বুধবার, ৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

হজ ফরজ হয় নবম হিজরিতে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হজ ফরজ হয় নবম হিজরিতে

মহান আল্লাহতায়ালার মনোনীত জীবনব্যবস্থা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হজ। শুধু উম্মতে মুহাম্মদী নয়, পৃথিবীর শুরু থেকে যত নবী রসুল এসেছেন সবাই হজ করেছেন। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভী (রহ.) রসুল (সা.) এর হজের ওপর একটি চমৎকার গ্রন্থ লিখেছেন। সেখানে তিনি একটি দারুণ তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী বাবা আদম (আ.) প্রথম হজকারীও ছিলেন।’ অর্থাৎ, মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই হজের নিয়ম প্রচলন ছিল বলে তিনি দাবি করেছেন। তার দাবি মতে, ‘বাবা আদম (আ.) হিন্দুস্তান থেকে পায়ে হেঁটে হজ করেছেন। এভাবে পুরো জিন্দেগিতে তিনি চল্লিশবার হজ করেছেন।’ ‘আল কুরা লিকাসিদিল উম্মুল কুরা’ গ্রন্থকারের মতে, ‘বাবা আদম পায়ে হেঁটে সত্তরবার হজ করেছেন।’ তবে এ হজের বিস্তারিত বিষয়ে কোনো তথ্য মাওলানা কান্ধলভী উল্লেখ করেননি। আল ‘হাকনা’ কিতাবের সূত্রে জাকারিয়া কান্ধলভী আরও উল্লেখ করেন, ‘কোনো কোনো গবেষকের মতে, এমন কোনো নবীর আগমন ঘটেনি যিনি হজ করেননি।’

রসুল (সা.) এর হজের আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা ইবনে কায়্যিম (রহ.) তার বিখ্যাত জাদুল মাআদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘যখন হজ ফরজ হলো তখন রসুল (সা.) হজের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।’ ইবনে কায়্যিমের এ বক্তব্যটির ব্যাখ্যা করে জাকারিয়া কান্ধলভী (রহ.) ‘হাজজাতুল বিদা ও উমরাতুন নবী’ গ্রন্থে লিখেন- ‘হজ ফরজ হয়েছে নবম অথবা দশম হিজরিতে। এরপর তিনি হজ ফরজ হওয়া সম্পর্কে উলামাদের বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন।’

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি হজ ফরজ হওয়া সম্পর্কে পঞ্চম হিজরি থেকে দশম হিজরি পর্যন্ত বিভিন্ন সালের কথা উল্লেখ করলেও এ ব্যাপারে তিনি নিজে কোনো মতকে প্রাধান্য দেননি। তবে ইমাম কুরতুবির বরাতে তিনি লিখেছেন- ‘ইমাম কুরতুবি নবম হিজরিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।’ একইভাবে মোল্লা আলী কারি হানাফি হজের ফরজ হওয়ার বিষয়ে ১২টি মত উল্লেখ করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তার ফতোয়া গ্রন্থে হজ ফরজ হওয়া সম্পর্কে উল্লেখ করেন- ‘এ ব্যাপারে আলেমদের ইজমা হয়েছে তথা ঐকমত্য রয়েছে যে, হজ ফরজ হয়েছে ষষ্ঠ হিজরির পরে। এর আগে হজ ফরজ হয়নি।’ যদিও এখানে ইজমার দাবি করা হয়েছে কিন্তু মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভী (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ আওজাজুল মাসালিকে পঞ্চম হিজরিতে হজ ফরজ হয়েছে বলেও একটি মত উল্লেখ করেছেন। ইমাম রাফেয়ি (রহ.) তার ‘কিতাবুল হজ’ গ্রন্থে নিশ্চিত করেই বলেছেন, হজ ফরজ হয়েছে পঞ্চম হিজরিতে। ‘আল মুনতাকা’ গ্রন্থেও পঞ্চম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে মত দেওয়া হয়েছে। ‘আল খামিস’ গ্রন্থের লেখক নিশ্চিত করেই বলেছেন যে, ‘হজ পঞ্চম হিজরিতেই ফরজ হয়েছে।’

আল মাওয়াহিবে লাদুনিয়্যাহ গ্রন্থের লেখক ইমাম কাস্তালানি (রহ.) বলেন, ‘অধিকাংশ আলেমের মতে হজ ফরজ হয়েছে ষষ্ঠ হিজরিতে। কেননা, ওয়াআতিমুম্ম হাজ্জা-আয়াতটি ওই হিজরিতেই নাজিল হয়েছে।’ শাফেয়ি আলেমদের মধ্যে ‘আল রাওজা’ গ্রন্থের লেখকও একই কথা বলেছেন- ষষ্ঠ হিজরিতে হজ ফরজ হয়েছে। তবে ইবনে আবেদিন শামী (রহ.) নবম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। তিনি নিশ্চিত হয়ে বলেছেন, ‘যারা নবম হিজরির আগে হজ ফরজ হওয়ার কথা বলেছেন তাদের কাছে কোনো দলিল বিদ্যমান নেই।’ কাজি আয়াজের বরাত দিয়ে ইমাম তাহাভি (রহ.) উল্লেখ করেছেন, ‘নবম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার মতটিই বিশুদ্ধ।’

নবম হিজরিতে হজ ফরজ হলেও রসুল (সা.) হজ করেছেন আরও এক বছর পর, অর্থাৎ দশম হিজরিতে। ইতিহাসে যা বিদায় হজ নামে সুপরিচিত। কেন রসুল (সা.) এত বছর দেরি করে হজ করলেন এর জবাবে ইবনে আবেদিন শামী বলেন, ‘সম্ভবত হজের মৌসুম চলে যাওয়ার পর হজ ফরজ হওয়ার বিধান নাজিল হয়েছে। যে কারণে রসুল (সা.) ওই বছর আর হজ করতে পারেননি।’ আর মাজাহিরে হক গ্রন্থকার বলেন, ‘হজের মৌসুমের আগেই আল্লাহ হজ ফরজ করেছেন। কিন্তু ওই বছর রসুল (সা.) হজ না করার কারণ হলো- তিনি হজরত আবু বকর (রা.)-কে মক্কায় পাঠিয়েছেন এ কথা ঘোষণার করার জন্য যে, এখন থেকে মুশরেকি পদ্ধতিতে কাবায় আর হজ করা চলবে না। আগামী বছর থেকে ইসলামী পদ্ধতিতে হজ সম্পাদন হবে এবং শুধু মুসলমানরাই হজ করতে পারবে।’

 লেখক : চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর