আমরা দুজন অন্ধের মতো ঘুরতে লাগলাম। মাঝে মাঝে কামালকে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কি রে কোনদিক দিয়ে যাব?’ কামাল এক সময় রেগে গেল। ‘আমি কী করে বলব কোনদিক দিয়ে যাব? আমি কখনো এসেছি নাকি?’ ইস্ট বার্লিনে মস্কোর মতো বরফ পড়ছে না ঠিকই, তবে প্রচণ্ড শীত। আমাদের পরনে বাংলাদেশি শীতপোশাক। তাতে শীত মানছে না। দুজনেই থরথর করে কাঁপছি। নাক মুখ দিয়ে হু হু করে বাষ্প বেরুচ্ছে। ঠোঁট কালো হয়ে গেছে। কাঁধে ভারী ব্যাগ। পেটে খিদে। সবমিলিয়ে চূড়ান্ত অসহায় অবস্থা। এ অবস্থায় পথটা আমরা পেয়ে গেলাম। লাল সিরামিকের দেয়াল ঘেরা একটা জায়গা চোখে পড়ল। কিছু লোক ব্যাগ সুটকেস হাতে লাইন ধরে সেদিকে যাচ্ছে। কামাল বলল, ‘চল যাই। বোধহয় ওটাই পথ।’ সত্যি, ওটাই ছিল পথ। নানারকমের অলিগলি, বাঁক এবং ঘোরানো সিঁড়ি, নানারকমের চেক, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি চলল। ইমিগ্রেশনের কঠিন চেহারার লোকগুলোকে সবচাইতে ব্যস্ত হতে দেখলাম আমাদের সিগ্রেটের প্যাকেট নিয়ে। নানা রকমভাবে সিগ্রেট খুলে পরীক্ষা করল। আমি আর কামাল দুজনেই তখন সিগ্রেট খাই। দুজনেরই ব্র্যান্ড ট্রিপল ফাইভ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওয়েস্ট বার্লিন। ওই বর্ডার স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়েছিলাম। যতদূর মনে আছে, ট্রেনে চড়ার পর একজন পাকিস্তানি আমাদের বলেছিল ‘জু’ কিংবা ‘সু’ স্টেশনে নামতে। যার বাংলা অর্থ ‘চিড়িয়াখানা’। পরে জেনেছিলাম এই এলাকা দিয়ে সবচাইতে বেশি ড্রাগ পাচার হয়। এ জন্য আমাদের সিগ্রেটের ওপর দিয়ে অত প্রেসার গেছে। জার্মানিতে থাকা অবস্থাতেই জু স্টেশন এলাকা নিয়ে তৈরি ড্রাগ এডিকটেড ছেলেমেয়েদের জীবনভিত্তিক অসাধারণ একটা ছবি দেখেছিলাম ‘চিলড্রেনস ফ্রম জু স্টেশান’। ওয়েস্ট বার্লিনে ঢুকে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কী অসাধারণ সৌন্দর্য শহরের! কী জৌলুস! কী চাকচিক্য! ইস্ট বার্লিনের মানুষ যেন হাঁটেই না, আর এখানকার মানুষ ছুটছে। পুরো শহরটাই যেন মুভ করছে যন্ত্রের মতো। চারদিক তাকিয়ে আমার শুধু মনে হলো, এই স্বর্গনগরী আমার নয়। আমি এখানকার কেউ নই। তৃতীয় বিশ্বের দুটি অসহায় যুবক আমরা আর্থিক সচ্ছলতার আশায় এখানে এসেছি। শীতে এবং খিদেয় কাঁপতে কাঁপতে যখন বার্লিনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, নিজেকে ভিখারির মতো মনে হচ্ছিল। ওয়েস্ট বার্লিনে থাকা এক পাকিস্তানি ভদ্রলোকের ঠিকানা ছিল আমার কাছে। ঠিকানাটা আমার বোনকে দিয়েছিল তার বর। ততদিনে ভদ্রলোকের সঙ্গে বোনের যোগাযোগ হয়েছে। চিঠিপত্র লেখালেখি চলছে। আমার জার্মানিতে যাওয়ার খবর তিনি পেয়েছেন। বার্লিন হয়ে যাব বলে ওই ভদ্রলোকের ঠিকানা দিয়েছেন। তার কাছে গেলে ভদ্রলোক সাহায্য করবেন।

সন্ধ্যার দিকে আমরা একটা ট্যাক্সি নিলাম। ড্রাইভার আমাদের বয়সী একটি জার্মান মেয়ে। আমাদের মতোই ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলে। ঠিকানা মতো সে আমাদের নিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই। তখন অক্টোবরের ভয়াবহ হাওয়া বইছে বার্লিনে। ঝিরঝির করে ঝরছে বৃষ্টি। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগ থেকে বের করে আমি একটা বান্দরটুপি পরেছি, দেখে ড্রাইভার মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগল। তার এই হাসির চান্সটা নিল কামাল। বেশ স্মার্ট ভঙ্গিতে মেয়েটিকে একটা সিগ্রেট দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি কি আমাদেরকে বনে পৌঁছে দিতে পার?’ শুনে আঁতকে উঠল মেয়েটি। ‘বল কী? বন তো এখান থেকে বহুদূর। দশ-বারো ঘণ্টার ড্রাইভ। ভাড়া হবে আড়াই তিন হাজার মার্ক।’ কামাল বলল, ‘আমরা দেব। তুমি আমাদের পৌঁছে দাও।’ মেয়েটি সামান্য সময় কী ভাবল তারপর রাস্তার ধারের একটা ক্যাফের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো। ‘তোমরা এখানে বসে কফি খাও, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রেডি হয়ে আসছি। তারপর সারা রাত ড্রাইভ করে তোমাদেরকে বনে নিয়ে যাব। ভাড়া দেবে পুরো তিন হাজার মার্ক। আর এখন ভাড়া হয়েছে আশি মার্ক, এটা দিয়ে দাও।’ বেশ কিছু ডলার ভাঙিয়ে আমরা মার্ক করেছি। ভাড়া দিয়ে দিলাম। সেই ক্যাফেতে ক্যাফে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বসে রইলাম। কতবার যে কফি আর বনরুটি ধরনের একটা জিনিস, পরে জেনেছিলাম জিনিসটার নাম ‘ব্রচেন’ খেলাম, মেয়েটি আর এলো না। আমাদের দুজনেরই বিশ্বাস সে আসবে, আমাদের বনে পৌঁছে দেবে। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায়, কাঁধে ব্যাগ, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যেন মেয়েটি এলেই আমাদের দেখতে পায়। ততক্ষণে শহর নির্জন হয়ে গেছে। বার ক্যাফে সব বন্ধ। ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে ইউরোপীয় শীত। আমরা দুটি অসহায় বাঙালি যুবক রাস্তার ধারের দেয়ালে হেলান দিয়ে ভিজছি। অপেক্ষা করছি সেই মেয়ের জন্য। একসময় টের পেলাম শীতে আমরা দুজনেই জমে যাচ্ছি। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের। শীতে জমে এখানেই কি মরে পড়ে থাকব নাকি বাঁচার চেষ্টা করব? কিন্তু কোথায় যাব? কার কাছে যাব?

রাস্তার ওপাশে পুলিশ স্টেশন। ঝকঝকে আলো জ্বলছে সেখানে। সিনেমার কায়দায় পুলিশ ভ্যান আসছে, যাচ্ছে। বাঁচার আশায় আমরা কি এখন পুলিশ স্টেশনে যাব? কিছুদিন ধরে জার্মানিতে অতিরিক্ত লোক ঢুকে যাচ্ছে দেখে জার্মান পুলিশ এখন অবৈধ প্রবেশকারী পেলেই ডিপোর্ট করছে। হাতে পেলে আমাদেরও নিশ্চয় তাই করবে। তাহলে? একদিকে শীতে মরে যাওয়া অন্যদিকে ডিপোর্ট। কী করব? শেষ পর্যন্ত বাঁচার আশায় আমরা গিয়ে পুলিশ স্টেশানেই ঢুকলাম। আমাদের দেখে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ল পুলিশরা। যেন বেশ ভালো দুখানা মক্কেল পেয়েছে। তারপর পাসপোর্ট টিকিট ইত্যাদি সিজ করে আমাদের দুজনকে লকারে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু এসবে আমাদের দুজনের তখন কিছুই যেন এসে যায় না। পুলিশ স্টেশানে হিটার চলছে। সেই উষ্ণতায় আমরা বেঁচে গেলাম। আধঘণ্টাখানেক লাগল স্বাভাবিক হতে। তারপর একজন পুলিশ অফিসার এসে আমাদের ডেকে নিল। আমরা দুজন তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি অফিসারকে বলব, ‘আজকের রাতটা আমাদের কোনো হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দাও। কালই আমরা দেশে ফিরে যাব। এদেশে খুব শীত। এই শীতে আমরা থাকব না।’

আমি নই, কামাল সত্যি সত্যি এসব কথাই বলল পুলিশকে। পুলিশ অফিসার অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখ দেখে বুঝলাম, আমাদের জন্য তার মায়া হচ্ছে। ভদ্রলোক তারপর বিভিন্ন হোটেলে ফোন করতে লাগলেন। রাত দুটোর দিকে একটি হোটেলে ডাবল বেডের একটি রুম জোগাড় হলো। পুলিশের গাড়ি আমাদের সেই হোটেলে পৌঁছে দিল। গাড়িতে চড়ার আগে আমাদের পাসপোর্ট, টিকিট, টাকা-পয়সা সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অফিসার। সত্যি বিস্ময়কর ঘটনা। সেই হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে ট্রেনে চড়েছিলাম আমরা। সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছে ছিলাম বনে।

আমি জার্মানিতে ছিলাম দুই বছর। উনআশির অক্টোবরে গিয়েছিলাম, ফিরে আসি একাশির অক্টোবরে। এক ফাঁকে বোনকেও নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। পরে তিনজন একসঙ্গে ফিরেছি। তবে দেশে ওরা শেষ পর্যন্ত থাকেনি। আমেরিকায় সেটেল করেছে।

জার্মানির অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। পুরোপুরি শ্রমিকের জীবন। কখনো আধুনিক কসাইখানার কাজ, কখনো শপিংমল ধোঁয়া মোছার কাজ, তারপর এক কিচেনের হাঁড়িপাতিল ধোয়ার কাজ আর ঘাড়ে করে আলুর বস্তা টানা, ম্যাকডোনাল্ডে বার্গার বানাবার কাজ, হলিডেইন হোটেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একদিন এমন কান্না পেল! যত ছোটই হই, আমি একজন লেখক। সেই আমি টাকার জন্য এসব কী করছি? তাও নিয়মিত কাজ থাকে না। কাজ পারি না। এক দুই মাস পর চলে যায়। আবার নতুন কাজ খুঁজি। আহা রে, কী কষ্টের জীবন! কী অপমানের জীবন! ফিরে এসে সেই অভিজ্ঞতার কথা ‘পরাধীনতা’ উপন্যাসে লিখেছিলাম। একদিন বিকালে কাজ শেষ করে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি। সিনডেলফিনগেন থেকে স্টুটগার্টে ফিরব। আমার পাশে বসে আছেন একজন জার্মান বৃদ্ধা। ততদিনে টুকটাক জার্মান বলতে শিখেছি। বৃদ্ধা টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করছেন, জবাব দিচ্ছি। তিনি যাবেন এক জায়গায়, আমি অন্যত্র। বৃদ্ধার বাস আগে চলে এলো। বাসে ওঠার আগে তিনি আমার হাতে একটা পাঁচ মার্কের কয়েন গুঁজে দিলেন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি বৃদ্ধার বাস চলে গেছে। কয়েন হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে থাকি। বৃদ্ধা আমাকে এতই দরিদ্র ভেবেছেন যে, পাঁচটি মার্ক ভিক্ষে দিয়ে গেলেন। কয়েনটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে হু হু করে কেঁদেছিলাম আমি। সেই বিকালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশে ফিরে যাব। এই জীবন আমার না। দেশে গিয়ে যা হোক কিছু একটা করে জীবন কাটাব। টাকা-পয়সা জমাতেই পারিনি। দুই মাস কাজ করে তিন মাস বসে থাকি। দেশে ফেরার সময় আমার পকেটে ছিল মাত্র ৪০০ ডলার।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর