এ মুহূর্তে সারা বিশ্বে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে সমালোচিত রাষ্ট্র; কারণ তাদের সহায়তায় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যা চলমান। প্রতিদিন মারা পড়ছে হাজার হাজার নিরীহ শিশু, নারী, হাসপাতালের রোগী আর নিরীহ মানুষ। শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৪৩ দেশ ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়ার জন্য ভোট দিয়েছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। বিপক্ষে ছিল ইসরায়েল, আর্জেন্টিনা, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি আর প্রশাস্ত মহাসাগর অঞ্চলের পাঁচটি দ্বীপরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক নাৎসি যুদ্ধাপরাধী জার্মানি থেকে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নিয়েছিল। যাদের কয়েকজনকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ মার্কিন সহায়তায় ধরে এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। আজ যারা ফিলিস্তিন দখল করে সেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তারাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিয়ে এসে জাতিসংঘের সহায়তায় জোরপূর্বক ফিলিস্তিনে বসিয়ে খোদ আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করেছিল।
সারা বিশ্ব যেখানে ফিলিস্তিনে মার্কিন সহায়তায় চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঠিক তখন বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু কেন এসেছেন তা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইতোমধ্যে জানিয়েছে। ভারত শ্রীলঙ্কা সফর শেষ করে তিনি দুই দিনের সফরে গতকাল বাংলাদেশে এসে আজ ১৫ মে চলে যাওয়ার কথা। লু সাহেব যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন সহকারী পররাষ্ট্র সচিবের একজন এবং তার মর্যাদা বাংলাদেশের একজন সহকারী সচিবের ঊর্ধ্বে নয়। বিশ্বব্যাপী সংঘটিত আগের অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পারে, সব মার্কিন প্রশাসনে এমন কিছু ব্যক্তি থাকে যাদের অন্যতম পারদর্শিতা হচ্ছে অন্য দেশে তাদের অপছন্দের সরকারকে সরিয়ে নিজেদের পছন্দের সরকার প্রতিস্থাপন করা। তাদের সহায়তা করার জন্য দেশে দেশে তাদের অনেক বেতনভুক তাঁবেদার পুষে, আর পুষে কিছু শিক্ষিত নাগরিক যারা ‘সুশীল’ নামে পরিচিত। এমন সংগঠন বাংলাদেশে কম করে হলেও অর্ধ ডজন আছে আর ‘সুশীল’ আছে কয়েক ডজন। তাদের সহায়তা করার জন্য আরও থাকে কিছু মিডিয়া আর মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে ডোনাল্ড লু জড়িত ছিলেন তা তিনি প্রকাশ্যে একাধিকবার বলেছেন। যদিও লু তা অস্বীকার করেছেন। তবে যেহেতু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতীত তেমন একটা ভালো নয় সেই কারণে সেই দেশের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর কথা বিশ্ব সম্প্রদায় তেমন একটা বিশ্বাস করে না।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2024/05.%20May/15-05-2024/BD-Pratidin_2024-05-15-19.jpg)
এবার শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করে যাবে কই? তারা হয়তো ভুলে যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা যিনি এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একাত্তরে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন। কোনো কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছিল না ঠিক তখন লু সাহেবের বস মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাবের ছয় কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। তাদের অপরাধ তারা নাকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। যে দেশে বছরে গড়ে এক হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। গত মার্চ মাসে পুলিশ ঘরের ভিতর ঢুকে ১৭ বছরের এক বাংলাদেশি যুবককে হত্যা করল। যুবকটি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। বাড়িতে সে যখন অস্বাভাবিক আচরণ করছিল তখন তার মা ৯১১-এ খবর দেয় সাহায্যের জন্য। সেই খবর পেয়ে পুলিশ এসে যুবকটিকে গুলি করে সমস্যার সমাধান করে। বাংলাদেশে কিছুতেই শেখ হাসিনাকে বাগে আনতে না পেরে শুরু হলো তথাকথিত ভিসানীতি। ভদ্র ভাষায় ব্লিঙ্কেন সাহেব জানালেন তাদের কথা মতো নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ না হলে যারা দায়ী তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে ভিসা দেওয়া হবে না। না তাতেও কাজ হলো না। তারপর ঘোষণা করল কথা না শুনলে অর্থনৈতিক স্যাংশন দেবে। বিশ্বায়নের এই যুগে স্যাংশন তেমন কোনো কাজে আসে না তা তারা ভুলে গেছে। ইরান বা চীনকে কত স্যাংশন। তাতে হলো কী? বরং চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। নব্বই দশকে তারা এমন স্যাংশন দিয়ে ইরাকে কয়েক হাজার শিশুকে হত্যা করেছিল কারণ এই স্যাংশনের কারণে ইরাক বিশ্ববাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। সেটাও ছিল একটি গণহত্যা।
৭ জানুয়ারি বিএনপির বয়কটের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হয়ে গেল। কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিল। সেই নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ না নিলেও দলের ও তাদের জোটের অনেক হেভিওয়েট নেতা অংশ নিলেন। বিজয়ী প্রার্থীরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিলেন। সরকার গঠিত হলো। আর এসব অনুষ্ঠানে সবার আগে সামনের সারিতে সিট দখল করে বসে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। পিটার হাস তো নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের নির্বাচনে আনার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেলেন ক্লান্তি দূর করতে। তার কর্মকাণ্ডে এক সময় মনে হচ্ছিল তিনিই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে যাই করুক তাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করপোরেট স্বার্থ। সেই স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য তারা অন্য দেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। তাদের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারেন না একবিংশ শতকের বিশ্ব আর বিংশ শতকের বিশ্ব এক নয়। তখন বিশ্ব দুই পরাশক্তির বলয়ে অনেকটা বন্দি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে এখন একাধিক অর্থনৈতিক পরাশক্তির জন্ম হয়েছে। তারা ওই বলয় রাজনীতির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে অনেকটা সফল হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। জন্মের সময় বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সেটি সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারত তখনো একটি স্বল্পোন্নত দেশ। যুক্তরাষ্ট্র বা চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধিতাই করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে সব পরাশক্তি বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। এই উন্নয়ন সহযোগী হয়ে ওঠার পিছনে তাদের স্বার্থ বাংলাদেশের স্বার্থের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
বাংলাদেশে রাশিয়া বা চীনের যেমন বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে ঠিক এই স্বার্থ রয়েছে ভারত বা জাপানের। তবে সবচেয়ে বেশি বড় অনৈতিক স্বার্থ যুক্তরাষ্ট্রের। এই দেশে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের, বিশেষ করে জ্বালানি খাতে। তার ওপর আছে বাংলাদেশের কৌশলগত বা স্ট্র্যাটেজিক ভৌগোলিক অবস্থান। যে অবস্থান যেমন চীন বা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া শুধু অবস্থানগত কারণে সিঙ্গাপুর বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। লু সাহেব নিশ্চয় এই দেশে তাদের বেতনভুক তাঁবেদার নাগরিকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তারা গত নির্বাচন ভণ্ডুল করার পরিকল্পানা কেন বাস্তবায়ন করতে পারেনি তার জন্য কৈফিয়তও চাইতে পারেন। নতুন কিছু তাঁবেদার সৃষ্টি করার চেষ্টাও করতে পারেন। তবে তার অগ্রাধিকার থাকবে অর্থনৈতিক। তিনি বুঝে গিয়েছেন তাদের বাছাই করা তাঁবেদারদের দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সুতরাং শেখ হাসিনাই তাদের একমাত্র ভরসা। নির্বাচনের পরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন তাঁরা নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করে সম্পর্ক আরও মজবুত করতে চান। লু সাহেব রওনা দেওয়ার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়ে দিয়েছে, লু’র সফরের হেতু সম্পর্ক আরও মজবুত করা। আসল কথা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক স্বার্থ। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় বিশাল জলরাশির নিচে লুকিয়ে আছে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ। যার মধ্যে তেল আর গ্যাস অন্যতম। অনুমান করা হয় শুধু গ্যাস আছে দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এসব সম্পদ আহরণের জন্য ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে ৫৫টি বহুজাতিক কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে টেন্ডারে সাড়া দিতে। যারা টেন্ডারে অংশ নিয়েছে তার মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ তেল কোম্পানি এক্সন মোবিল, কনোকো ফিলিপ্স ও শেভরনও। শেখ হাসিনা ২০২৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশে ৫০ বছরের সম্পর্ক স্থাপনের স্মারক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান তখন এই তেল কোম্পানিগুলোর বড় বড় কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশ বিমান বহরে যুক্ত হবে কিছু নতুন বিমান। হতে পারে ফ্রান্সের এয়ারবাস বা যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত বোয়িং। সরকারের নীতিনির্ধারকরা ইতোমধ্যে এয়ারবাসের প্রতি ঝোঁক প্রকাশ করেছেন। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কপাল ভাঁজ পড়েছে। লু সাহেবের এই সফরে তিনি এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন নিশ্চয়। বাংলাদেশও কথা বলতে পারে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ক বাড়ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা হলেও অস্বস্তি বাড়ছে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে চায় না। তারা ইতোমধ্যে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের কিছু করার যে কোনো সক্ষমতা নেই তা বুঝে গেছে। আর কমাস পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই সময় এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু নয় মিত্র দরকার। কারণ ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দৃশমান। ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরের কারণে বিএনপি জোটের উৎফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের সমস্যা হচ্ছে তারা বাস্তবতা মেনে নিয়ে ঘুমের ঘোরে হাঁটতে বেশি পছন্দ করে। শীতের ওয়াজ গরমকালে করে মাঠ গরম করার বেহুদা শ্রম ব্যয় করে। আর ডোনাল্ড লু কোনো লু হাওয়া নিয়ে বাংলাদেশে আসেননি। সেই বিলাসিতা করার সময় এখন নয়।
কদিন আগে ভারতের নির্বাচনে মাঝপথে তাদের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা ঘুরে গেলেন। এরপর হয়তো আসবেন চীন রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। সবাই বুঝে গেছে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমন একটা কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই মুহূর্তে ভরসা শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের ওপর।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক