বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া কবিরা গুনাহ

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া কবিরা গুনাহ

মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমের সুরাতুল ফুরকানে একজন খাঁটি মুমিনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা কখনো মিথ্যা সাক্ষী দেয় না। আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেছেন, তোমরা মিথ্যা থেকে আত্মসংবরণ কর। সুরা হজ।

আমাদের প্রিয় নবী হজরত রসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দান শিরকের সমান। (আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনেমাজা, তাবারানি)

অপর হাদিসে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার জন্য জাহান্নামের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত নিজের পা নাড়াতেও পারবে না। (ইবনে মাজাহ)

মূলত কোরআন ও হাদিসের আলোকে মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা চারটি বড় গুনাহে লিপ্ত হয়ে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অপরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রথমত, দুনিয়ার লোভে পরে অপরের ক্ষতি করার জন্য মনগড়া মিথ্যা অপবাদ দেয়। দ্বিতীয়ত, সে অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে তার ওপর জুলুম করে। তৃতীয়ত, সে যার পক্ষে সাক্ষ্য দেয় তার ওপরেও জুলুম করে, কেননা সে তার জন্য হারাম সম্পদ ভোগে সহায়তা করে দেয়। ফলে তার জন্য জাহান্নাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। চতুর্থত, আল্লাহর বিধান সমাজের সুষ্ঠু সুবিচার থেকে মাজলুমকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এ মর্মে সহিহ বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজির বর্ণনায় রয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন আমি কি তোমাদের জঘন্যতম কবিরা গুনাহ কী কী বলব না? সাহাবাগণ আরজ করলেন ইয়া রসুলুল্লাহ অবশ্যই বলবেন। তিনি বললেন, তাহলে শোনো, তা হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, মাতা পিতাকে কষ্ট দেওয়া, আর সাবধান মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, সাবধান মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। হাদিসের বর্ণনাকারী বলেন, শেষের কথাটি তিনি এতবার পুনরাবৃত্তি করেন যে আমরা মনে মনে বলছিলাম যে, আহা, নবীজির কথা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সত্য সর্বদা মুক্তি দেয় এবং মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। প্রিয় নবী আরও ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- এক. যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে। দুই. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, খেয়ানত করে। তিন. যখন সে কোনো বিষয়ে ওয়াদা করে, সে তার খেলাফ করে। মিথ্যা একটি ভয়ংকর কবিরা গুনাহ। একটি কবিরা গুনাহ অসংখ্য কবিরা গুনাহকে আহ্বান করে। কেননা প্রবাদ আছে, একটি মিথ্যাকে ঢাকার জন্য ১০টি মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য হয়। তদুপরি সেই মিথ্যাবাদী ফেঁসে যায়। সত্য সর্বদায় আলোকময় ও মিথ্যা তিমিরাচ্ছন্ন অন্ধকার। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ কখনো ঠাট্টা করেও মিথ্যা কথা বলতেন না। জগৎ বিখ্যাত ওলিকুল শিরোমণি হজরত আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বাল্যকালে বাগদাদ সফরে ডাকাত দলের কবলে পড়েন। মায়ের নির্দেশ মতো মিথ্যা না বলে সত্য কথা বলেন এবং জামার আস্তিনের ভিতর থেকে স্বর্ণমুদ্রা ডাকাতদের বের করে দেন। ডাকাত দল তার সত্যবাদিতা দেখে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহতায়ালার কাছে তওবা করে। ডাকাতির মতো গর্হিত গোনার কাজ ছেড়ে দিয়ে সত্যের আলোয় আলোকিত হয়ে খাঁটি মুসলমান হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ। যে ব্যক্তি নিজের দোষ স্বীকার করে শাস্তি পাওয়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও সত্য প্রকাশ করে দেয়, আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তার প্রতি রহমত নাজিল হয় এবং মানুষের দিলে তার প্রতি সহানুভূতি ও মায়া মমতার উদ্রেক করে দেন, ফলে সে শাস্তি থেকে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে যায়। আর যে ব্যক্তি নিজের দোষকে গোপন করার লক্ষ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তার প্রতি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে গজব নাজিল হয়, আর মানুষের দিলে তার প্রতি ক্ষোভ ও কঠোরতার সৃষ্টি হয়, ফলে তার জন্য শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, যখন কোনো ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে বা মিথ্যা সাক্ষী দেয়, তখন তার মুখ থেকে এমন দুর্গন্ধ বের হয়, আল্লাহপাকের রহমতের ফেরেশতারা সেই দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে যায় এবং সেই মিথ্যাবাদীর ওপরে আল্লাহপাকের লানত ও গজব কামনা করতে থাকেন, ফলে সেই মিথ্যাবাদী দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। কেননা তার মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার কথা মানুষ অবগত হয়ে যায়, সামাজিকভাবে অপমান ও জিল্লতির জীবনযাপন করে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে অভাব-অনটন, ক্ষুধা, দারিদ্র্যতায় এক সময় মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহান তার বরবাদ হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে মিথ্যা বলা ও সাক্ষী দেওয়ার কবিরা গুনা থেকে হেফাজত করুন। খাঁটি ইমান ও আমল নিয়ে দুনিয়া থেকে মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করুন আমিন।

লেখক : ইমাম ও খতিব কাওলারবাজার জামে মসজিদ দক্ষিণখান ঢাকা

সর্বশেষ খবর