সোমবার, ৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

কখনো হার মানতে নেই!

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

কখনো হার মানতে নেই!

১. আমি লিখেছিলাম, কিন্তু লেখাটা এখনো লিখছি, কারণ কিছু কিছু লেখা কখনো ফুরিয়ে যায় না, বরং ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আবার নতুন করে জন্ম নেয়, হয়তো বদলে যায় মুখগুলো, বদলে যায় সময়গুলো, বদলে যায় চেনা-অচেনা পথগুলো। এমন একটি লেখা... ওদের আজ শেষ ক্লাস ছিল, আর আমি আজ ওদের প্রথম ক্লাস শুরু করলাম। খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে বিষয়টা।  কিন্তু এটাই সত্য। জ্ঞানের যাত্রা কখনো শেষ হয় না, বরং জ্ঞানের রূপান্তর ঘটে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ রূপান্তর চলতেই থাকে। খুব সাধারণ একজন শিক্ষক আমি, বড় বড় শিক্ষকদের ভিড়ে হয়তো আমাকে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। মেঘে-ঢাকা তারা আমি, তারাদের অন্তরালেই থাকতে চাই আজীবন।  কিন্তু ওদের নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে, আমাকে ঘিরে ওরা যখন চারপাশে গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তখন মনে হয় ওরা আমার মতো বৃত্তের একটা ছোট বিন্দুকে কত বড় করে ফেলেছে। একদিন হয়তো সেটা দেশ হবে, দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব হবে, বিশ্ব ছাড়িয়ে মহাবিশ্ব হবে, মহাবিশ্ব ছাড়িয়ে বিশ্বব্রহ্মা- হবে।

ওরা খুব মেধাবী, খুব সৃষ্টিশীল, ওদের চোখে-মুখে চাঁদের হাসির বাঁধভাঙা স্বপ্ন, মা-বাবা-ভাই-বোনদের বিবর্ণ মুখগুলোতে ফুল ফোটানোর মতো হাসি ফোটানোর অপেক্ষায় ওরা উদগ্রীব। ওদের অনেক ত্যাগ, সেই ত্যাগের মূল্য কতটা দিতে পেরেছি তা জানি না। তবে ওদের বলেছি দুটো জিনিস কখনো ভুলো না। এর একটি হলো আর্ট, আরেকটি হলো মোটিভেশন। এ দুটো জিনিস যদি নিজের ভিতরে গড়তে পার তবে তোমাকে নিয়ে নতুন ইতিহাস লেখা হবে। এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ওরা যেখানেই পা ফেলবে সেখানেই ইতিহাস গড়বে।

এতটা পথ খুব সহজে পাড়ি দেয়নি ওরা, যতটা পথ পাড়ি দিয়েছে তার থেকে বেশি জীবনের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ক্লান্ত শরীর অবশ হয়েছে কখনো। কখনো দেয়ালের ওপাশটাতে লুকিয়ে কষ্টের দিনগুলোতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। কখনো অভিমানী মন খুঁজেছে একটু আশ্রয়। তবে স্বপ্নকে কখনো ভুলে যায়নি ওরা, বিশ্বাসকে কখনো হারায়নি ওরা। সেই বিশ্বাসের ওপর ভর করা স্বপ্নযাত্রা সেদিন ১০০-তে ১০০০....০০০০ পেয়ে সফল হবে যেদিন ওরা বলবে না ওরা আমার ছাত্র ছিল বরং আমি মাথা উঁচিয়ে গর্ব করে বলব আমি ওদের শিক্ষক ছিলাম। এটা যে আমার স্বপ্ন, এটাই যে আমার পরম পাওয়া হবে হয়তো। জানি আমার এ স্বপ্নগুলো ওরা কখনো ভাঙবে না বরং স্বপ্নের পর স্বপ্ন পেরিয়ে স্বপ্ন পূরণের ওদের বিজয় রথটা এগিয়ে যাবে অনন্তকাল। কারণ ওরাই আমাকে শিখিয়েছে কখনো হার মানতে নেই। কখনো জীবনকে থামিয়ে দিতে নেই। কখনো ভাঙা মেরুদন্ড নিয়ে চলতে নেই। যেখানে চলতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যেতে হয়, সেখানেই মাটির নিচে শিকড়ের জন্ম দিয়ে শক্তভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়। ওদের দেখতাম শীতে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছে, তীব্র গরমে কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে শরীরে, খেয়ে না খেয়ে দৌড়ে এসেছে ক্লাসে, তারপরও মুখের উজ্জ্বল হাসিটা ওরা ধরে রেখেছে। সেই অমৃত মধুর হাসিটা আমৃত্যু দেখব বলে আবার নতুন করে ক্লাসটা শুরু করলাম। ওরা বিস্মিত হলো। হয়তো সেই বিস্ময় থেকেই জন্ম নেবে বিখ্যাত মানুষেরা। যাদের নিয়ে পৃথিবী মহা উৎসবে মেতে উঠবে। আর আমি যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলব, সন্তানরা যখন শিক্ষককে ছাড়িয়ে যায় তখন এর চেয়ে বড় আনন্দের, অহংকারের ও অর্জনের কোনো কিছুই আর হতে পারে না।

২. শিক্ষকতাকে আগে মহান পেশা বলে মনে করা হতো। এর অনেকগুলো কারণ ছিল। কারণ আমরা যে শিক্ষকদের কাছে পড়ে এসেছি তাঁদের চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁরা একেকজন দিকপাল ছিলেন। কেবল চিন্তা নয়, তাঁদের আচার-আচরণ, সততা, সরলতা, বিনয়, সাদাসিধা জীবনযাপন সবকিছুর মধ্যেই একটা সাধারণ মানুষের ছাপ ছিল, কিন্তু অসাধারণ তার শক্তি ছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল- তাঁদের ব্যক্তিত্ব, স্বকীয়তা ও কাজের প্রতি ভালোবাসা। মাথানত করার মতো কাপুরুষ তাঁরা ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন একেকজন সাহসী মানুষ, নীতির প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। তাঁরা শিক্ষক ছিলেন, শিক্ষকতাকেই নিজেদের মধ্যে লালন করতেন, প্রশাসক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে নির্লজ্জ হওয়ার মতো মনোভাব তাঁদের মধ্যে কখনো ছিল না। ছাত্রদের পরম যতেœ পড়াতেন, নিজেরা লাইব্রেরিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়তেন, নিজের সবটুকু জ্ঞান উজাড় করে দিতেন। তখনো তাঁদের বেতন কম ছিল, তাতে কী, টেনেটুনে সংসার চালিয়েও তাঁদের মুখের মধ্যে যে হাসিটুকু লেগে থাকত তা কি কখনো ভুলে থাকা যায়। এত দালানকোঠার মতো সুরক্ষিত শিক্ষালয় ছিল না, কিন্তু শিক্ষা ছিল, শিক্ষার ভিতর মহতী চিন্তার শক্তি ছিল। ইন্টারনেট ছিল না, হোয়াইট বোর্ড, মার্কার, স্মার্টবোর্ড ছিল না, হলোগ্রাফিক টেকনোলজি, ইউটিউব, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ছিল না; কিন্তু চক-ব্ল্যাকবোর্ডের মধ্যে যে শিক্ষা ছিল, তা ছিল বিস্ময়কর।

এখন বুঝি, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এক জিনিস আর শিক্ষা আরেক জিনিস। প্রযুক্তি উন্নত হলেই যে শিক্ষা উন্নত হবে তা নয়, সেটাই তো দেখছি, প্রযুক্তি প্রতিদিন রং পাল্টাচ্ছে, শিক্ষাও রং পাল্টাচ্ছে, কিন্তু যে শিক্ষাটা আমরা ফেলে এসেছি সেই শিক্ষাটাই হারিয়ে গেছে, যদিও তখন প্রযুক্তির চেয়ে কাগজের বইয়ের মূল্য অনেক বেশি ছিল, কলম ও কলমের কালির দাম বেশি ছিল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলে চিৎকার করতে করতে এটার মোহ যতটা আমাদের ভারী করেছে, শিক্ষা ঠিক ততটা হালকা হয়েছে। আমি প্রযুক্তিবিরোধী নই, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা, পরিবর্তন, পরিবর্ধন নিয়ে জ্ঞান আহরণ করতে হবে, সেটা অতীতেও হয়েছে। প্রযুক্তির ধারা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। অনেক আগে প্রযুক্তির মৌলিক জ্ঞানগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ কমে এসেছে, এর পরিবর্তে মৌলিক জ্ঞান ব্যবহার করে নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে, যেটাকে আমরা বলছি ফলিত জ্ঞান। এখন মৌলিক জ্ঞান অর্জনের আগেই আমরা ফলিত জ্ঞানকে বিবেচনা করছি ও প্রয়োগের কথা বলছি। এর ফলে ফলিত জ্ঞানের সেই স্পেসিফিক বিষয়টিই আমরা জানছি, এর বেশি জানছি না। অথচ মৌলিক জ্ঞানের চর্চা সম্ভব হলে সেখান থেকে অনেক ফলিত জ্ঞানের উদ্ভাবন সম্ভব হতো। শিক্ষার বিপুল সম্ভাবনার জায়গাটিকে এভাবে আমরা সংকুচিত করে বাক্সবন্দি করছি। শিক্ষায় স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ ঘটানোর পরিবর্তে পরাধীন চিন্তার প্রতিফলন ঘটছে। কারণ প্রযুক্তির ভিতরের শিক্ষাটা আমরা নিতে পারিনি, প্রযুক্তিটাই নিয়েছি। প্রযুক্তির শিক্ষা নিতে পারিনি বলে নিজেরা নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্ম দিতে পারিনি, প্রযুক্তি নিয়ে নিজেরা চিন্তা করতে শিখিনি, বরং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিদেশনির্ভরতা বেড়েছে, স্বাধীন চিন্তা কক্ষচ্যুত হয়ে পরনির্ভরশীলতা মুখ্য হয়ে উঠেছে। সমস্যাটা এখানেই, একটা জায়গায় আমরা ভুল বুঝছি, আমরা বলছি প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়ন, এটা অনেকটা উপকরণগত, কেউ বলছি না, এর আগে শিক্ষকের উন্নয়ন দরকার, শিক্ষার উন্নয়ন দরকার, শিক্ষিত মানুষ হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়া দরকার, মানবিক উন্নয়ন দরকার। শিক্ষা অনেকটা চাকরিনির্ভর হয়ে গেছে, বস্তুগত বিষয় হয়ে গেছে। শিক্ষা যে অনেক পথ সৃষ্টি করতে পারে, সেই পথ চেনানোটা এখন আর শিক্ষার মধ্যে নেই।

সময় পাল্টেছে, দালানকোঠা বেড়েছে, প্রজেক্ট বেড়েছে, ইন্টারনেট, স্মার্ট বোর্ড, ইউটিউব সব এসেছে, কিন্তু শিক্ষাটাই হারিয়ে গেছে, শিক্ষকরাও হারিয়ে গেছেন। সবার কথা বলছি না, তবে সামগ্রিকভাবে এখন আর শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলে মনে করছি না; কারণ এখন শিক্ষকদের ভিতর কিছু কিছু শিক্ষক নামের আগাছা জন্মেছে, শিক্ষা আছে, শিক্ষার ভিতরে চিন্তা নেই, মহৎ ভাবনার উৎস নেই, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি নেই। সবগুলোই এখন অনেকটা বাণিজ্যিক, লোকদেখানো, ফাঁপা বুলির মতো; কারণ শিক্ষাও এখন বিক্রি করা পণ্যের মতো হয়ে গেছে, শিক্ষকরাও অনেক ক্ষেত্রে কেনাবেচার মতো পণ্যে পরিণত হয়েছে।

আবার বলছি, সব শিক্ষকের কথা বলছি না, তবে এমনটা ঘটেছে। সত্য তো সত্যই, সত্যকে হয়তো মিথ্যা বানানো যায়, মিথ্যাকে হয়তো সত্য বানানো যায়, সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে আংশিক সত্য-আংশিক মিথ্যার জন্ম দেওয়া যায়, কিন্তু নিজের ভিতরের মানুষটাকে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না। এখন শিক্ষকতার প্রতি শিক্ষকদের ঝোঁক কম, প্রশাসক হওয়ার দিকে ঝোঁক বেশি। এটা এত বেশি যে সেখানে নীতির সঙ্গেও আপস করতে কেউ কেউ অনেক বেশি উৎসাহী। বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে, ছাত্র বাড়ছে, শিক্ষক বাড়ছে, কিন্তু গুণী শিক্ষক বাড়ছে না, শিক্ষার মানও বাড়ছে না, বরং শিক্ষক হওয়ার চেয়ে শিক্ষকদের মধ্যে প্রশাসক হওয়ার লোভ বাড়ছে। এজন্য শিক্ষকদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি, নোংরা প্রতিযোগিতা বাড়ছে। এর মনস্তাত্ত্বিক চাপটা ছাত্রদের নিতে হচ্ছে, শিক্ষাকে নিতে হচ্ছে। সবচেয়ে নেগেটিভ যে বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা হলো- শিক্ষকরা এখন নিজেদের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করছেন। ছাত্রদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার আগেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে। শিক্ষায় এভাবে ভঙ্গুর এক ধরনের তত্ত্বের জন্ম হচ্ছে। ছাত্ররা শিক্ষকদের এ নৈতিক অধঃপতন দেখে মনে করছে, সব শিক্ষকই বুঝি এমন। একজন ছাত্রকে যখন একজন শিক্ষক বলছেন, তার কোনো স্বার্থ উদ্ধার করতে পারলে তিনি ছাত্রের লোভনীয় স্বার্থগুলো উদ্ধার করে দেবেন, তখন ছাত্ররা খুব কাছ থেকে বুঝতে পারছে শিক্ষকরা আর শিক্ষক নেই, বরং সুবিধাবাদী এক দুষ্টচক্রে পরিণত হয়েছে। এমন স্বার্থের দেওয়া-নেওয়াটা ভালোই লাগে, কিন্তু সেই ভালো লাগাটাই সবকিছুকে ধীরে ধীরে ছাইভস্মে পরিণত করছে।

এমন দেওয়া-নেওয়ায় শিক্ষকরা নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবছেন, নিজেদের যোগ্য ভাবছেন, জনপ্রিয় ভাবছেন, অথচ সেটা অনেকটা উইপোকার ঢিবির মতো, একটু ধাক্কা দিলেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। তবে সবকিছু ভেঙে যাওয়ার আগে মনে হয়, এটা যেন চিরস্থায়ী, এমনটাই স্বাভাবিক অথচ প্রকৃত বাস্তবতা হলো মিথ্যা ছলনায় আবেগ থাকে, খেলা থাকে, যা অনেক মানুষকে অন্ধভক্ত বানায়, ক্রীতদাস বানায়, কিছু বোঝার আগেই তা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা লেখকরাও বলেছেন, “মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্যে সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।” তেমনটাই দেখছি এখন, মিথ্যার বেসাতি উড়িয়ে ক্ষমতার সঙ্গে যোগসূত্র আছে বলে প্রচার করছেন যে শিক্ষকরা, তাঁদের মায়াজালে আটকে যাচ্ছে অনেকে। এমন শিক্ষকরা নিজেরা যা ইচ্ছা তাই করছেন, হয়তো দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান শক্তি তাঁদের পেছনে আছে বলেই এমনটা ঘটছে।

এদের শিক্ষক বলব নাকি আগাছা বলব, এটা হয়তো বিতর্কের বিষয়বস্তু হতে পারে। কারণ এখন মন্দটাকেই মানুষ ভালো বলছে, ভালোটাকেই মন্দ বলছে, বিতর্কের জন্ম দেওয়াই এখন মানুষের ধর্ম হয়ে গেছে। এখনো ব্যক্তিত্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে যে শিক্ষকরা কোনোমতে বাঁচতে চান, এদের মতো আগাছাদের কারণে তাও হয়ে উঠছে না। ছাত্ররা এই আগাছাদের দেখতে দেখতে বুঝতেও পারছে না, ব্যক্তিত্বের লেভেল সবার একরকম না। সব শিক্ষককে তারা একই লেভেলে ভেবে নিচ্ছে। এমনটা ঘটছে বলেই যে শিক্ষকরা শিক্ষার মহান ব্রত নিয়ে শিক্ষকতায় এসেছিলেন তাদেরও বিরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, বিব্রত হতে হচ্ছে। ঠিক উল্টো ঘটছে সবখানে, অযোগ্যতাকে ভাবা হচ্ছে যোগ্যতা, যোগ্যতাকে ভাবা হচ্ছে দুর্বলতা হিসেবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সবকিছু এভাবে ধীরে ধীরে অযোগ্যদের দখলে চলে যাচ্ছে, আরও যাবে, অযোগ্যদের পায়ের নিচে নিষ্পেষিত হতে হবে যোগ্যদের, বঞ্চনা, অভিমান, ক্ষোভে আর কখনো জন্ম নেবে না যোগ্যরা। এখনো যে গুণী শিক্ষক নেই, তা নয়, অনেক গুণী শিক্ষক আছেন, স্রোতের বিপরীতে তাঁদের নীতিকে ধরে রেখেছেন, কিন্তু এটা করতে গিয়ে প্রতিদিন তাঁদের নিজের সঙ্গে নিজেদের লড়তে হচ্ছে, বিবেকের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। তাঁরা জনপ্রিয় নন, বরং নিন্দিত, ধিকৃত। সমাজ যে এখন নিজেই নষ্ট হয়ে গেছে, নিজেই পচে গেছে, সেখানে নষ্টদেরই ভালো লাগবে, পচনটাই মনে হবে অমৃত সমান। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “এখানে অসতেরা জনপ্রিয়, সৎ মানুষেরা আক্রান্ত”? এখানেই থামছি, কারণ যেটা লিখতে চাচ্ছি, সেটা লিখতে গিয়ে থেমে যাচ্ছি, ভয় পাচ্ছি।  যেটা ভাবছি, সেটা লিখতে গেলে তার চরম মূল্যটা যে নিজেকেই দিতে হবে। দূর থেকে সবাই প্ররোচিত করবে, কেউ পাশে এসে দাঁড়াবে না, দাঁড়ায় না, এটাই বাস্তবতা, সবাই যে নিজেকে ভালো দেখাতে চায়, নিজেরটা ভালো বুঝে। আর এভাবেই স্বার্থের কাছে ভালো মানুষেরা হেরে যায়, বেশির ভাগ মানুষের নীরবতায়, নিষ্ক্রিয়তায়, নিরপেক্ষতায়। তারপরও বলব, জীবন মানেই যুদ্ধ, কখনো হার মানতে নেই।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর