রবিবার, ১২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বেঁচে থাকা দায় হয়ে উঠেছে

জয়ন্ত রায়চৌধুরী

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বেঁচে থাকা দায় হয়ে উঠেছে

তেরঙা পতাকা আর কাস্তে-হাতুড়ি-তারা শোভিত লাল ঝান্ডার সমুদ্রের মাঝে পুরুষ ও মহিলাদের ভিড়, ঢাকের তালে তালে নাচছেন তাঁরা। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী নির্বাচনি প্রচারে বেরিয়েছেন বহরমপুর শহরের প্রধান বাজার, খাগড়া এলাকায়।

বহরমপুর বেশ ছড়ানো শহর। এই পুরনো শহরটা বেড়ে উঠেছে কাশিমবাজার, গোরা ও খাগড়া বাজারের মতো অতীতের জনবসতিগুলোকে নিয়ে। এ শহর অধীর চৌধুরীর খাসতালুক এবং পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অবশিষ্ট দুই দুর্গের মধ্যে একটি (আরেকটি দুর্গ দক্ষিণ মালদা)। অথচ ১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় নির্বাচিত ৩৪ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৪ জনই ছিলেন কংগ্রেস সংসদ সদস্য।

অধীরবাবু মানুষের হাত ধরছেন, হাসি বিনিময় করছেন, কোথাও দুটো কথা বলছেন, আবার কোথাও বা দাঁড়িয়ে পড়ে কোনো বয়স্ক মানুষের পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন-সবটাই করছেন হাসিখুশি মেজাজে। কিন্তু বাইরের এই নিরুদ্বেগ ভাবটা এ সত্য চাপা দিতে পারছে না যে, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস দল ও তার নেতারা যথেষ্টই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। এবারের নির্বাচনে প্রশ্ন শুধু অধীর চৌধুরীর নিজের লোকসভা আসন নিয়ে নয়, বাংলার মাটিতে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটির অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে।

লোকসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরী যে আসনটি থেকে জিতেছিলেন, তার মধ্যে পড়ে বহরমপুর শহর এবং তার লাগোয়া কয়েকটি ছোট শহর ও গ্রামীণ এলাকা। সেবার এ আসনে তিনি পেয়েছিলেন ৪৫.৫ শতাংশ ভোট। কিন্তু ভোটের এই হার ১০ বছর আগে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় ১১ শতাংশ কম, সে সময় মনমোহন সিংয়ের সরকার দ্বিতীয়বার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল।

এবারের ভোটে গোটা বহরমপুর শহরে আলোচনার কেন্দ্র নিঃসন্দেহে অধীর। আর বলা চলে যে, এবারের নির্বাচনি লড়াইটা তিনি লড়ছেন আক্ষরিক অর্থেই বহরমপুরের সীমানা ভাগীরথী নদীতে পিঠ ঠেকিয়ে।

কংগ্রেস নেতা অধীর এই আসন থেকে টানা পাঁচবার জিতেছেন। এবার তাঁর সামনে দুই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী-বিজেপির ডাক্তার নির্মল কুমার সাহা, এলাকায় জনপ্রিয় চিকিৎসক, বিনা পয়সায় বহু মানুষের চিকিৎসা করার জন্য বিশেষ সুনাম আছে; আর ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এই নির্বাচনি কেন্দ্রে তিনি ইতোমধ্যে তরুণ ভোটারদের মন জয় করেছেন।

এলাকায় অধীর চৌধুরীর ভাবমূর্তিটি ‘রবিনহুড’ মার্কা। তার সারকথা, তিনি নিজেই একটা সেনাবাহিনীর সমান। গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে তিনি সাহায্য করেছেন। সে সাহায্য আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে কারও বাবা-মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা, জমিসংক্রান্ত বিবাদ মেটানো, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি পাইয়ে দেওয়া, কিংবা কারও বিয়েতে পয়সা জোগানো। এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু মানুষ এখনো তাঁর নাম শুনলে কপালে হাত ঠেকিয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁর এই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বহরমপুর শহর এলাকায় নির্মল সাহা বয়স্ক ‘অধীরদা’কে রীতিমতো বেগ দিতে চলেছেন। এই এলাকার অর্থনীতির রাশ মূলত স্থানীয় ব্যবসায়ী আর ধনী জমির মালিকদের হাতে। এলাকার সোনা-ফলানো আমবাগান আর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কৃষিপণ্য আর ওষুধপত্রের বাণিজ্যিক লেনদেনের দখলও তাঁদেরই হাতে।

আর দেশের অন্যতম প্রাচীন পুরসভা বহরমপুরের চারপাশে যে গ্রামগুলো চোখে পড়ে, সেখানে প্রচারের আলো কেড়ে নিচ্ছেন ইউসুফ পাঠান। সপ্তাহখানেক আগে পাঠান গিয়েছিলেন বহরমপুরের কাছেই বেগুনবাড়ি গ্রামে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে জনতার ভিড় তাদের প্রিয় ক্রিকেটারকে চোখের দেখা দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল, তেমন ভিড় সম্ভবত দিল্লির কোনো নেতার বক্তব্য শোনার জন্য হবে না। সেদিন বাতাসের বুক চিরে শোনা যাচ্ছিল শুধু ‘ইউসুফ ভাই, ইউসুফ ভাই’ চিৎকার।

তবে পাঠানের এহেন জনপ্রিয়তার উৎস মূলত ক্রিকেটের ময়দানে তাঁর পরাক্রম। এই আদ্যন্ত বিরাদরি-ভিত্তিক গ্রামবাংলায় যেখানে নাকি সবাই সবার ঠাকুরদা ও ঠিকুজির খবর রাখে, সেখানে তিনি এখনো গুজরাট থেকে আগত এক বহিরাগত। তবে তা সত্ত্বেও মনে রাখতে হবে যে, এই আসনে তরুণ ভোটারদের সংখ্যা নেহাত কম নয় এবং তাই পাঠান নিঃসন্দেহে অধীরের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাবেন।

এবারের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা কংগ্রেস ও সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে আসন সমঝোতায় যাবে না। আর সে বিষয়ে অধীরবাবু নিজের ক্ষোভ আদপেই গোপন রাখেননি। মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগের দিনই তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, “নীতিশ কুমার যেমন ‘পালটু’ হয়ে উঠেছেন, ঠিক তেমনই মমতাও হয়ে উঠেছেন পালটি কুমারী।”

“বহরমপুর শহরে বিজেপি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেবে। তবে দাদা (অধীর চৌধুরী) ব্যক্তিগতভাবে এখনো যথেষ্ট জনপ্রিয়।

তিনি হয়তো জিতবেন, তবে ভোটের ফারাক কমবে,” বলছিলেন সৌমিত্র (বাবুন) সেন। এলাকার পুরনো জমিদার সেন পরিবারের সন্তান তিনি। খাগড়া বাজারের সিংহভাগ এখনো এই সেনদেরই হাতে, শহরের রাধাগোবিন্দ মন্দিরের ট্রাস্টিও তাঁরাই।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফের রায়ে মধ্যবঙ্গের দুই মুসলমান-প্রধান জেলা মালদা আর মুর্শিদাবাদের ঠাঁই হয়েছিল ভারতের মধ্যে যাতে হুগলি-ভাগীরথী নদীর উৎসমুখে ফারাক্কার জলভাগ এবং কলকাতার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের চা-বাগান ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগকারী জাতীয় সড়কটি সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের ভাগে পড়ে। এ বন্দোবস্তের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চল ও সুন্দরবন অঞ্চলের একাধিক জেলা।

স্বাধীনতার পর এই দুই জেলা রাতারাতি হয়ে উঠেছিল কংগ্রেসের নিজস্ব গড়। একসময় দুই জেলার মোট পাঁচটি লোকসভা আসনই ছিল শতাব্দী প্রাচীন দলটির দখলে।

কিন্তু শুধু এই দুই জেলাতেই নয়, গোটা রাজ্যেই সাম্প্রতিককালে কংগ্রেসকে ক্ষয়রোগে ধরেছে। অথচ এ রাজ্যেই কিন্তু কংগ্রেস নামক দলটির গোড়াপত্তন ঘটেছিল, যখন ১৮৮৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ আমলা ভারতপন্থি অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গ্র্যাজুয়েটের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন।

সে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ভারতবর্ষ ও ভারতীয়দের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা। আর এ ঘটনার সূত্র ধরেই ১৮৮৫ সালে বম্বে শহরে কংগ্রেস দলের প্রথম অধিবেশন বসে। এই রাজনৈতিক দলটি দেশকে উপহার দিয়েছে বাংলার সেরা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সুভাষচন্দ্র বসু ও ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের মতো নেতা।

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসে ধস নামার শুরু ষাট দশকের শেষাশেষি, তিনটি ঘটনার সূত্রে প্রদেশ কংগ্রেসে ভাঙন ও স্বল্পায়ু বাংলা কংগ্রেস গঠন, বাংলার চা ও চটশিল্পে মন্দা এবং কলকাতার যুবকমহলে মার্কসবাদের বিপুল জনপ্রিয়তা। লক্ষণীয় যে, এই তিনটি ঘটনা পরস্পরের সঙ্গে বিচিত্র যোগসূত্রে গাঁথা।

১৯৬২ সালে যেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেসের হাতে ছিল ২২ জন সংসদ সদস্য, সেখানে ১৯৬৭ সালে সংখ্যাটা মাত্র ১৪ জনে নেমে আসে এবং তারপর থেকে ক্রমাগত নামতেই থাকে।

শুধু ১৯৮৪ সালে নির্বাচনে এ রাজ্যে ক্ষণিক পুনরুজ্জীবনের মুখ দেখছিল দলটি। সেবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৬টি আসন। তারপর থেকে এ রাজ্যে কংগ্রেসের নির্বাচনি পরিসংখ্যান শুধুই নিম্নমুখী। ২০০৪ সালে দলটির হাতে ছিল ছয়জন সংসদ সদস্য, ২০০৯-এ তিনজন, আর ২০১৯-এ মাত্র দুজন।

“কংগ্রেস দলটা আসলে একটা বিরাট তাঁবুর মতো। এখানে সব ধরনের মতামতই আছে, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা, অর্থনৈতিক প্রগতি আর সমাজকল্যাণের মতো কিছু মূল বিষয়ে সব মতামত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আগেও আমরা দেখেছি যে, এ বিষয়গুলো যখন পেছনে চলে যায়, তখনই নির্বাচনে কংগ্রেসের সাফল্যেও ধস নামে,” বলছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার তিনটি নির্বাচনি কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম জঙ্গিপুরের প্রাক্তন সংসদ সদস্য অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। বলা বাহুল্য, একসময় এই তিনটি কেন্দ্রই ছিল কংগ্রেসের খাসতালুক।

আটষট্টি বছর বয়সে অধীর চৌধুরীর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই এ রাজ্যে তাঁর এবং কংগ্রেসের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে একটা বিরাট যুদ্ধ। সে যুদ্ধে কে জয়ী হবে, সে কথা সময় অবশ্যই আমাদের জানিয়ে দেবে।

লেখক : পিটিআই-এর পূর্ব ভারতের প্রাক্তন প্রধান

সর্বশেষ খবর