বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

তারকাময় রাজনীতি ভালো নয়

তসলিমা নাসরিন

তারকাময় রাজনীতি ভালো নয়

শিল্পীদের কাজ শিল্প নিয়ে থাকা। কিন্তু শিল্পীরা যখন জনপ্রিয় হতে হতে আকাশে উড়ে যান, আকাশে উড়তে উড়তে তারকা বনে যান, মানুষের নাগালের বাইরে, ধরাছোঁয়ার বাইরে, তখন কী ঘটে? আকাশ থেকে মহাকাশে বিচরণের পর তাঁদের কিন্তু ইচ্ছে করে মর্ত্যইে নেমে আসতে, তারকাখ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে অন্যরকম খ্যাতি অর্জন করতে। এই খ্যাতির সঙ্গে জুড়ে আছে অর্থ এবং ক্ষমতা। ক্ষমতার আছে অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য। এই চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যের প্রতি আকর্ষণ আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে কার নেই?

তারকারা সব দেশেই রাজনীতিতে ঢোকেন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে তারকা থেকে রাজনীতিক হওয়ার প্রবণতা লাগামছাড়া। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনীতিকরা ক্ষমতার কাঙাল নন। উত্তর ইউরোপের দেশগুলোয় এক সময় দেখেছি রাজনীতিকদের অনেকেই গাড়িতে চড়েন না, অতি সাধারণ মানুষের মতো সাইকেল চালিয়ে বাড়ি থেকে অফিসে, অফিস থেকে বাড়িতে যান, নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে বাইরে বেরোন না। তাঁরা দুর্নীতি করেন না, চুরি করেন না, তাঁরা যেটা মন দিয়ে করেন, সেটা জনগণের সেবা। রাজনীতির এমন শুদ্ধ স্বচ্ছ আর সুস্থ সুন্দর পরিবেশ উপমহাদেশে নেই। থাকলে আমার মনে হয় না কোনও তারকার শখ হতো রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার।

সিনেমা, সংগীত, স্পোর্টস-মূলত এই ক্ষেত্রগুলোই তারকা তৈরি করে। আর এই উপমহাদেশ শতভাগ তারকাপাগল উপমহাদেশ। তারকাপাগল বলেই রাজনীতির র-ও যাঁরা জানেন না, তাঁরাও নিজের তারকাখ্যাতিকে পুঁজি করে ভোট পান, রাতারাতি সাংসদ বনে যান। ওদিকে রাজনীতিকদের মধ্যে বসে আছেন কিছু গণ্ডমূর্খ, কিছু প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্ধ লোক। প্রগতিশীল কেউ যদি থেকেও থাকেন, প্রগতিশীলতাকে গোপন রেখে তাঁদের রাজনীতি করতে হয়। তাঁরা কেবল শিখেছেন কী করে মানুষকে মিথ্যে বলে বা ধোঁকা দিয়ে ভোট আদায় করতে হয়। এভাবে অনভিজ্ঞ আর ধোঁকাবাজদের সমন্বয়ে, আমার আশঙ্কা, আমাদের সংসদ একদিন ভয়াবহ ব্যর্থতার সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। প্রায়ই তো দেখি সংসদগুলোতে হাতাহাতি মারামারি চুলোচুলি চলছে। সংসদে বসে সাংসদদের ঘুমোনো খুব পরিচিত একটি দৃশ্য। সংসদে বসে কেউ কেউ তো মোবাইলে পর্নোও দেখেন।

ভারতের বিপুলসংখ্যক অভিনেতা অভিনেত্রী রাজনীতিতে নেমেছেন। তাঁদের সংখ্যা আমার বিশ্বাস, বিশ্বের যে কোনও দেশের তারকা-রাজনীতিকদের তুলনায় বেশি। ভারতের রাজনীতিকরা ভালো অভিনয় জানেন, নাকি তারকারা? এই প্রশ্নটি উঠতে পারে। কেউ কেউ কিন্তু বলেন, সিনেমার তারকাদের চেয়ে অভিনয় ভালো জানেন রাজনীতিকরা। সে কারণেই হয়তো সিনেমার তারকারা যেমন রাজনীতিতে নামেন, তেমন রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকেই সিনেমায় নামেন। সিনেমার তারকাদের রাজনীতিতে নামানো শুরু হয় ষাট দশকে। বলিউডের অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুরকে রাজ্যসভার সদস্য বানিয়েছিলেন কংগ্রেস দলের শীর্ষ নেতাগণ। এরপর থেকে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত লোকেরা রাজনীতিতে নজর দিতে থাকেন। রাজনৈতিক দলে নাম লেখানোর উৎসাহ বেড়ে যায় প্রচণ্ড। রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়াতেই হয়তো রাজনীতিকরা তারকাদের দলে ঢোকাতে চান। দিলীপ কুমার, বৈজয়ন্তীমালা, এম জি রামাচন্দ্রন, জয়ললিতা, অমিতাভ বচ্চন, জয়া বচ্চন, শত্রুঘ্ন সিনহা, গোবিন্দা, হেমা মালিনী, রাজেশ খান্না, সুনীল দত্ত, বিনোদ খান্না, স্মৃতি ইরানি, রজনীকান্ত, কামাল হাসান, মাধাবান, রাজ বাব্বর, জয়াপ্রদা, রূপা গাঙ্গুলি, পরেশ রাওয়াল, সন্ধ্যা রায়, কিরণ খের- এরকম মোট ১৫৩ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল পার্টিতে নির্বাচনের আগে আগেই তারকাদের দলে ভেড়ানো হয়েছে। জেতার ইচ্ছে থেকেই তাড়াহুড়ো করে তারকাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনে। মুনমুন সেন, মিমি চক্রবর্তী, নুসরাত জাহান জিতে এলেন। শতাব্দি রায়, রূপা গাঙ্গুলি, লকেট চ্যাটার্জি, বাবুল সুপ্রিয়, দেব- টোপ অনেকেই গিলেছেন। শিল্প-সাহিত্য-নাট্য জগতের তারকাদের কাউকে ভোটে দাঁড় করিয়েছেন, কাউকে আবার দল থেকে নানারকম সুবিধে দিয়ে দলভুক্ত করেছেন। কবীর সুমন, শাঁওলি মিত্র, ব্রাত্য বসু, জয় গোস্বামী, যোগেন চৌধুরী- এরকম অনেকেই তাঁদের শিল্প-সাহিত্যের নাও ভিড়িয়েছেন রাজনৈতিক দলের ঘাটে। সবাই ভোটে না দাঁড়ালেও দলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। মুশকিল হলো, অনেকে দলদাসে পরিণত হন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের ধুলো পরিষ্কার করে দেন, সাহিত্য না-জানা মুখ্যমন্ত্রীকে সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করেন।

তারকাদের ভক্তরা দলকে পছন্দ না করলেও তারকাদের ভালোবাসে। তারকারা তাঁদের ভক্তদের ভোটেই জিতে যান নির্বাচনে। দলে তারকা নিয়ে এলে বিরাট লাভ রাজনৈতিক দলের। রাজনীতিক হিসেবে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য লম্বা সময় তারকাদের পার করতে হলো না, রাজনীতিতে তাঁদের দক্ষতাও দেখাতে হলো না, অথচ দিব্যি এক তুড়িতে বিজয়ী হয়ে গেলেন। দলের নেতারা যেমন তারকাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চান, তারকারাও চান রাজনৈতিক দলকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে। দল চায় নির্বাচনে জেতা, তারকা চায় ক্ষমতা। রাজনৈতিক কোনও আদর্শ ছাড়াই অনেক সময় তারকারা রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। সঙ্গত কারণেই তাঁরা জনগণের সব দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হন। এক সময় তারকাদের কেউ কেউ নিজের মান-সম্মান বাঁচিয়ে রাজনীতির অঙ্গন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ভারতে ১৫৩ জন অভিনেতা অভিনেত্রী রাজনীতিতে নেমেছেন। সংখ্যাটি অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশি সিনেমার নায়িকা কবরী, ফারুক, ফেরদৌস রাজনীতি করেছেন, অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর অনেকদিন মন্ত্রী ছিলেন। গায়িকা মমতাজ, বেবী নাজনীন, কনকচাঁপাও রাজনীতিতে নেমেছেন। দলের অনেক নেতাই তারকা নিয়ে সুখী হলেও দলের অনেক কর্মীই ক্ষুব্ধ। দীর্ঘকাল দলের আদর্শে এবং কর্মে নিষ্ঠাবান থেকে, নিবেদিত প্রাণ হয়ে যে সুবিধে পান, তার চেয়ে ঢের বেশি পান উড়ে এসে জুড়ে বসা তারকারা, যাঁরা রাজনীতির কিছুই জানেন না, দলের আদর্শ সম্পর্কেও যাঁদের জ্ঞান নেই।

এই উপমহাদেশে সিনেমার মতোই ক্রিকেট অত্যন্ত জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে পাকিস্তানের ক্রিকেট তারকা ইমরান খান রাজনৈতিক দল শুরু করেছেন, নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। রাজনীতিতে ঢুকেছেন মোহাম্মদ আজহারুদ্দিন, নভোজত সিং সিধু, গৌতম গম্ভীর, মনোজ তিওয়ারি, কীর্তি আজাদ, চেতন চৌহান, শ্রীলঙ্কায় অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনৎ জয়সুরিয়া। বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা মাশরাফি আর সাকিব এখন রাজনীতিতে নেমে ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন। সিনেমার তারকাদের মতোই ক্রিকেট তারকারা রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ। তাঁরা শুধু দলের শোভা বাড়াবার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছেন।

সাকিব আল হাসান বদরাগী মানুষ। তাঁকে দেখে ভক্তরা উত্তেজিত হলে তিনি তাদের অপমান করতে দ্বিধা করেন না। সেদিন তো এক ভক্ত তার সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইলে ভক্তের ঘাড় ধরে রীতিমতো গালে চড় কষালেন অথবা চড় কষাতে চাইলেন। তিনি ক্রিকেট তারকা হিসেবে প্রচুর নিরাপত্তা পান। কিন্তু রাজনীতিকদের তো মানুষের ভিড়েই থাকতে হয়। কেউ একটু ভক্তি দেখালেই তাকে চড়-থাপ্পড় মারতে হয় না। রাজনীতিকদের উদার হতে হয়, মানবিক হতে হয়। মানুষকে আবর্জনা হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখতে হয়। তাদের আবেগ উচ্ছ্বাস, তাদের সুখ দুঃখ, তাদের পাওয়া না-পাওয়াকে অন্তর থেকে অনুধাবন করতে হয়। তা না হলে রাজনীতির জগতে ঘোরাফেরা করা অর্থহীন।

রাজনৈতিক দলকে জনপ্রিয় করতে হলে সিনেমা থিয়েটার সংগীত আর খেলার জগৎ থেকে অরাজনৈতিক জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নানারকম লোভ দেখিয়ে দলে টেনে আনার প্রবণতা কেন? প্রশ্ন হলো, দলের রাজনীতিকরা কেন জনপ্রিয় হতে পারেন না? ভালো কাজ করলেই তো জনপ্রিয় হওয়া যায়, সেই ভালো কাজে কেন এত আপত্তি? মাঝে মাঝে ভাবি, রাজনীতিকদের কি সুস্থ রাজনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে? ছলে বলে কৌশলে ভোটে জেতাই তো রাজনীতিকদের মূল কর্ম নয়। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান থাকতে হয়। এসবকে রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র করতে হয়, এসবকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সব রকম উদ্যোগ নিতে হয়। সবার জন্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থান, সবার জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে হয়। দারিদ্র্য দূরীকরণের সব কর্মসূচি হাতে নিতে হয়। ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচাতে হয়। নারীর সমানাধিকার, সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হয়, পশু পাখিকে নিরাপদে রাখতে হয়। রাস্তা ঘাট, উঁচু উঁচু দালানকোঠা, লম্বা লম্বা ব্রিজ বানালেই মন্ত্রী মহোদয়দের দায়িত্ব শেষ হয় না। শাসকের দায়িত্ব জনগণকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনা। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস-ইত্যাদিকে কঠোর হস্তে দমন করা। মানুষের মধ্যে যুক্তিবুদ্ধির চর্চা বাড়ানোর এবং মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সুতরাং রাষ্ট্রে প্রতিক্রিয়াশীল মূর্খ লোকের বদলে প্রগতিশীল মুক্তচিন্তক দরকার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গোটা উপমহাদেশের শাসকদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তাধারার লোক কম। বেশির ভাগই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, নারীবাদী এবং মানবাধিকারের জন্য লড়াই করা মানুষের ব্যাপারে উদাসীন। শুধু উদাসীনই নয়, তাঁদের বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রায়ই দেখি আইন বানানো হচ্ছে। বাকস্বাধীনতা না থাকলে সমাজে কোনও বিবর্তন ঘটে না। আর বিবর্তন না ঘটলে সমাজ দুর্গন্ধ জলাশয়ের মতো স্থির হয়ে থাকে। আমাদের সমাজ নিঃসন্দেহে স্থির হয়ে আছে যুগের পর যুগ।

তারকা দিয়ে দেশ চালানো যায় না। দেশ চালানোর দায়িত্ব সৎ সুস্থ আদর্শবান রাজনীতিকদের নিতে হবে, দলে ক্রিকেটার, অভিনেতা অভিনেত্রী, সংগীতশিল্পীদের টেনে আনা বন্ধ হোক। যখন নিজেরা অকেজো, অচল, অকর্মণ্য, তখনই তারা তারকাদের টোপ দিতে বেরোন। যে দল যত বেশি অরাজনৈতিক তারকাকে দলের লোক হিসেবে প্রদর্শন করবে, সে দল, মনে রাখতে হবে, তত বেশি দুর্বল। রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে সুস্থ রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে, নিষ্ঠাবান স্বপ্নবান দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের দিয়ে। তারকাদের দিয়ে নয়।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর