শিরোনাম
শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনা ফিরলেন, প্রাণ পেল বাংলাদেশ

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

শেখ হাসিনা ফিরলেন, প্রাণ পেল বাংলাদেশ

“অঝোর বৃষ্টিতে

খুলে গিয়েছিলো এই পথ- সেই পথে পথে কাঁকর বিছানো ফাঁদ; পথহারা ইতিহাসে

রক্ত নদীর স্রোতে পলিতে পলিতে

জেগে উঠেছিলো চর ভাঙনপ্রবণ গাঙে আশার আলোর রেখা-

গণতন্ত্রের বহ্নিশিখা...”

(১৭ মে ১৯৮১, তারিক সুজাত)

আকাশজুড়ে কালো মেঘ, প্রকৃতিতে ঝড়ো হাওয়া, অঝোর বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঝলকানি। মনে হয়, ১৯৮১-এর সেই বিকালটা কদিন আগেরই; যদিও ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে চার দশকের বেশি সময়। হ্যাঁ! আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বভূমে প্রত্যাবর্তনের ৪৪তম দিবস।

ব্রিটিশ লেখক সাইমন সিনেক লিখেছেন- “Leadership is not about the next election, itÕs about the next generation.” নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। সাইমনের এ বক্তব্যের ভাবগত মিল পাওয়া যায় ১৭ মে, ১৯৮১তে দেওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্যের সঙ্গে; তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতার জন্য আসিনি। এসেছি একটি হারানো স্বপ্ন উদ্ধার এবং একটি রক্তাক্ত আদর্শের পতাকা আবার তুলে ধরার জন্য।’ নির্বাচন, ক্ষমতা, রাজনীতি কিংবা প্রধানমন্ত্রিত্ব- কোনো কিছুই সেদিন তাঁর বক্তব্যে ঠাঁই পায়নি, পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশের কোটি কোটি বাঙালির ‘হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’ উদ্ধারের ভাবনা; যেটাকে তিনি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ আকাশের কান্নাভেজা দিনে বাংলায় পা রেখে সেদিন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন রাজনীতিবিদ নয়; সাড়ে ৮ কোটি বাঙালির আপনজন হিসেবে। তাঁর ভাষায়, “আমি নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। এসেছি আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে।”

আজ সেই ১৭ মে। এই মে আরও একটি প্রত্যাবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো- ৭ মে, ২০০৭। বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৭ মে যদি বাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে থাকেন, তবে ৭ মে ২০০৭-এ ফিরেছিলেন জনগণের সঙ্গে একসঙ্গে রাজপথে হেঁটে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের প্রত্যয় নিয়ে। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার খবর, নাটকীয়ভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রিটিশ সরকার তাঁর দেশে ফিরতে বাধা দিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক জারিকৃত নিষেধাজ্ঞার কারণে। দেশের মাটিতে শেখ হাসিনা যাতে না ফিরতে পারেন এজন্য বাংলাদেশ সরকার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজকে নিষেধ করে; যে কারণে বৈধ টিকিট থাকার পরও তাঁকে যাত্রী হিসেবে নেওয়া হয়নি। কারণ হিসেবে তাঁকে এয়ারলাইনস কর্মকর্তা বাংলাদেশ সরকারের চিঠি দেখান (২২ এপ্রিল ২০০৭)। এক দিন পর আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘ওরা আমাকে কিছুতেই আটকাতে পারবে না। দেশে ফিরবই। আমি জাতির পিতার কন্যা।’ লন্ডনভিত্তিক দ্য ট্রিবিউনকে বললেন, ‘আমি শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যাই নয়, তাদের কাছে একজন মা ও একজন মেয়ের মতো।’

এসব কারণেই বাঙালির জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ ও ১৭ মে। উদযাপনও করা হচ্ছে মহীরূপে, মহাসমারোহে। স্বীকার করতেই হবে, ’৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর যে অন্ধকার বা বন্ধ্যাযুগ শুরু হয়েছিল, কন্যা শেখ হাসিনার ফেরার মধ্য দিয়ে সেই অন্ধকারের পর্দা সরানোর কাজ শুরু হয়েছিল ১৭ মে। এটি নিছক কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস নয়; গণতন্ত্র পুনর্জাগরণের দিন ছিল ১৭ মে, ছিল বাংলাদেশের আপন কক্ষপথে ফেরার দিন, সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পুনরায় বাংলাদেশ হয়ে ওঠার দিন। আপনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে পছন্দ করুন বা না করুন; একটি দিকশূন্য টলায়মান জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে ওই সময় তাঁর প্রত্যাবর্তন যে কতটা জরুরি ছিল তা চলমান পরিস্থিতি সামনে রাখলেই অনুভব করতে পারবেন। আরও অনুভব করা যাবে গত ১৫ বছর ধরে চলমান বাংলাদেশের আকাশছোঁয়া উন্নয়ন দেখলেও। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে অকুতোভয় নেতার অভাব হয়তো কখনো ছিল না; কিন্তু জাতির ক্রান্তিলগ্নে, স্বাধীনতা-উত্তর ও বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশে আলোকবর্তিকা হয়ে ধীমান নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একজন মানুষই সাহস দেখিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সুতরাং তাঁর প্রত্যাবর্তন অতীতের সংকটকালীন বাংলাদেশের জন্য জরুরি ছিল, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যও জরুরি থাকবে।

কী হতো যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে না ফিরতেন? এর উত্তর আমাদের সবার জানা। নিশ্চয়ই এমন হবে, ‘বাঙালির স্বপ্নভঙ্গ হতো’, ‘বাঙালি জীবনে দ্বিতীয় রেনেসাঁ আসত না’, বাংলাদেশের ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ হওয়া’ হয়ে উঠত না, কিংবা বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। তবে পাশাপাশি যে জিনিসটা বেশি জানা ও বলা জরুরি, তা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশে ফেরায় কী পরিবর্তন হয়েছে? কী ছিল আর কী হয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক রূপরেখা। বিশ্ব আজ বাংলাদেশকে কীভাবে চেনে? বদলে যাওয়া সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য চাকাইবা এখন দেখতে কেমন? আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।

দুই

তেতাল্লিশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম-সাধনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কখনো রাজনৈতিক আন্দোলন, কখনোবা জনমত গড়ার লড়াই; প্রধানমন্ত্রী হয়ে কিংবা বিরোধীদলীয় নেত্রী- মাথায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সব সময় লড়েছেন মানুষের ভাগ্য বদলানোর বাসনা নিয়ে। অবস্থাটা এমন যে, বাঙালি আর তাঁকে নিজের দেওয়া একমাত্র গর্ববোধের পরিচয় শুধু ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা’ বলতে রাজি নন; বরং নিজের পরিচয়ে, নিজের কর্মের কারণে জাতির ‘শেষ ভরসাস্থল’, ‘মুক্তিপথের দিশারি’ বলতেও ব্যাকুল। কাণ্ডারিবিহীন ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খাওয়া জাতির জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফেরা যে মানুষটির প্রথম সফলতা ছিল- দেশকে স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি দেওয়া। ১৯৮১-এর ১৭ মে থেকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তাঁর আগমন-পরবর্তী বাঙালির বড় পাওয়া হলো- তারা স্বপ্ন দেখতে পেরেছিল। যদিও এজন্যও দেশে ফেরার কদিন পরেই (৩০ মে) জেনারেল জিয়ার মৃত্যু, আরেকটি সামরিক শাসনের সূত্রপাত হিসেবে তথাকথিত ১৫ নভেম্বর, ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য মঞ্চস্থ নাটকের সম্মুখীন এবং তাতে দলের অংশগ্রহণসহ নানা কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা, উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করে কাজ করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারির দুই দিন পর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভার স্মৃতিসৌধে একা গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানব না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবই করব।’ বোধ করি শেখ হাসিনার এ অভয়মন্ত্রের দীক্ষা নিয়েই আপামর জনগণ স্বৈররাহু থেকে দেশকে মুক্ত করেছিল।

১৯৯৬তে ক্ষমতা গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সব সৈনিককে প্রথমবারের মতো এক পতাকাতলে নিয়ে এসে ‘ঐক্যের প্রতীক’ বনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উজ্জ্বল সেই শাসনামলে (১৯৯৬-২০০০) মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা শুরু হয়েছিল ২১ বছর পর। মুক্তি ও স্বাধীনতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল মানুষের সুপ্ত সব সম্ভাবনা। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা পায় এবং নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে আসে জনগণের। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, বঙ্গবন্ধুকে স্বমহিমায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আসীন, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্সা আদায়, বিনা জামানতে ভূমিহীন কৃষক ও বর্গাচাষিসহ কৃষকদের পর্যাপ্ত ঋণ সহায়তা, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে চলমান রক্তপাত বন্ধের উদ্যোগ, ৬৫ হাজার চাকমা শরণার্থীর পুনর্বাসন, চার স্তরবিশিষ্ট শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে আইন প্রণয়ন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, প্রশাসনের দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিশন গঠন, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রগতিশীল নারী উন্নয়ন নীতিমালা, পিতার নামের সঙ্গে মায়ের নাম উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, স্থানীয় সরকারের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন প্রথা চালু, হাই কোর্টের বিচারপতি এবং সচিব, যুগ্ম সচিব, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারসহ সরকারি উচ্চ পদে মহিলাদের নিয়োগ, সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীতে মেয়েদের নিয়োগ, নারী শিক্ষার প্রসার, প্রতিরক্ষা বাহিনীর যুদ্ধোপকরণ ও সাজ-সরঞ্জাম বৃদ্ধির মাধ্যমে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন এবং ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ সমস্ত বাংলাভাষীর প্রাণের চাওয়া বাংলাকে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ স্বীকৃতি আদায় করে আনা- এগুলোর সবই হয়েছে মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলে।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করার বিরল গৌরব অর্জন করে এই আমলে, ১৯৯৮ সালে। গঠিত হয় এশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর পিস। উদ্যোগী হয় বিমসটেক ও ডি-৮ গ্রুপ গঠনের। আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে উন্মোচিত হয় সহযোগিতার নতুন সব দ্বার। দেশে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সাক্ষরতার হার উন্নীত হয় ৪৪ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের গড় আয়ু ৫৮.৭ থেকে বেড়ে ৬৩ বছর হয় ২০০০ সালে। বয়স্ক ভাতা, দুস্থ মহিলা ভাতা, আশ্রয়ণ, গৃহায়ণ, আবাসন, ঘরে ফেরা কর্মসূচি, একটি বাড়ি একটি খামার, কর্মসংস্থান ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ, আদর্শ গ্রাম কর্মসূচি প্রভৃতি ছাড়াও দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ব্যাপকহারে ভিজিএফ কার্ড, কাজের বিনিময়ে কর্মসূচি, জিআর, টিআর প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ফলে মানব দারিদ্র্য সূচক ৪২ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশে নেমে আসে। পক্ষান্তরে মানব উন্নয়ন সূচক ৪২.৬ শতাংশ থেকে ৪৮.৫ শতাংশে উন্নীত হয়। পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১ হাজার ৬০০ থেকে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে রূপ নেয়; যা ছিল সে সময়কার বিস্ময়কর সাফল্য। যোগাযোগ ক্ষেত্রেও অর্জিত হয় বিপুল সাফল্য। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন সংযোগ বসে; পদ্মা (পাকশী), মেঘনা (ভৈরব), রূপসা (খুলনা)-সহ দেশের বড় বড় নদীতে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৫,১২৮ কিলোমিটার নতুন পাকা সড়ক, ৩৬ হাজার কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা এবং ১৯ হাজার ছোট-বড় ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে সাফল্যের অংশ হিসেবে লাখ টাকার মোবাইল ৫-৭ হাজারে নেমে আসে এবং মোবাইল ফোনের সংখ্যা ২ হাজার থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ৭ লাখে উন্নীত হয়; ল্যান্ডফোনের সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৯২০টিতে। আইটি সেক্টরের অপরিসীম গুরুত্ব ও সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে কম্পিউটার ও সফটওয়্যার আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করা হয় এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে বিশেষ তহবিল বরাদ্দ হয়। সরকারি দফতরের কর্মকাণ্ডকে কম্পিউটারাইজড করার প্রকল্প নেন। ছোট-বড় ১ লক্ষাধিক নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়। ক্রীড়া ক্ষেত্রেও অর্জিত হয় অসামান্য সাফল্য। টেস্ট মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আমাদের বুঝতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন বাংলাদেশকে কী বাংলাদেশ বানিয়েছেন? যে বাংলাদেশে নব্বই-বিরানব্বই-চুরানব্বই সালেও হাজার হাজার মানুষের জন্য একজন সাধারণ ডাক্তার মিলত না। ভাত তো দূরের কথা, অনেক এলাকায় ভাতের মাড় পাওয়ায় ছিল যেন বিলাসিতা! এ প্রসঙ্গে একটা উদ্ধৃত টানা যাক। ১৯৯৪ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নবাসীর জীবনদুর্দশা নিয়ে ‘লক্ষ্মীটারী’ নামেই বই লিখেছিলেন সাংবাদিক-লেখক মোনাজাতউদ্দিন। সেখানেই উল্লেখ, লক্ষ্মীটারীর মানুষ, হিন্দু কি মুসলমান, ভাতকে বলত মা-লক্ষ্মী। আঞ্চলিক ভাষায় যার উচ্চারণ ‘মাঁও নক্কি’। থালা থেকে দুয়েকটা উপচে মাটিতে পড়লে তৎক্ষণাৎ খুঁটে তুলে খাওয়াই ছিল সেখানকার রীতি। কয়েক দানা ভাত থালায় রেখে আসন ছেড়ে ওঠা তো দারুণ এক অন্যায়। যদিও এত কিছুর পরেও লক্ষ্মী থাকত তাদের থেকে অনেক দূরে!

১৯৯৪তে লক্ষ্মীটারীতে হাতেগোনা সাধ্যবান কয়েকটি পরিবার ছাড়া ঘরে ঘরে ভাতের টান। আকালের দিনগুলোতে এমনও হয় যে, মজুর পরিবারের সদস্যরা ১০-১২ দিন অন্তর একবেলা দেখে ভাতের মুখ। এদেরই একজন মোনা মিয়া। কৃষিকাজ করত। পরে জমি বেচে নিজের জমিতেই মজুর হয়েছিল। তাকে উদ্ধৃত করেই মোনাজাতউদ্দিন লিখেছিলেন- “আটাশির মঙ্গায় তারা সপরিবারে গাছআলু সেদ্ধ খেয়েছিল একটানা চারবেলা। তারপর একবেলা দু’মুঠো ভাত মিলেছিল। আবারো গাছআলু সেদ্ধ। সেসময় মোনা মিয়ার দুটি মেয়েই ডায়রিয়ায় মারা যায়। মৃত্যুর আগে তার মেয়ে দুটি, টেপি আর বুড়ি স্যালাইন নয়, একটুখানি ভাত খেতে চেয়েছিল। ঘোরের ভেতর ‘ভাত ভাত’ বলে কোঁকাচ্ছিল বড় মেয়েটি। সে সময় আশপাশের সবগুলো বাড়িতে জানান দিয়েছে মোনা মিয়া, কয়েক মুঠো ভাত যদি মেলে। পায়নি। দশ-দশটি বাড়িতে ছোটাছুটির পর মিলেছিল পোয়াখানেক খুদ, তা-ও খুব পুরনো, দুর্গন্ধযুক্ত।... না, অনাহারে নয়, আহার করেই মারা গিয়েছিল কিশোরী টেপি আর বুড়ি। কিন্তু ভাত তারা পায়নি, পায়নি স্যালাইন ওষুধ। নষ্ট হয়ে যাওয়া খুদ তাদের অপুষ্টি-আক্রান্ত পেটে সয়নি।” আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সয়নি মানুষের এমন অসহায়ত্ব। যে কারণে বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেই মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ৪০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে দেশকে প্রথমবারের মতো খাদ্যে আত্মনির্ভরশীল এবং উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশে পরিণত করেন। যে বিরল সাফল্যের জন্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থা FAO তাকে সেরেস পদকে ভূষিত করে। ক্ষমতার মাত্র পাঁচ বছরে দারিদ্র্য বিমোচন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কর্মসূচি গ্রহণ করে পল্লীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে আমূল পরিবর্তনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আজও সেই শাসনকাল বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-অর্থনীতিবিদদের কাছে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের শ্রেষ্ঠকাল হিসেবে স্বীকৃত।

১৯৮১ সালে দেশে এসে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি, শোষণের মুক্তি। ...আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁর কথা রেখেছেন, বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথম মেয়াদের (১৯৯৬-২০০০) উপরোক্ত উন্নয়নচিত্র এটাই বলে দিচ্ছে, তাঁর সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালির অবর্ণনীয় আর্তনাদ ও নীরব অশ্রু মুছে দিতে কতটা অপরিহার্য ছিল।

তিন

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের শিখরে উড্ডীন। পৃথিবীর কাছেও অনন্য এক উদাহরণ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের মতো বড় বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন গোটা বিশ্বে আমাদের ভিন্ন ও স্বতন্ত্র পরিচয় এনে দিয়েছে; আর উপমহাদেশে বানিয়েছে ‘এশিয়ার টাইগার’। ‘নাম্বার ওয়ান উন্নয়নমুখী দেশ’ বলেছেন বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে গড় নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই রূপকল্প-২০২১ সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। চলছে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে কাজ; যার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) সাফল্যের পর ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে দেশ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগ বিকাশ ও পরিবেশ সুরক্ষা এবং মহানগর উন্নয়নে বিশেষ করে যানজট নিরসনে রেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আজ অনন্য উন্নয়নের নিদর্শন।

তবে যে বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না তা হলো- এমন অসংখ্য-অগণিত উন্নয়নের মাঝে গোটা একটি জাতির জীবনই যে বদলে গেল, তারও মূল্যায়ন করতে হবে। শুধু দৃশ্যমান কিংবা বস্তুগত উন্নয়ন নয়, জীবনমানের উন্নয়ন বিষয়টাও আলোচনার বিষয়ে পরিণত করতে হবে। নিজেকে, নিজ পরিবারকে এমনকি নিজের সামাজিক অবস্থানকে ১৫ বছর আগে এবং বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করলেই অনেক কিছু দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার কখনো সামষ্টিক উন্নয়নে সীমাবদ্ধ ছিল না, ব্যক্তিগতভাবেও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করে এসেছে সব সময়; এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তত্ত্ব। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে ঘোষণা ২০০৮ সালে দেওয়া হয়েছিল তা ২০২১ সালে সফল কার্যকারিতার পর এখন চলছে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ। ২০৪১ সালকে টার্গেট ধরে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি মূল ভিত্তিও নির্ধারণ করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এগুলো হলো- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। এর মধ্যে স্মার্ট সিটিজেনের মূল সারমর্ম হলো- দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবেন এবং তাদের জন্য একটি ইউনিক ডিজিটাল আইডি থাকবে। যা দিয়ে তারা যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো সময়ে সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, স্মার্ট ইকোনমি তৈরির জন্য অর্থনীতির সব কার্যক্রম হবে প্রযুক্তিনির্ভর। পাশাপাশি কমপক্ষে ৬০% অর্থনৈতিক সাক্ষরতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি ক্যাশলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেই সঙ্গে ২০৪১ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১ লাখ স্টার্টআপ তৈরির মাধ্যমে একটি স্মার্ট ইনোভেশন ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা হবে। পরিকল্পনায় রয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলারের আইসিটি শিল্প এবং একটি শক্তিশালী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ারও। তৃতীয়ত, স্মার্ট গভর্নমেন্টের মাধ্যমে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সব সরকারি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা হবে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কৃষি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, জননিরাপত্তার মতো প্রশাসনব্যবস্থাও হবে প্রযুক্তিনির্ভর। শতভাগ সরকারি কার্য সম্পাদিত হবে কাগজবিহীনভাবে। সব শেষে গড়ে তোলা হবে একটি স্মার্ট সোসাইটি। যেখানে সবার জন্য উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনমান নিশ্চিত করা হবে। গড়ে তোলা হবে একটি টেকসই ও স্মার্ট পরিবেশ। সোলার এনার্জি, গ্রিন এনার্জির মতো উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্লিন ও পরিবেশবান্ধব নিউক্লিয়ার এনার্জির ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। প্রযুক্তিগত শিল্প ও অবকাঠামোগত বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সারা দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার, প্রতিটি বৃহত্তর জেলায় কমপক্ষে একটি করে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও বিভাগীয় জেলাগুলোতে কমপক্ষে একটি করে হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এসব স্থাপনার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে ডিজিটাল ভিলেজ হাব ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে কমপক্ষে একটি করে শেয়ারেবল ওয়্যারহাউস সৃষ্টি করা হবে। এভাবেই ২০৪১ সালের আগে গড়ে উঠবে উন্নত-সমৃদ্ধ-অত্যাধুনিক বাংলাদেশ।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের পর অনেক সরকার এসেছে ও গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী কখনো ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। শাসকরা ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছেন প্রথমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এবং দেশের জনগণকে ক্ষমতার দুর্গ থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার কাজে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেশে ফেরা ও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর মানুষ সেই স্বাদ পেয়েছে। যার প্রথম শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচন এবং তাতে শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতৃত্বে জনগণের বলিষ্ঠ জয়ের মধ্য দিয়ে।

শেষ করব, তার আগে আরেকবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করতে চাই। ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ে তিনি লিখেছেন- ‘আমার দুর্ভাগ্য, সব হারিয়ে আমি বাংলাদেশে ফিরেছিলাম। লক্ষ মানুষের স্নেহ-আশীর্বাদে আমি সিক্ত হই প্রতিনিয়ত। কিন্তু যাঁদের রেখে গিয়েছিলাম দেশ ছাড়ার সময়, আমার সেই অতি পরিচিত মুখগুলি আর দেখতে পাই না। হারানোর এক অসহ্য বেদনার ভার নিয়ে আমাকে দেশে ফিরতে হয়েছিল।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আর আজ একা নন, ছয় বছরের নির্বাসন-জীবন শেষে গত ৪৪ বছর ধরে আপনি যেভাবে দায়িত্বে-কর্মে, সুখে-দুঃখে, স্নেহে-মমতায়, শাসনে-সোহাগে-সেবায়-যত্নে একটি জাতিকে আগলে রেখেছেন, রাখছেন; তাতে আপনিই এই জাতির সর্বমঙ্গলা। চির জাগরূক থাকুক আপনার প্রবল ইচ্ছাশক্তি, উদার মানবিক মূল্যবোধ, স্বদেশানুরাগ ও বিশ্বজনীনতা। সুস্থতা কামনা করছি।

লেখক : রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর