রবিবার, ৫ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে

ওয়াহিদা আক্তার

তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে

দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট্ট ভূখণ্ড বাংলাদেশ। আমাদের পূর্ব-পুরুষদের গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ থাকায় আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। ব-দ্বীপ এই বাংলাদেশের একমাত্র সম্পদ আমাদের উর্বর সমতল ভূমি ও অভিজ্ঞ কৃষক। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ যুবলীগের জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলার সম্পদ আছে, বাংলার সম্পদ বাংলার মানুষ। বাংলার সোনার মাটি। বাংলার মাটিতে হয় না এমন জিনিস নাই’। স্বাধীনতার সময় এ দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭০.৫ মিলিয়ন, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৭০ মিলিয়নে। মাছ-ভাত ঘিরেই আমাদের খাদ্যাভ্যাস। এই খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে সদ্য স্বাধীন দেশে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছিল। প্রতিশ্রুত চাল আমদানি করতে না পারায় একটি দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা সহজ হয়েছিল। সেই বাংলাদেশ দানাজাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, যাকে স্বাধীনতার অর্জন হিসেবে সবাই আখ্যায়িত করছে। এখন চীন, ভারতের পরই বিশ্বে শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে চালের খাদ্য ছাড়াও বহুবিধ ব্যবহার, যা নন হিউম্যান কনজাম্পশন। মৎস্য চাষে, হাঁস-মুরগি গবাদি পশুপালনে খাদ্য হিসেবে মুড়ি, চিড়া, পিঠার জন্য চালের গুঁড়া তৈরিতে বেকারি শিল্পে কী পরিমাণ চাল ব্যবহার হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১১ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের মাথাপিছু চালের চাহিদা হিসাব করে দেখা যাচ্ছে- প্রতিদিন চালের চাহিদা প্রায় ৭০ হাজার মে. টন, এক মাসে ২১ লাখ মে. টন। বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ টনের মতো চাল ব্যবহার হয়। অথচ চাল উৎপাদন হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে প্রায় ৪ কোটি টন। আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৭০ ভাগ আমরা ধান উৎপাদনে ব্যবহার করছি। সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে ১ কোটি টনের বেশি আলু এবং বছরব্যাপী ২ কোটি ২৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে।

পিঁয়াজ ৩৪-৩৬ লাখ টন উৎপাদন হওয়ার পরও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় বাজার অস্থিতিশীল থাকছে। পিঁয়াজ চাষিদের জন্য পিঁয়াজ সংরক্ষণের অহিমায়িত ঘর তৈরি করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভার নির্দেশে সবজি সংরক্ষণে বিভাগভিত্তিক কোল্ড স্টোরেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পৃথিবীতে চাল রপ্তানিকারক দেশ হলো ভারত, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল রপ্তানিকে নিরুৎসাহিত করছে। এ বছর চাল টনপ্রতি ৬৫০ মার্কিন ডলার হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৩৫০ মার্কিন ডলার। আমার জানামতে, চাল সবচেয়ে দামি খাদ্যশস্য। আলু, গম ও যব প্রধান খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়। প্রত্যেকটি দেশ তাদের নিজস্ব খাদ্যপণ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে অর্থ বিনিয়োগ করায় কৃষি সাফল্যের মুখ দেখছে।

পরিকল্পনা মোতাবেক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ধান, গম, ভ্ট্টুা, আলু, পিঁয়াজ, সবজি, তেলজাতীয়, ডালজাতীয় ও মসলাজাতীয় ফসলের চাষ করা হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় বোরো ধানের সঙ্গে ভুট্টা এগিয়ে গিয়ে বছরে ৬৪-৬৫ লাখ টন উৎপাদন হচ্ছে। বোরো মৌসুমে প্রতিযোগিতায় কৃষক ধান উৎপাদনে প্রাধান্য দেওয়ায় এবং স্বল্পকালীন শীত মৌসুমে গমের জমি না পাওয়ায় মাত্র ১০-১২ লাখ টন উৎপাদন হয়, অথচ দেশে চাহিদা ৬০-৬৫ লাখ টন। চাহিদার বাকিটা আমদানি করতে হয়। তেলজাতীয় ফসল সরিষা উৎপাদনে কর্মসূচি দিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরিষার উৎপাদন ১১.৬৩ লাখ মে. টন, যা আগের বছরের তুলনায় ৩.৩৭ লাখ মে. টন বেশি। দেশের প্রতিটি জমিতে প্রায় তিনটি ফসল হচ্ছে। সেচের সুবিধা সম্প্রসারিত হলে কৃষিও সম্প্রসারিত হয়। সার, বীজ, সেচ তিনটি উপকরণে কৃষি এগিয়ে যায়।

এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে- বঙ্গবন্ধুকন্যার এ আহ্বানে মানুষ আশাতীত সাড়া দিয়েছে। জমি ফেলে রাখাটা এখন অপরাধ বোধ সৃষ্টি করছে। যে প্রসঙ্গের প্রাককথন হিসেবে এই লেখার অবতারণা হয়েছে, তা হলো কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। শিল্পোন্নয়নের কথা ভিন্ন কারণ। আমাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বেকারত্ব হ্রাস ও কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পোন্নয়ন প্রয়োজন; কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যেমন রিনিউয়েবল এনার্জি, গ্রিন এনার্জি, ক্লিন এনার্জি নামে শত শত হেক্টর জমি কৃষি থেকে প্রতিনিয়ত অন্য খাতে চলে যাচ্ছে। প্রতি মেগাওয়াট সোলার এনার্জি উৎপাদনে ২.৫ একর জমিতে সোলার প্যানেল বসাতে হয়। শত শত একর কৃষিজমি এক একটি সোলার প্রজেক্টে যাচ্ছে। সেখানে নীতিমালা পরিবর্তন করে চাষযোগ্য কৃষিজমির বিকল্প খুঁজে রাস্তার দুই পাশে, প্রতিষ্ঠানের ছাদে, মহাসড়কের পাশ দিয়ে সোলার প্যানেল বসানো যায়। নীতিমালায় অনুর্বর, এক ফসলি জমি হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিনিয়ত দুই-তিন ফসলি উর্বর কৃষিজমিকে অনুর্বর উল্লেখ করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মাছ আমাদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ অঞ্চলে তিন ফসলি জমি, ধানের উর্বর জমি কেটে পুকুর করার যেন মহোৎসব চলছে। বিভাগীয় কমিশনার, রাজশাহীকে প্রশাসনিকভাবে এদের নিবৃত করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য কৃষিজমি চাষের বহির্ভূত হয়ে গেছে। বর্তমানে যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নে রিসোর্ট তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যেখানে শুধু বিনোদনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আইটেম সাজানো থাকে। রিসোর্ট মালিকরা অবস্থাসম্পন্ন। প্রতিটি রিসোর্টের একটি অংশ কৃষি ফার্ম হাউসের মতো ব্যবহৃত হলে দৃষ্টিনন্দন কৃষি ফার্ম তৈরি হতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। বেশকিছু শৌখিন শিল্প মালিক হাঁস-মুরগি, গবাদি পশুপালন, দুধ, ঘি, মাখন উৎপাদনসহ উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদন করছেন। কৃষি পেশাকে লাভজনক মনে করে কৃষিকে এখন আর অবহেলা করে কেউ দূরে রাখছে না। ছাদকৃষিতে প্রচুর পানি প্রয়োজন হয়। এই ঢাকা শহরে আনুমানিক ২ কোটি লোকের বাস। পানির সমস্যা মেটানো হয় চড়া মূল্যে। শোনা যায়, পৃথিবীর অনেক দেশ শুধু পানির প্রাপ্যতা না থাকায় পরিত্যক্ত নগরী ঘোষণা হতে সময় গণনা করছে।

আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা ভবিষ্যৎ কৃষিকে টেকসই করতে স্বল্পজীবনকাল, উচ্চ ফলনশীল ও লবণাক্তসহিষ্ণু, রোগবালাই প্রতিরোধী, সার, সেচ কম প্রয়োজন হয় এমন বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনে নিরলস কাজ করছেন। উন্নত বিশ্বের কৃষি গবেষণার সঙ্গে আমাদের দেশের কৃষি গবেষণার সম্পর্কোন্নয়ন ও জোরদার করা হচ্ছে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের দ্রুত জাত উদ্ভাবনে স্পিড, ব্রিডিং, বায়োটেকনোলজির ওপর প্রশিক্ষণ নিতে উচ্চশিক্ষায় প্রেরণ করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। স্মার্ট কৃষি যেন স্মার্ট বাংলাদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেজন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কৃষিকে প্রযুক্তিনির্ভর, যান্ত্রিক শক্তিনির্ভর গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত মৌসুমি ফল-সবজি রপ্তানির জন্য আন্তর্জাতিক মানের অ্যাক্রিডেটেট ল্যাবরেটরি, বাষ্প তাপ শোধন প্লান্ট ও ই-রেভিয়েশন প্লান্ট বসানো হচ্ছে।

সারের পরিমিত ব্যবহারে উৎপাদন খরচ কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করে সেচের প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হচ্ছে। কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতি পাঁচ বছর অন্তর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের লব্ধ তথ্য ব্যবহার করে অনুমোদিত সার ব্যবহারের নির্দেশনা প্রকাশ করে থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ১০০ কৃষি প্রযুক্তি এটলাস উদ্বোধনে ক্রপ জোনিংয়ের নির্দেশনা দেন। সেই নির্দেশনা মোতাবেক ‘খামারি অ্যাপস’-এর মাধ্যমে কৃষক তাঁর জমিতে দাঁড়িয়ে কী ধরনের ফসল উৎপাদন করতে পারেন, এতে তাদের কতটুকু সার প্রয়োজন হবে তার গাইড পেয়ে যাচ্ছেন। সহজে ব্যবহারযোগ্য খামারি অ্যাপসটি মাঠে ব্যবহারে কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ পরিমিত সার ও সেচ ব্যবহার করে কৃষক উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনছে। আবার অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্বুদ্ধকরণ প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে দৃশ্যমান ফল লাভের পর কৃষক পরিমিত সার ও সেচ ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা পেতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা বাস্তবায়ন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর স্ব-স্ব ম্যান্ডেট অনুযায়ী কৃষিকে এগিয়ে নিতে তৎপর রয়েছে। প্রতি ইউনিয়নের তিনজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন, যারা কৃষকের সেবায় মাঠে অবস্থান করেন।

পৃথিবীতে সব দেশই কোনো না কোনো বিষয়ে অন্য দেশের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন হয়। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক উন্নয়ন হয়। কিন্তু কভিড-১৯ অতিমারি আমাদের শিখিয়েছে প্রধান খাদ্যশস্য দেশে উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়তনের একটি দেশে বিশাল জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে অন্যটি নেই। এজন্য আমাদের কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য। টাকা থাকলেই খাদ্যশস্য কিনতে পাওয়া যায় না। পরিশেষে আবারও কৃষিজমি রক্ষার আবেদন জানিয়ে ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতার চরণ দিয়ে শেষ করছি আজকের লেখা :

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু,

নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ,

তুমি কি বেসেছ ভালো?

লেখক : কৃষি সচিব

সর্বশেষ খবর