শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

নজিরবিহীন বেনজীর এবং আমাদের পুলিশ

আলম রায়হান

নজিরবিহীন বেনজীর এবং আমাদের পুলিশ

সবাই জানেন, বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের আইজি ছিলেন। গুণধর এই ব্যক্তির আগে আইজিপি পদে ছিলেন ২৮ জন। আর আইজিদের মধ্যে মহা-নজিরবিহীন অঘটন ঘটিয়েছেন বেনজীর আহমেদ। তাঁকে বলা হয়, ‘নজিরবিহীন বেনজীর!’ হাওয়া ভবনের মাঠে ক্রিকেট খেলার সময় অনেকটা চকিদারের ভূমিকা পালন করা প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে পুরো চাকরি জীবন তিনি নানান ধরনের নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। এ কারণে তিনি অঘটন ঘটন পটিয়সী হিসেবে বেশ খ্যাত। এমনকি অবসরে যাওয়ার পরও তার এই ধারায় তেমন ছেদ পড়েনি। সিঙ্গাপুরে শপিং মলে শার্টপ্যান্ট-টিশার্ট পরে শপিংসহ নানান বিষয়ের কারণে ফোকাসে ছিলেন বেনজীর আহমেদ। আর এ বিষয়টিকে তুঙ্গে তুলে দেয় তাঁর সম্পদের পাহাড় এবং দায়িত্বে থাকাকালে নানা অনিয়ম নিয়ে কালের কণ্ঠে অনুসন্ধানী রিপোর্ট। এ খবরে সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও শুরুর দিকে ওপর মহলে নড়াচড়ার আলামত তেমন দেখা যায়নি। ভাবখানা এই, ‘আরে দূর, পত্রিকা লিখেছে!’ গণমাধ্যম নিয়ে এই মানসিকতা বেশ জেঁকে বসেছে। তবে পরিস্থিতি এখানেই থেমে থাকেনি। বরং বেশ কিছুটা গতি পেয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। এ জন্য অবশ্য সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সুমনকে ১৮ এপ্রিল দুদকে দৌড়াতে হয়েছে। এর পরই যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙার মতো জেগেছে দুদক। ২২ এপ্রিল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানিয়েছেন, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা হবে। ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান দুদক সচিব। ১৮ এপ্রিলের উল্লিখিত দুই ঘটনা কাকতালীয়, নাকি এ দুয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে তা অবশ্য জানা যায়নি।

মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশ পুলিশের আইজি থাকাকালেই বেনজীর আহমেদ নানান দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্য আলোচিত ছিলেন। তবে তা ছিল আড়ালে-আবডালে, মৃদুলয়ে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রেসনোটের ভাষায় ‘মৃদু লাঠি চার্জের’ মতো। কিন্তু সাবেক হওয়ার পর বেনজীর আহমেদের বিষয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা মোটামুটি বোমশেল। তাঁর সম্পদের এত ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছে যা পড়তেই অনেক পাঠক ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু পদের ক্ষমতা অপব্যবহার করে অবৈধ অর্জনে নিশ্চয়ই বেনজীর আহমেদ ক্লান্ত হননি। যদিও ফেসবুক লাইভে এসে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পদের বিবরণ সঠিক নয় এবং তাঁর সম্পদের একটি বড় অংশ হচ্ছে পারিবারিক ব্যবসা থেকে অর্জিত। তা হচ্ছে কৃষি খাত, বিশেষ করে মৎস্য চাষ। কৃষি কাজে এত সম্পদ অর্জন করা গেলে আমাদের কৃষক কেন অভাবে থাকে, বাংলাদেশ কেন বিশ্বের এক নম্বর ধনী দেশ হয় না? বোঝাই যাচ্ছে, বেনজীর আহমেদ আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে আর একটি নজির সৃষ্টি করেছেন।

লাগাতরভাবে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী বেনজীর প্রসঙ্গ কোথায় গিয়ে থামবে তা এখনই বলা কঠিন। বিষয়টি মরুপথে নদীর গতি হারাবার মতো হতে পারে। অথবা হতে পারে দেশে দুর্নীতির ধারার মূল উৎপাটনের সূচনার নজির। এমনটি হলে সবার চক্ষু খুলে যাবে, অবসরে গেলেও রেহাই নেই! আর সম্ভবত কেবল অবসরে যাওয়ার পর ধরার ধারার সঙ্গে অন্য ধারাও বেশ জোরালোভাবে সংযোজিত হতে পারে। তা হচ্ছে, সরকারি পদে থাকাকালেই ধরার ধারাকে প্রধান এজেন্ডায় নিয়ে আসা এবং সামগ্রিক বাস্তবতায় এটি খুবই জরুরি। বলা বাহুল্য, এ ধারা জোরালোভাবে শুরু করা প্রয়োজন পুলিশ দিয়েই। কারণ, সরকারকে মানুষ বিবেচনা করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানদণ্ডে। এ ক্ষেত্রে প্রধান হচ্ছে পুলিশ। এই এলিট শ্রেণি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা কিন্তু দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রধানত দুই শ্রেণির কাছে মানুষ অসহায় অবস্থায় যায়। এক. ডাক্তার। দুই. পুলিশ। অথচ এই দুই শ্রেণিকে সব সরকারের আমলেই পিঠ চুলকানো কালচার চলে আসছে। আর পুলিশ রবীন্দ্রনাথের কবিতার তালগাছের অবস্থায় আছে। আবার এ কিন্তু এক ধরনের পরিস্থিতিগত উদ্ভূত বাস্তবতা।

আমাদের পুলিশের সৃষ্টি ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ রাজের নানান প্রয়োজনে, প্রধানত দমন পীড়নের জন্য। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, জন্মকালীন ধারা থেকে পুলিশ মুক্ত হতে পারেনি। বরং ক্রমে এই বাহিনীকে অতিব্যবহার বেড়েছে এবং তা প্রধানত হচ্ছে প্রতিপক্ষ দমনের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলে বলতে গেলে এক রকম বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। আর এই প্রবণতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকারই বেরিয়ে এসেছে অথবা চেষ্টা করেছে- এমনটা গঞ্জিকাসেবীর পক্ষেও কল্পনা করা কঠিন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য ’৭৫-এর থিঙ্ক ট্যাংকের প্রেসক্রিপসনে জামায়াত-বিএনপি সারা দেশে যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে তাতে পুলিশকে অধিকমাত্রায় মারমুখী করা ছাড়া রাষ্ট্রের হয়তো আর কোনো বিকল্প ছিল না। এমনটাই অনেকেই মনে করেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পুলিশের একটি অংশের মধ্যে জেঁকে বসেছে, ‘আই কী হনুরে!’ এটি কিন্তু কেবল ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আচরণেও বেশ স্পষ্ট। যা সংক্রমিত হয়েছে ওপর থেকে নিচে। একেবারে মাঠপর্যায়ে। এক সময় বলা হতো, ‘বুঝলা না পাবলিক, আনসার কী জিনিস।’ এখন পাবলিক বোঝে, পুলিশ কী জিনিস! ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একটি নাটকের নাম আছে, ‘চলিতেছে সার্কাস!’ অনেকেই বলেন, পুলিশের সেবার মান কমেছে, বেড়েছে হয়রানির মাত্রা। এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা যাক।

এক. সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী খোদ রাজধানীতে একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে। এরপর ঘটনাস্থলে তিন থানার পুলিশ এসে একে অন্যের এলাকা বলে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়া। পরে ‘উপরের সিদ্ধান্তে’ হাতির ঝিল থানা নিজের এলাকা বলে মেনে নেয়। দুই. ৪ এপ্রিল বরিশালের হিজলা উপজেলা মৎস্য অধিদফতরের ওপর হামলা চালিয়েছে স্থানীয় হরিনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। এ ঘটনার ১ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ভিডিও ফুটেজ দেখা গেছে, একটি মোটরসাইকেল থেকে নেমে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবদুর রহিম মৎস্য কর্মকর্তাকে শাসাচ্ছেন এবং তার দুই সহযোগী আভিযানিক দলের সদস্যদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং মারধর করে রাস্তার ওপর ফেলে দেন। তিন. বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র ইন্সপেক্টর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বাইপাস করে ২৫ মার্চ আদালতে প্রেরিত এক তদন্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘২,৬৬,০০০ টাকার মালামাল জোর করিয়া বাধা দেওয়া সত্ত্বেও চুরি করিয়া নিয়ে যায়।’ চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও আইনের দৃষ্টিতে কোনটাকে চুরি এবং কোনটা লুট-তা জানেন না। অথচ তিনি সমানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বলা হয়, তিনি মাদক চক্রের খুবই প্রিয়। ১৮ বছর ওসির দায়িত্বে থাকাকালে তিনি বিপুল ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন। বলা হয়, আনুপাতিক হিসেবে তার সম্পদ বেনজীরের চেয়েও বেশি হতে পারে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় দুটি প্রসিডিং চলছে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া এই পুলিশ ইন্সপেক্টর বছর দেড়েক পর অবসরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। আর অবসরে যাওয়া মানেই আইনের অনেক ধারা থেকে রেহাই পাওয়া। হয়তো বেনজীর আহমেদও অবসরে থাকার কারণে অনেক দায় থেকে রেহাই পাবেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, বেনজীরের মতো বিশাল এবং অনেক ক্ষুদ্র পুলিশ সদস্য সমানে যা ইচ্ছা তা করেন কীভাবে? এ প্রসঙ্গে কারও কারও মূল্যায়ন হচ্ছে, পুলিশ আসলে পুলিশের মধ্যে নেই। কিশোর যেমন কৈশোরের সীমারেখা লঙ্ঘন করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে যায়, তেমনই কিছু কিছু পুলিশ সদস্য ‘পুলিশ গ্যাং’ হয়ে গেছে বলে রটনা আছে। কিশোর গ্যাংয়ের যেমন বড় ভাই থাকে, তেমনই ‘পুলিশ গ্যাং’য়েরও থাকে মুরব্বি। পুলিশ প্রসঙ্গে এই অভিযোগের ভিত্তি কতটা জোরালো তা নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু একশ্রেণির পুলিশ যে নিজ বিভাগের চেইন অব কমান্ডের বাইরে অন্য কেবলা ম্যান্টেইন করেন তা তো বারবার প্রমাণিত হয়েছে, নানান ঘটনায়। এ ক্ষেত্রে তো ওসি প্রদীপ দানব সমান হয়ে গিয়েছিলেন। গুলিতে মেজর সিনহা মারা না গেলে কার সাধ্য ছিল ওসি প্রদীপের কেশাগ্র স্পর্শ করে! মাঠপর্যায়ে ওসি প্রদীপ একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। এ রকম দৃষ্টান্ত কেবল একটি বিরাজমান-তা মনে করার কোনো কারণ নেই। চেইন অব কমান্ডের বাইরে ওসি প্রদীপ ও বেনজীর আহমেদের অন্য কোনো প্রটেকশন না থাকলে এত অপকর্ম তারা কীভাবে করেছেন! আর অন্য কেউ যে ওসি প্রদীপ ও বেনজীরের পথে হাঁটেননি অথবা হাঁটছেন না- তা কি হলফ করে বলার উপায় আছে! ধারণা করা অমূলক নয়, প্রদীপ-বেনজীরের তরিকায় অনেকেই আছেন। অথবা আছেন কেউ কেউ। অবশ্য এ বিষয়ে সেই বাক্যটি প্রযোজ্য হতে পারে, ‘সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’

নিশ্চয়ই পুলিশের সবাইকে প্রদীপ এবং বেনজীরের কাতারে দাঁড় করানো যাবে না। হয়তো এদের সংখ্যা অগুনতিও নয়। কিন্তু যা আছে তাতেই কিন্তু পুরো কাঠামোতে কলঙ্কের দাগ লাগার জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া জন্মকালীন দোষের বোঝা তো আছেই। এ বিষয়ে চূড়ান্ত কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সরকারের ভাবা প্রয়োজন, অনেক হয়েছে! এখানেই ফুলস্টপ দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করা কেবল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। এ জন্য রাষ্ট্রের পরিবেশও এখন বেশ অনুকূলে। আর কারোই দ্বিমত নেই, অসাধ্য সাধনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অকল্পনীয় উন্নয়নের রূপকার এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে একাধিকবার প্রমাণ করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এখন পুলিশসহ অন্যান্য সরকারি লোকদেরও পুরোমাত্রায় শুদ্ধ ধারায় আনার কঠিন কাজটিও তাঁকেই করতে হবে। এটি সময়ের দাবি।          

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর