বুধবার, ৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

কৃষিতে দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার

মেজর আখতার (অব.)

কৃষিতে দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার

বাংলাদেশে পাওয়া প্রস্তর যুগের সরঞ্জামগুলোতে ২০ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তাম্র যুগের বসতির অবশিষ্টাংশ, পিট বাসস্থানসহ ৪ হাজার বছর আগে অস্ট্রোএশিয়াটিক, তিব্বত-বর্মন, দ্রাবিড় এবং ইন্দো-আর্যরা পরপর অভিবাসনের ধারায় বাংলায় বসতি স্থাপন করেছিল। কৃষি ও নিওলিথিক তথা নব্য-প্রস্তরযুগীয় বিপ্লব মানব ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য বাঁক হিসেবে চিহ্নিত করেছে যা প্রাচীন সমাজগুলোকে যাযাবর শিকারির জীবনধারা থেকে বসতিবদ্ধ কৃষি সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত করেছে। যদিও নিওলিথিক বিপ্লব প্রায়শই মেসোপটেমিয়া ইরাক বা নীল উপত্যকা মিসর বা এবং সিন্ধু উপত্যকার মতো অঞ্চলগুলোর সঙ্গে জড়িত, তবে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি অঞ্চল বাংলায় এর প্রভাবও ছিল গভীর। নব্য প্রস্তরযুগীয় মানব বসতি মূলত গড়ে উঠেছিল সমুদ্রের সৈকত ঘেঁষে নদীর মোহনায়। সমুদ্রের সৈকত ছিল চলাচলের সহজ পথ। নিওলিথিক বিপ্লব তথা নব্য প্রস্তরযুগীয় বিপ্লব মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে চিহ্নিত করে, যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মানব সমাজগুলো জড়ো হওয়া পশু শিকার থেকে স্থায়ী কৃষি এবং পশুদের গৃহপালনে রূপান্তরিত করে নিজেদের স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিল। এ পরিবর্তনের ফলে মানব সমাজে গভীর পরিবর্তন ঘটে, যার মধ্যে রয়েছে স্থায়ী বন্দোবস্তের বিকাশ, জটিল সামাজিক কাঠামোর উত্থান, বিশেষায়িত শ্রম ভূমিকার উত্থান এবং পদ্ধতিগত কৃষি প্রতিষ্ঠা।

বাংলায় নিওলিথিক বিপ্লব কয়েক হাজার বছরে উ™ূ¢ত হয়েছিল, যার ফলে স্থায়ী বসতি স্থাপন করা কৃষি সম্প্রদায়ের উত্থান এবং ধান, ডাল ও বাজরার মতো ফসলের চাষের উদ্ভব হয়েছিল। উর্বর গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ তার সমৃদ্ধ পলিমাটি এবং প্রচুর পানির উৎসসহ প্রাথমিক ও প্রাকৃতিক কৃষি চাষের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছিল। বাংলায় নিওলিথিক যুগের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন ছিল উদ্ভিদ ও প্রাণীর গৃহপালন। এ অঞ্চলের প্রাচীন বাসিন্দারা বেছে বেছে ধানের মতো বন্য উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধি ও চাষ শুরু করেছিল যা জীবিকা নির্বাহের প্রাথমিক উপায় হিসেবে কৃষির বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। গবাদিপশু, মহিষ এবং শূকরের মতো পশুর গৃহপালনও কৃষি পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চাষের জন্য শ্রমের বিকাশ এবং খাদ্যের একটি স্থির উৎস ও ভান্ডার তৈরি করেছিল। কৃষিতে উত্তোরণ বাংলায় উল্লেখযোগ্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, যার ফলে স্থায়ী কৃষি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে, যা স্থায়ী বসতি স্থাপন এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা রাখে। কৃষির মাধ্যমে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত শ্রমের বিশেষীকরণের কারিগর, ব্যবসায়ী এবং শাসক অভিজাতদের উত্থানের পথ তৈরি করে। অধিকন্তু কৃষি গ্রহণের স্থায়ী ব্যবস্থার ফলে জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি এবং জটিল সমাজ গঠনকে সহজতর করেছে। কৃষকদের দ্বারা উৎপাদিত উদ্বৃত্ত খাদ্য অকৃষি কার্যক্রমকে সরাসরি সহায়তা করে, যা নগর এবং বাণিজ্য কার্যক্রমের সক্ষমতা গড়ে তুলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষির এ উন্নয়নগুলো প্রাথমিক রাজ্যগুলোর উত্থান এবং বাংলায় অত্যাধুনিক ও উন্নত সভ্যতা বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

সংক্ষেপে, নিওলিথিক বিপ্লব বাংলার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল যা শিকারি-সংগ্রাহক অঞ্চল থেকে স্থায়ী কৃষি সম্প্রদায় এবং জটিল সমাজের উত্থানের বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত করেছিল। কৃষি বাংলার অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে দিয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী হাজার বছরের ইতিহাসকে রূপায়িত করেছে। বাংলাদেশের সভ্যতার ইতিহাস চার হাজারেরও বেশি সময় ধরে সেই তাম্র যুগ থেকে চলে আসছে। বাংলার প্রারম্ভিক ইতিহাস হচ্ছে আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য হিন্দু ও বৌদ্ধ সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার ইতিহাস। পরবর্তিতে সপ্তম শতাব্দীতে এ অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে সামরিক বিজয়ের পাশাপাশি হজরত শাহজালালের মতো সুন্নি মুসলমানদের নিরলস প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে ইসলাম এদেশে প্রভাবশালী ধর্ম হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা মসজিদ নির্মাণ ও সুফি সাধকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে এ অঞ্চল শাহী বাংলা হিসেবে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ কর্তৃক শাসিত হয় যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এবং আঞ্চলিক সাম্রাজ্যগুলোর ওপর সামরিক আধিপত্যের সূচনা করে। ইউরোপীয়রা সে সময় এ শাহী বাংলাকে বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে ধনী দেশ বলে উল্লেখ করে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলটি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। বাংলা সুবাহ গোটা মুঘল সাম্রাজ্যের জিডিপির প্রায় অর্ধেক এবং বিশ্ব জিডিপির ১২% উৎপাদন করে যা সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের থেকেও বেশি ছিল। এ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রাথমিক শিল্পায়ন যুগের সূচনা করে। এ সময় রাজধানী শহর ঢাকার জনসংখ্যা কয়েক লাখ দাঁড়ায়।

প্রাচীন বাংলার গর্ব করার মতো সাফল্য ও অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হয়েছিল শুধু কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুবাদে। সেদিন প্রাচীন বাংলায় কোনো আমদানি ছিল না, ছিল শুধু রপ্তানি। প্রাচীন বাংলার কৃষকেরা চাল, ডাল, নুন, তেল, ঘি, মাখন, মাছ, মাংস, ডিম, সব আমিষ, ফলফলাদি, তুলা, কার্পাস, রেশম, পাট, কাঠ, বাঁশ, বেত, সরিষা, আদা, রসুন, পিঁয়াজ, সব ধরনের মসলা নিজেরাই উৎপাদন করত। উৎপাদন করার সব কলাকৌশল, শিক্ষাধিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সব প্রাচীন বাংলার কৃষকদের ছিল। শুধু কৃষিতেই নয়, শিল্প উন্নয়নেও তারা অগ্রগামী ছিল। নব্য প্রস্তর যুগে তারা পাথর খোদাই ও পাথরের দ্রব্যাদি তৈরি করতে পারত। তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগেও প্রাচীন বাংলার বসতিরা তাম্র ও ব্রোঞ্জ ব্যবহার করতে জানত। তাদের তাম্র ও ব্রোঞ্জের উৎপাদিত দ্রব্যাদি ক্রয় করতে সুদূর আরব থেকে এসে জাহাজ ভরে নিয়ে যেত। প্রাচীন বাংলার উৎপাদিত কার্পাস ও তুলার কাপড় তৎকালীন সারা বিশ্বে সমাদৃত ছিল। রেশম ও মসলিন কাপড়ে প্রাচীন বাংলা ছিল জগৎসেরা। ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলে শুধু বাংলার পাট বিক্রি করেই ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতি টিকে থাকত। কিন্তু স্বাধীন বাংলদেশে শাসকদের ভ্রান্ত কৃষি নীতির কারণে আজ আমরা বিশ্বের বাজারে অভুক্ত ও সস্তা শ্রমিকের দেশে পরিণত হয়েছি। গাঁটের ৫-১০ লাখ টাকা খরচ করে ৩ লাখ টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে রেমিট্যান্সযোদ্ধা বলে কপট গর্ব দেখাচ্ছি। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তায় দর্জিগিরি করে মেয়েদের ঘাম ও রক্ত বিক্রি করে স্বল্প উন্নত দেশে ওঠার মাতলামি করছি। অথচ ২০০ বছর আগেও আমরা বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র ছিলাম। আজকে আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আজকে পিঁয়াজ পাওয়া যায়তো মরিচ পাওয়া যায় না, তেল পাওয়া যায়তো নুন পাওয়া যায় না। সকালে যে দ্রব্যের দাম থাকে ১০ টাকা বিকালে হয়ে যায় ২০ টাকা। আর জ্ঞানী, গুণী ও অর্থনীতিবিদরা টেলিভিশনে বসে হিসাব কষেণ প্রতিদিন কী হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে আর চুলচেরা হিসাব করেন দ্রব্যমূল্য কীভাবে তাদের জন্য সস্তায় রাখা যায়! উৎপাদনের খবর নেই আর সারা দিনরাত গিলার ধান্দা!

প্রাচীন বাংলা কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কারণে পাশাপাশি শিল্প বিপ্লবও ঘটেছিল। সেই শিল্প বিপ্লব ছিল মূলত কৃষি ও হস্তশিল্পের। সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক উন্নত সমাজ ও বাজারের কারণে সারা বাংলায় গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার কুটির ও হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান, যারা কৃষিজ কাঁচামাল রূপান্তরিত করত বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, ভোগবিলাসী খাদ্য, ব্যবহার্য আসবাবপত্র, কৃষিজ ও হস্তশিল্পের যন্ত্রপাতি এবং সাজ-সরঞ্জামাদি। চাল থেকে বানাত মুড়ি, মুড়কি, পিঠা, চিড়া ইত্যাদি পণ্যদি যা বাজারে বাজারে এবং বিভিন্ন পালা পার্বণে ও মেলায়  খোলাবাজারে বিক্রি হতো। নিজেদের উৎপাদিত তুলা ও কার্পাস থেকে তৈরি করত অতি উচ্চ মানের মিহি বস্ত্র। রেশম থেকে তৈরি করত বিশ্ব খ্যাত মসলিন। তামা কাসা থেকে তৈরি করত অতি উচ্চমানের গৃহস্থালি দ্রব্যাদি। সোনা রুপা থেকে তৈরি করত বিশ্বমানের অলংকারাদি। নিজেদের গাভীর দুধ থেকে তৈরি করত মিঠাই মিষ্টি যা সারা বিশ্বে সমাদৃত ছিল। বাংলার পাটের ছিল বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া বাজার। কৃষকের মুখে হাসি ফুটাত এ পাট, যাকে বলা হতো সোনালি আঁশ। আরব, স্পেন, ইতালি, ইউরোপের বাজারে ছিল বাংলার কৃষিজ ও হস্তশিল্পের পণ্যের রমরমা বাজার।

বাংলাদেশ সুদূর প্রাচীনকাল থেকে সুখী সমৃদ্ধ একটি জনপদ ছিল। কিন্তু ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কবজায় যাওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে শ্মশানে পরিণত হয়েছে। বাংলার অর্থনৈতিক অবক্ষয় মূলত শুরু হয় ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে। ১৮ শতকের শেষদিকে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। শিল্প বিপ্লব ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যা কৃষি ও হস্তশিল্প অর্থনীতি থেকে শিল্পোন্নত অর্থনীতিতে রূপান্তরকে চিহ্নিত করেছিল। এটি ১৮ শতকের শেষদিকে ব্রিটেনে শুরু যা পরে বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে বিশ্বের সমাজ, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে ফেলে। ১৭৬৪ সালে জেমস হারগ্রিভসের স্পিনিং জেনির উদ্ভাবন, ১৭৭০-এর দশকে জেমস ওয়াটের দ্বারা বাষ্প ইঞ্জিনের প্রবর্তন এবং কারখানায় টেক্সটাইল উৎপাদনের যান্ত্রিকীকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ বিশ্বের শিল্প উৎপাদনে ব্যাপক বিল্পব সাধিত হয়। শিল্প বিপ্লব ভেঙে দেয় কৃষি ও হস্তশিল্পকে। শিল্প বিপ্লবের পরে উৎপাদনে ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়ে যায়, ফলে একদিকে উৎপাদন খরচ কমে যায়, পাশাপাশি অল্প সময়ে ব্যাপক উৎপাদন বেড়ে যায়। শিল্প পরিবহনে ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণের কারণে কৃষি ও হস্তশিল্প একদম মাঠে মারা যায়। ওই সময় ইউরোপিয়ান অর্থনীতিতে যান্ত্রিকীকরণ শিল্প ও পরিবহনব্যবস্থায় ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়। যার ফলে খুব অল্প সময়ে ব্রিটেনসহ ইউরোপের উৎপাদন বহু গুণে বৃদ্ধি পায় যা সরাসরি বাংলার কৃষি ও হস্তশিল্পের চরম সর্বনাশ ডেকে আনে। ব্রিটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন নেওয়ার পরে বাংলার অর্থনীতিতে চরম ধস নামে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কৃষি ও হস্তশিল্পকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ব্রিটেনের শিল্পের জন্য বাংলাদেশকে কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ হিসেবে রূপান্তরিত করে বাংলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলে। বাংলাদেশের পাট দিয়ে ব্রিটেনের ডান্ডি থেকে পাটকলে সুতা বানিয়ে তা দিয়ে পাটের বস্তা বানিয়ে আবার তা বাংলাদেশেই রপ্তানি করা হতো। বাংলার পাহাড়ে জঙ্গলের দামি দামি সেগুন, মেহগনিসহ বিভিন্ন গাছ কেটে নিয়ে গিয়ে সেখানে চায়ের বাগান তৈরি করা হয়েছিল ব্রিটেন ও ইউরোপের চায়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য। কৃষকদের বাধ্য করা হয়েছিল নীল চাষ করার জন্য। ব্রিটেনের বস্ত্রকলগুলোকে বাঁচানোর জন্য বাংলার তাঁতিদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। বাংলায় রেললাইন বসিয়ে স্বল্প পরিবহন খরচে এদেশ থেকে কৃষিজ কাঁচামাল, বন ও খনিজ সম্পদ লুটে নিয়ে যান্ত্রিক জাহাজে তাদের দেশে নিয়ে শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে বাংলাদেশকে তাদের বাজারে রূপান্তরিত করে যা এখনো অব্যাহত আছে। অথচ আমাদের কৃষিজ কাঁচামাল, বন, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ ব্যবহার করে ১৮ শতকের শেষদিকে বাংলাদেশেও শিল্প বিপ্লব ঘটানো যেত তাহলে আজকে বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন হতো। কিন্তু ইংরেজ শাসকেরা এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকেরা বাংলার মাটিতে শিল্প বিপ্লবকে প্রসারিত হতে দেয়নি। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকশিত হতে পারেনি। তাই আজকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হলে আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে ফিরে যেতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত করতে হবে, কৃষি উৎপাদনে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের খাদ্যবাজারে অগ্রগামী সরবরাহকারী হতে হবে, ভোজ্য তেল, চিনি, ডাল, চালসহ সব কৃষিজ পণ্যের ও বিভিন্ন খাদ্য আমদানি শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে কৃষি ও খাদ্যশিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমদানিনির্ভর জ্বালানি তেলের বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উৎপাদনে শতভাগ সৌরবিদ্যুৎ উৎসকে ব্যবহার করতে হবে।  মোদ্দা কথা হলো- আমাদের যে কোনো মূল্যে আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। এ লক্ষ্যে সব পর্যায়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কার্যকরী পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ তৈরি করতে হবে। পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার জন্য সব বিষয়ের ওপর গবেণা করার ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে বিষয়ভিত্তিক লাগাতার গবেষণা করে সঠিক পথ ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেবে যা রাষ্ট্র অর্থ সংগ্রহ করে সময় মতো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করবে। আমাদের সোনার বাংলা ফিরে পেতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক : স্বতন্ত্র ভাবাপন্ন রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর