রবিবার, ১২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ : অযুত সম্ভাবনা

মাজহারুল ইসলাম

বাংলাদেশ : অযুত সম্ভাবনা

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, যে সময় বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল তখন তাদের বলা হতো, এই অংশটি ‘পাকিস্তানের ওপর একটি বোঝা’। কিন্তু ওই ‘বোঝাই’ এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্যাপক উন্নতি করেছে। ফলে এখন বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমি লজ্জিত হই। কারণ বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। গত ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় এমন কথা বলেছেন শাহবাজ শরিফ। এ সময় তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি খুবই তরুণ ছিলাম। আমাদের বলা হতো বাংলাদেশ আমাদের ওপর একটি বোঝা। আজ সবাই জানেন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সেই বোঝা কোথায় পৌঁছেছে। সেই বোঝাই এখন আমাদের লজ্জা দিচ্ছে।’ শাহবাজ শরিফের সঙ্গে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ব্যবসায়ী নেতারা এদিন সিন্ধু সিএম হাউসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তারা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গেও ব্যবসাবিষয়ক আলোচনা শুরুর তাগিদ দেন। প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য শাহবাজ শরিফের ওপর চাপ রয়েছে। এর আগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বড় ভাই নওয়াজ শরিফ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে বলেছেন এমন কথা।

বিশ্ববাসী আজ বাংলাদেশের অগ্রগতিতে অবাক। এক সময়কার কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমছে। বাড়ছে শিল্প খাতে। মাত্র তিন দশক আগেও যেখানে কৃষি ছিল কর্মসংস্থানের প্রধান ভরসা, সেখানে ২০২৩ সালে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ১০ শতাংশের মতো। ওই সময়ে শিল্প ও সেবা খাতে ১৭ শতাংশ কর্মসংস্থান বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যেসব কর্মী কৃষি ছাড়ছেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো তাদের অন্যান্য সেবায় নিয়োগ দিতে পারছে না। নারীদের কর্মক্ষেত্রে কম সুযোগ আরেকটি চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেরই চাকরি করা নারীর সংখ্যা বিশ্বে সর্বনিম্ন বা ৪০ শতাংশেরও নিচে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম হওয়ায় কৃষির বাইরে অন্য খাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে তৈরি পোশাক খাতে। ৪০ লাখের বেশি শ্রমিকের ৬৫ শতাংশই নারী। অথচ পাঁচ বছর আগেও পোশাক খাতের শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই ছিল নারী। শুধু তৈরি পোশাক শিল্পেই নয়, সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ বার্নাড হেভেনের অভিমত, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল হতে পারে। এতে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি কঠিন হবে। এসব কিছু বিবেচনা করে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও কর্মসংস্থান কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা হয়। যার আওতায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের অশুভ প্রভাবে কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ যে কমেছে তা একটি বাস্তবতা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ায় যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা উদ্বেগজনক। নারীর ক্ষমতায়নের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছিল তৈরি পোশাক খাত। এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ হ্রাস পাওয়ায় চিন্তার বিষয়। এসব সমস্যা ও সংকট উত্তরণে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। আশার কথা, আগামী বছর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করবে। একই সঙ্গে কমতে শুরু করবে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিশ্ব অর্থনীতিতেও অবদান বাড়বে বাংলাদেশের। ২০২৮ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১৯তম। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকের জন্য প্রস্তুতকৃত ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের এপ্রিল সংস্করণে বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলকের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক জিডিপির ০.৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা আগামী পাঁচ বছরে ০.১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হয়েছে। এর ফলে ২০২৮ সালে বিশ্ব জিডিপিতে বাংলাদেশ ১.০১ শতাংশ অবদান রাখবে। আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশের জিডিপি আগামী পাঁচ বছরে ২৪৫.৫২ বিলিয়ন ডলার বাড়বে। বাংলাদেশের এই গতিপথ অর্থনৈতিক আকারের দিক থেকে বাংলাদেশকে বিশ্বের মধ্যে ১৯তম অবস্থানে নিয়ে যাবে। আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ইরান, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, তাইওয়ান ও পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৮ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৬৯১.৮৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে, যা গত বছরের ৪৪৬.৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫৫ শতাংশ বাড়বে। মাথাপিছু জিডিপি ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি এবং ক্রয়ক্ষমতা সমতা ডলারের ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল্য ৫৪ শতাংশ বাড়বে। আইএমএফ বলেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু চলতি বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও আগামী বছর থেকে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। 

লেখক : প্রাবন্ধিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর