শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

কয়েকটি আরব দেশ ইসরায়েলকে বাঁচিয়ে রেখেছে

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

কয়েকটি আরব দেশ ইসরায়েলকে বাঁচিয়ে রেখেছে

এ কথা এখন পরিষ্কার যে, বিগত ১৩ এপ্রিল ইরান ইসরায়েল অভিমুখে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপ করেছিল সেগুলোর মধ্যে কিছু মিসাইল ও ড্রোন ইসরায়েল তার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। এটাও নিশ্চিত যে, ইসরায়েলকে এ ব্যাপারে সৌদি আরব এবং জর্ডান প্রত্যক্ষভাবেই সহায়তা করেছে। ইরান নেহায়েতই সৌজন্যমূলকভাবে সৌদি আরবের কাছে তার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করলে সৌদি সরকার তা মার্কিন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মার্কিন সরকার ইসরায়েলকে বলে দেওয়ায় ইসরায়েল ইরানি পদক্ষেপ রুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পায়। আর জর্ডান ইরানি মিসাইল এবং ড্রোনগুলো তার দেশের আকাশসীমায় ধ্বংস করে দেয়। সেদিন এ দুটি আরব দেশ ইসরায়েলের পক্ষে এভাবে অবস্থান না নিলে যে ইসরায়েল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, শুরু থেকেই গুটিকয়েক আরব দেশের সহায়তা পেয়েই ইসরায়েল নামক মানবতার শত্রু দেশটি বেঁচে আছে। এ বিষয়টির চুলচেরা হিসাবের জন্য কিছুটা অতীত ঘাঁটতে হয়। বাঙালিদের, তুর্কিদের, ইরানিদের, চীনাদের, পাঠানদের, পাঞ্জাবি ইত্যাদিদের যেমন ভিন্ন ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক মানবগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, বর্তমানে বিরাজমান ইহুদি ধর্মের লোকদের ওই ধরনের কোনো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে ধরা যায় না। ইউরোপের ককেশীয় নৃতাত্ত্বিক গোত্রের মানুষের সংমিশ্রণে বর্তমানে যেসব বর্ণ সংকর ইহুদি ধর্মাবলম্বী রয়েছেন তাদের সেমেটিক গোত্রের লোক বলে বিবেচনা করা যায় না, কেননা তারা এখন বহু গোত্রের লোকের সংকরায়ণে সৃষ্ট। তারা একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারী এবং সেটিই তাদের পরিচয়।

বর্তমানে প্যালেস্টাইনসহ অন্যান্য আরব দেশের ওপর ইসরায়েল যে নির্যাতন চালাচ্ছে, সে ব্যাপারটি পরিষ্কার করে বলার জন্য প্রয়োজন ওই অঞ্চলের ইতিহাস এবং ধর্মগ্রন্থগুলোতে লেখা বর্ণনাগুলো পর্যালোচনা করা। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিম ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অনুযায়ী হজরত ইব্রাহিম এ তিন ধর্মের অনুসারীদেরই পয়গম্বর ছিলেন আর বিভাজন শুরু হয় তার দুই পুত্র থেকে। হজরত ইব্রাহিমের দুই স্ত্রীর ঘরের দুই পুত্রের একজন ছিলেন হজরত ইসমাইল এবং অন্যজন হজরত ইসহাক, যাকে ইহুদিরা আইজেক বলে থাকেন। হজরত ইব্রাহিমের কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক থেকেই ইহুদি ধারার সূত্রপাত। হজরত ইসমাইলের অনুসারীগণ ইসলাম ধর্মের দিকে ধাবিত হন আর ইসহাকের বংশধর এবং অনুসারীগণ ইহুদি ধর্মের সূত্রপাত ঘটান। দুটি ধর্মই সেমেটিক ধর্ম হিসেবে এজন্য আখ্যায়িত যে উল্লেখিত অঞ্চলে সেমেটিক ভাষা নামে যা প্রচলিত, আরবি এবং ইহুদিদের ভাষা হিব্রু এ দুটিই সেমেটিক ভাষার অন্তর্ভুক্ত। আরব এবং আদি (অমিশ্রিত) ইহুদিগণ সেমেটিক জনগোষ্ঠীর অংশ। মুসলমান এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো এই যে, অন্য ধর্মের কোনো অনুসারী ইহুদি ধর্মে রূপান্তরিত হতে পারেন না (অবশ্য এলিজাবেথ টেইলার ধর্মান্তরিত হয়ে ইহুদি হয়েছিলেন)। অর্থাৎ সে ব্যক্তিই ইহুদি ধর্মাবলম্বী যিনি ইহুদি পিতার সন্তান, অন্যদিকে যে কোনো ধর্মের লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হতে পারেন, যে প্রক্রিয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশ, ইরান, তুরস্ক, পূর্ব ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, এমনকি চীনের বেশকিছু লোকসহ বহু অঞ্চলের ভিন্ন ধর্মের লোক ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন।

ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে জানা যায় যে, হজরত ইব্রাহিম তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হজরত ইসমাইল এবং তার মাতাকে আরব ভূমিতে রেখে কনিষ্ঠ পুত্র হজরত ইসহাক এবং তার মাতাকে নিয়ে সেই অঞ্চলে চলে যান, তখন যার নাম ছিল কেন্নান অঞ্চল, যা এখনকার প্যালেস্টাইন। তওরাত (ইহুদিদের ভাষায় তোরা) অনুযায়ী হজরত ইসমাইলের বংশধর এবং অনুসারীগণ যেমন মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখিত এলাকায় বসবাস করছিলেন, ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক ইসহাক এবং তার পুত্র হজরত ইয়াকুব (ইহুদিদের ভাষায় জেকব)-এর বংশধর এবং অনুসারীগণও মধ্যপ্রাচ্যের সেই অঞ্চলে বসবাস করতে থাকেন যেটি এখন প্যালেস্টাইন এলাকাভুক্ত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজন্যবর্গ উক্ত এলাকা শাসন করেছেন। এক সময় এটি রোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। রোমান শাসনের সময় সম্রাট কনস্টেনটাইন এবং টাইটাস ইহুদিদের ওপর নির্যাতন চালালে তারা বিপুল সংখ্যায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে, বিশেষ করে রাশিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমান। ৭০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট টাইটাস জেরুজালেম ধ্বংস করেন, বহু ইহুদিকে হত্যা এবং ক্রীতদাসত্বে শৃঙ্খলিত করেন। ইউরোপীয় দেশগুলোতে বহু যুগ বসবাসকালে তারা ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ (ককেশীয় রক্তের) মানুষের সঙ্গে ব্যাপকহারে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলে তাদের সন্তানদের মধ্যে আর আদি সেমেটিক বৈশিষ্ট্য টিকে থাকেনি। তারা সংকর জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হন। এ কারণে যেসব ইহুদি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে গিয়েছিলেন (যারাই সিংহভাগ) তাদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে থেকে যাওয়া খাঁটি সেমেটিক নৃতাত্ত্বিক গোত্রের ইহুদিদের চেহারাগত ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, পরিষ্কার বোঝা যায় তারা ভিন্ন, শ্বেতাঙ্গ গোত্রের মানুষ। সে কারণে কার্ল মার্কস, আইনস্টাইন, রিচার্ড ওপেন হেইমার, এলেক্স লায়ন (প্রাক্তন ব্রিটিশ মন্ত্রী), ইহুদি মেনোহিন, হ্যারিসন ফোর্ড, মিলা কুনিস, নাটালি পোর্টম্যান, ডেভিড অ্যানাবল, শীন এপলবি, জেনিফার গুডউইন, জোসেফ গর্ডো, এন্ড্রু গারফিল্ড, ক্যাট ডেনিংস, জ্যাক এফরন, জেমস ফ্রান্স, কেইট হাডসন, সারা পার্কার, স্কারলেট জোহানসন, জেমস ফ্যাংকো, ডাসটিন হপম্যান, ডেনিয়েল রেডক্লিফ, রশিদা জোস, মার্ক জুকারবার্গ, জেমাইমা গোল্ডস্মিথ, জেমস মাইকেল গোল্ডস্মিথ, ডেভিড বার্গম্যান, টবি ক্যাডম্যানসহ বহু ইহুদি ধর্মাবলম্বীর কারও চেহারায়ই সেমেটিক কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই, তাদের ককেশীয় (আর্য) রক্তের শ্বেতাঙ্গই মনে হয়।

রাশিয়ায় জার শাসন আমলে এবং জার্মানিতে আর্য শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার গোষ্ঠীর লোকদের হাতে ইহুদি ধর্মের লোকেরা নিপীড়নের শিকার হন। তাছাড়া ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে থিউডোর হার্জল নামক এক ইহুদি সাংবাদিক/আইনজ্ঞ ১৮৯৬ সালে ইহুদিবাদ তত্ত্ব প্রচার শুরু করে এই মর্মে দাবি উত্থাপন করেন যে, ইহুদিদের জন্য একটি ভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া তাদের মুক্তি নেই এবং সেই রাষ্ট্রের জন্য তিনি পূর্ব-আফ্রিকার উগান্ডাকে বেছে নিয়েছিলেন। বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেসের এ সভাপতি, থিউডোর হার্জলের পরিবারও ইউরোপে পাড়ি জমানোদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরিতে অভিবাসন নিয়ে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। ইহুদিদের জন্য উগান্ডায় রাষ্ট্র স্থাপন পরিকল্পনা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলে তিনি বর্তমান প্যালেস্টাইন এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রস্তাব করে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সব ইহুদি ধর্মাবলম্বীকে কেন্নান (প্যালেস্টাইন) এলাকায় চলে যেতে উৎসাহিত করেন। এলাকাটি তখন তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। হার্জল অটোম্যান সুলতান আবদুল হামিদ এবং জার্মান সম্রাট উইলহেলস-এর কাছে নিবেদন করে সাড়া না পেলেও ইউরোপে বসবাসরত ইহুদিরা দলে দলে প্যালেস্টাইন এলাকায় গমন শুরু করেন এবং এক সৌদি প্রভাবশালীর সহায়তায় সেখানে জমি কিনতে শুরু করেন। সে সময়ে প্যালেস্টাইন এলাকায় মুখ্যত আরব জনগণই বসবাস করছিলেন। তবে ৪ শতাংশের মতো সেসব ইহুদিই বসবাস করছিলেন যারা কখনো ইউরোপে পাড়ি দেননি। অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে নির্ভেজাল সেমেটিক ইহুদিগণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালেও লুকিয়ে হাজার হাজার ইহুদি জার্মানি থেকে প্যালেস্টাইন এলাকায় গমন করেন, যার ফলে ১৯৪৫ সালের মধ্যে উক্ত এলাকায় ইহুদিদের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যায়, যাদের সিংহভাগই ছিল বর্ণ সংকর শ্বেতাঙ্গ ইহুদি ধর্মাবলম্বী। ১৯০৪ সালে থিউডোর হার্জল মৃত্যুবরণ করলেও তার নির্দেশনা ইহুদিরা অনুসরণ করতে থাকেন। ১৯১৪ সালে প্রথম মহা সমর শুরু হলে গোটা বিশ্ব পরিস্থিতি উলটপালট হয়ে যায়। অটোম্যান সাম্রাজ্য তখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে, জার্মানি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়ার সঙ্গে থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফরাসি দেশ এবং ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। ব্রিটিশ সরকার তখন প্রাণপণ চেষ্টা চালায় ইস্তাম্বুলভিত্তিক অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মিত্র পাওয়ার জন্য জাইনিস্ট বা ইহুদিবাদীদের হাত করার। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে সে সময়ের ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্ল বেলফোর চরম চতুরতার আশ্রয় নিয়ে ১৯১৭ সালে বিশিষ্ট ইহুদি ব্যাংক মালিক লায়নেল ওয়াল্টার রথচাইল্ডের কাছে এক পত্র লিখে জানান যে, ব্রিটিশ সরকার অটোম্যান সম্রাটদের কাছ থেকে প্যালেস্টাইনের দখল পেলে তারা সে এলাকায় ইহুদিদের রাষ্ট্র তৈরি করে দেবে। ইতোমধ্যে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের এই মর্মে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যে, অটোম্যানদের বিতাড়িত করা গেলে প্যালেস্টাইন ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে পড়বে। লর্ড বেলফোরের সেই পত্র বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত যা ইউরোপে বসবাসরত ইহুদিদের মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। ব্রিটিশ সরকার সেখানে তাদের চাতুর্যপূর্ণ ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনুসরণ করে প্যালেস্টাইনের আরবদেরও হাতে রাখার চেষ্টায় রত থাকে। কর্নেল মেকমেহন নামক এক পরিপক্ব ব্রিটিশ কূটনীতিক, যিনি তিব্বত এবং ভারতের সীমানা নির্ধারণের জন্য ১৯১৪ সালে ‘মেকমেহন লাইন’ তৈরি করেছিলেন, প্যালেস্টাইনের আরবদের কাছেও প্রতিজ্ঞা করেন যে, প্যালেস্টাইনে আরবদের জন্যও রাষ্ট্র করা হবে অর্থাৎ সেখানে ইহুদি এবং আরব উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই রাষ্ট্র হবে। প্রথম মহাসমর সমাপ্তির পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্যালেস্টাইন শাসনের ম্যান্ডেট পায়। ১৯৩৭ সালে লর্ড পিলের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন প্যালেস্টাইন ভাগ করে ইহুদি এবং আরবদের জন্য রাষ্ট্র তৈরির পরামর্শ দেয়। পরে উডহিড কমিশন লর্ড পিল কমিশনের রিপোর্টে কিছুটা পরিবর্তন আনার পর ব্রিটিশ সরকার প্যালেস্টাইন বিভক্তির পরিকল্পনা অনুমোদন করে। তবে ব্রিটিশ সরকার এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ইউরোপ থেকে বছরে ৭৫ হাজারের বেশি ইহুদি প্যালেস্টাইনে যেতে পারবেন না, কেননা এরই মধ্যে ইউরোপ থেকে ব্যাপকসংখ্যক ইহুদি ধর্মাবলম্বী লোক প্যালেস্টাইন এলাকায় গমন করলে সেখানে আরব এবং ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আরব জনগণ প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে বিরোধিতা করেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে গোটা পৃথিবী প্রভাবিত হতে থাকে। চার বছরব্যাপী সেই যুদ্ধকালে জার্মানির নাৎসি সরকার কমবেশি ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালাতে থাকায় সে দেশ থেকে বিরাট ইহুদি জনসংখ্যা প্যালেস্টাইনে পালিয়ে যায়। গোটা প্যালেস্টাইনে তখন স্থানীয় এবং ইউরোপফেরত শ্বেতাঙ্গ ইহুদির সংখ্যা বিপদসংকুল পর্যায়ে পৌঁছে। সেই সঙ্গে ইহুদি এবং প্যালেস্টাইনি আরবদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ইহুদিরা বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী প্যালেস্টাইন এলাকায় তাদের জন্য রাষ্ট্র স্থাপনের দাবি জানালে ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি নবগঠিত জাতিসংঘ কর্তৃক সমাধানের জন্য ছেড়ে দিলে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্ব সংস্থা প্যালেস্টাইনকে দুই ভাগে ভাগ করে ৫৫% ইহুদিদের আর ৪৩% আরবদের জন্য এবং জেরুজালেম শহরকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ভারত এবং আরব দেশগুলোসহ ১৩টি দেশ প্যালেস্টাইনকে ভাগ করে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ভোট দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ৩৩টি দেশ প্যালেস্টাইন বিভক্তির পক্ষে ভোট দেওয়ায় তা গৃহীত হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল এই যে, ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই দেশটিও ইহুদি ধর্মবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবে ভোট দিয়েছিল। অথচ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রতত্ত্ব সমাজতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এক বছর পরে ১৯৪৯ সালে তুরস্কও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৪৮ সালের মে মাসে প্যালেস্টাইনের ওপর থেকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হলে ইহুদি নেতা ডেভিড বেন গুরিয়েন সে বছরের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেন। অথচ জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও আরবদের জন্য প্যালেস্টাইনে কোনো রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়নি। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কোনো প্যালেস্টানিয়ান প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি, তাদের কোনো বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরদিন কয়েকটি আরব দেশ সম্মিলিতভাবে ইসরায়েল আক্রমণ করে ৯ মাস যুদ্ধ চালিয়ে পরাজিত হয় এ কারণে যে, ইসরায়েলি সেনারা মার্কিন সামরিক সহায়তা পাচ্ছিলেন। উক্ত যুদ্ধের পর ইসরায়েল জাতিসংঘ প্রদত্ত ৫৫% জমির বাইরেও আরবদের জন্য বরাদ্দকৃত ৪৩% জমির অংশও দখলে নেয়। শুধু ১৯৪৮ সালেই সব আরব দেশ একত্রিত হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তারপর আরব বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু পরিবর্তন ঘটে। বিপ্লবের মাধ্যমে বহু দেশ থেকে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করা হয়। ১৯৫২ সালে মিসরে জেনারেল নজিব এবং কর্নেল জামাল আবদুল নাসেরের নেতৃত্বে রাজা ফারুককে অপসারণ করে রাজতন্ত্র অপসারণ করা হয়। পরবর্তীতে ইরাক, লিবিয়াতে রাজতন্ত্র অপসারণ করা হলে বাকি রাজতন্ত্র শাসিত দেশগুলো রাজতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে তোলে আর যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট রাখার জন্য সেসব দেশ বিভিন্নভাবে ইসরায়েলকে রক্ষায় নামে। ১৯৫৪ সালে জেনারেল নজিবের বিদায়ের পর কর্নেল নাসের আরব জগতের নেতার ভূমিকায় নেমে ইসরায়েলবিরোধী পদক্ষেপ জোরালো করতে থাকেন। আদিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নও ইসরায়েলবিরোধী হয়ে ওঠে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো, সেন্টো (আদিতে বাগদাদ চুক্তি), সিয়াটো প্রতিষ্ঠিত দেশগুলোর বাইরে থাকা দেশগুলো পণ্ডিত নেহরু, সুকর্ণ, মার্শাল টিটো, বেন বেল্লা, এন ক্রুমা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুললে কর্নেল নাসের সে আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা রাখা শুরু করেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক নীতি ঘোষণা করে ধর্মান্ধ দল ইসলামিক ব্রাদারহুডকে পরাস্ত করেন। ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে এ সাহসী নেতা সুয়েজ খালকে জাতীয়করণের ঘোষণা করেন। এতে ক্ষিপ্ত এবং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সে বছরের অক্টোবরের ২৯ তারিখ ব্রিটিশ-আমেরিকান অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েল মিসরের সিনাই অঞ্চলে আক্রমণ চালায়। এর দুই দিন পর যুক্তরাজ্য এবং ফরাসি দেশও মিসর আক্রমণ করে। মিসর যুদ্ধে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিশ্বসভায় কর্নেল নাসেরের ভাবমূর্তি আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। পূর্বে ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনে তিনি বিশ্বনেতা হিসেবে সম্মান পেয়েছিলেন। তবে পাকিস্তানসহ বহু আমেরিকাপন্থি দেশ ১৯৬৫ সালে মিসরকে সমর্থন করেনি। ১৯৬৬ সালের জুন মাসে মিসর-জর্ডান অতীতে ইসরায়েলের কাছে হারানো এলাকাগুলো দখলের চেষ্টায় ছয় দিনের যুদ্ধে নামলেও ইসরায়েলের কাছে পরাজিত হয়। ইসরায়েল তখল গোলান মালভূমি, সিনাই অঞ্চল, গাজা, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখলে নেয় এবং পুরো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে ইসরায়েলের আয়তন দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসরকে বেশকিছু ভূমি থেকে আকাশ মিসাইলসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছিল। কিন্তু সৌদি আরব, আমিরাতসহ আরব জগতের কিছু মার্কিন চাটুকার দেশের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মিসর হেরে যায়। তখন আরব দেশগুলো মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিলে ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করা যেত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আরব জগৎকে এক করার জন্য কর্নেল নাসেরের স্বপ্ন পূরণ মার্কিন তাঁবেদার আরব দেশগুলোর জন্য সম্ভব হয়নি। সে সময়ে শাহেন শাহ পাহলভি শাসিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সেন্টো)-ভুক্ত ইরান এবং সেন্টো ও নর্থ আটলান্টিক চুক্তি (ন্যাটো)-ভুক্ত তুরস্ক এবং এমনকি সেন্টোভুক্ত পাকিস্তানও মিসরবিরোধী অবস্থানে ছিল। সুয়েজ যুদ্ধে ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সাময়িক অর্থে কিছুটা জয়ী হলেও ইসরায়েল সুয়েজ খাল ব্যবহারের স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। শুধু তিয়ান স্ট্রেট এ জাহাজ চলাচলের সুবিধা পেয়েছিল। সুয়েজের ওপর মিসরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরব বিশ্বে সোভিয়েত প্রভাব বেড়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী অধিকার এবং ক্ষমতায়নের প্রভাব বেড়ে মুসলিম ব্রাদারহুড নামক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর পরাজয় ঘটেছিল।

১৯৭৩ সালে সে সময়ের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের মিসর এবং সিরিয়ান বাহিনী ইসরায়েলি দখলে রাখা সিনাই অঞ্চল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলে ইয়ম কিপুর নামের যুদ্ধে সৌদি আরবসহ রাজতন্ত্র শাসিত আরব দেশগুলোর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মিসর-সিরিয়া হেরে যায়। সেই যুদ্ধে পরাজয়ের পর আনোয়ার সাদাত ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। সেই যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের পর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে মিসর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করলে, এমন কথাও চাউর হয়েছিল যে, আনোয়ার সাদাত আসলেই সিআইএর চর ছিলেন এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে মিসরের পরাজয়ের জন্যও তিনি সিআইএকে তথ্য দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর মিসরকে আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইনকে সীমিত স্বীকৃতি প্রদানের কথা থাকলেও ইসরায়েল সে শর্ত কখনো পূরণ করেনি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এ কারণে প্রত্যাখ্যান করেছিল যে, এতে জাতিসংঘ এবং প্যালেস্টাইনকে পক্ষ করা হয়নি এবং প্যালেস্টাইনবাসীর দাবির প্রতিফলন ঘটেনি। অথচ ক্যাম্প ডেভিড নামক অসার চুক্তির ছুতায় আনোয়ার সাদাত ছাড়াও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মেনাখেম বেগিন, যার হাত শত সহস্র প্যালেস্টানিয়ানের রক্তে রঞ্জিত, ঠিক অতীতে যেমন নোবেল পেয়েছিলেন আরেক বিশ্ব খুনি কিসিঞ্জার। এরপর ১৯৯৪ সালে আব্রাহাম নামক আর একটি ফলশূন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মূলত জর্ডান এবং ইসরায়েলের মধ্যে। হজরত ইব্রাহিম ইহুদি এবং মুসলমান উভয় ধর্মের পয়গম্বর হিসেবে স্বীকৃত বিধায় এ চুক্তিকে ‘আব্রাহাম’ চুক্তি নাম দেওয়া হয়েছিল। প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট এবং ইসরায়েল ১৯৯৩ সালে অসলো শহরে যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করেছিল, সেগুলোও কোনো ফল বয়ে আনেনি। অন্যদিকে সেই নিষ্ফল চুক্তির জন্যও ইয়াসির আরাফাত ছাড়াও আরেক প্যালেস্টানিয়ান হন্তা ইসহাক রবিন এবং শিমন পেরেস নোবেল পেয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইন ভাগ করে আরবদের জন্য যেটুকু ভূমির কথা উল্লেখ করেছিল, অসলো চুক্তিতে সেটুকু ভূমির সামান্য অংশ প্যালেস্টানিয়ানদের দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়, কিন্তু তাও ইসরায়েল বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। এসব সময় নষ্ট করা চুক্তিগুলোর পরও ইসরায়েল আরবদের ভূমি দখল করে যাচ্ছে, প্যালেস্টানিয়ানদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলোর সামরিক সহায়তার কারণেই ইসরায়েল বেঁচে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- গুটিকয়েক আরব দেশও ইসরায়েলকে বাঁচিয়ে রাখার দায় এড়াতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রেই সৌদি আরবের নাম আসে। আরবদের মধ্যে এটি সবচেয়ে সচ্ছল এবং প্রভাবশালী দেশ। এ দেশটি এবং আরও কটি রাজতন্ত্র শাসিত প্রাচুর্যপূর্ণ আরব দেশ ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে মিসর, সিরিয়া, জর্ডান দেশগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নামলে তখনই ইসরায়েল নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখার জন্য এরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেনি, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়েছে। ১৯৮১ সালে সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়ে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান বহর ইরাকের পারমাণবিক চুল্লি আক্রমণ ও ধ্বংস করে দিয়েছিল। সৌদি আরব ইসরায়েলি বিমান বহরকে সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিয়ে ইরাক আক্রমণের জন্য ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে।

১৯৪৭ সালে প্যালেস্টাইন ভাগ করে সেখান থেকে প্যালেস্টাইনের মানুষদের উৎখাত করে ইহুদিদের জন্য ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদেরও বিরোধী। সেদিন জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি যথার্থই বলেছিলেন একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে নির্যাতিত হয়েছিল বলে প্যালেস্টাইনে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে, তাদের বাস্তুচ্যুত করে ইউরোপে বহু যুগ ধরে স্থায়ীভাবে বসবাসরত একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্র সৃষ্টি কোনো অবস্থায়ই যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি বলেছিলেন, একটি অন্যায় দিয়ে আর এক অন্যায় রোধ করা যায় না। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেদিন সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়ন এ কথা মানেনি। এটা সত্য যে, জার আমলে রাশিয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানিতে ইহুদি ধর্মের মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন, কিন্তু জার রাজত্ব শেষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে ইহুদি নিপীড়ন বন্ধ হয়েছে। আজ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফরাসিসহ যেসব ইউরোপীয় দেশে ইহুদি ধর্মের লোকেরা বসবাস করছেন, তারা সেসব দেশের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী এবং প্রভাবশালী। সুতরাং তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টি ততটাই ন্যায়নীতিবহির্র্ভূত ছিল ভারতবর্ষে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামক একটি ধর্মভিত্তিক পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি যতটা অযৌক্তিক ছিল।

অনেকে প্যালেস্টাইন সমস্যাকে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করছেন, যা মোটেও ঠিক নয়। এটি ইসরায়েল কর্তৃক মানবতার পদদলন। প্যালেস্টাইনে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী শুধু মুসলমানই নন, এখানে বেশকিছু সংখ্যক খ্রিস্টানও রয়েছেন। পিএলও এবং হামাসের অনেক নেতা-কর্মী খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। তাছাড়া সব ইহুদিই যে ইহুদিবাদী, তা নয়। এমনকি ইসরায়েলে এবং ইউরোপ-আমেরিকায় এমন বহু ইহুদি রয়েছেন যারা ইসরায়েলের ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক নীতির সমর্থক। গত কয়েক মাসে গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন হচ্ছে তাতে বহু ইহুদি অংশ নিয়েছেন যেমন অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মের মানুষ।

১৯৪৭ সালে প্যালেস্টাইন ভাগ করা নিশ্চিতভাবে ঠিক হয়নি, যে কথা তখন ভারতসহ ১৩টি দেশ বলেছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনামাফিকই প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়নি। মানবতার কল্যাণ, সে অঞ্চলে শিশুসহ গণহত্যা বন্ধ এবং পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা থেকে মানব জাতিকে রক্ষার জন্য প্যালেস্টাইনে বাস্তুচ্যুত আরবদের জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, নয়তো সেখান থেকেই পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। ইসরায়েলের হাতে বহু পারমাণবিক বোমা রয়েছে এ কথা বিলেতে পালিয়ে যাওয়া (পরে ইসরায়েল কর্তৃক কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা) ইহুদিবাদবিরোধী ইহুদি ধর্মাবলম্বী পারমাণবিক বিজ্ঞানী মরডেকাই ভানুনু প্রকাশ করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। অন্যদিকে ইরানও যে পারমাণবিক বোমা নির্মাণের কাছাকাছি রয়েছে সে কথাও আর গোপন নেই। পূর্ণাঙ্গ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েলকে সেসব ভূমি আরব দেশগুলোর কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে যেগুলো সে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় দখলে নিয়েছে। জেরুজালেমকেও দখলমুক্ত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিবর্গের কাছে এখনই সুযোগ ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে প্যালেস্টাইন সমস্যার স্থায়ী সমাধান বের করে আণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করার।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর