শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি

ইমদাদুল হক মিলন

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি

আমার অবস্থা সেই ছোট্ট ছেলেটির মতো। তার নাম নিক। ডাক্তার বাবার সঙ্গে ইন্ডিয়ান ক্যাম্পে যাচ্ছে। সেখানে এক তরুণী দুদিন ধরে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হ্রদের উপকূলে ছিপনৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছে দুজন ইন্ডিয়ান। নিকের কাকা জর্জও যাচ্ছে অন্য একটি নৌকোয়। প্রয়োজনে ডাক্তার ভাইটিকে সাহায্য করবে সে।

আমরা যাচ্ছি, বীণা খালার বিশাল পাজেরো জিপ নিয়ে। ২০০২ সালের কথা। বীণা আমার খালা। যতটা না খালা তার চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু। আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি, এক ক্লাসে পড়েছি। তারপর দুজন ছিটকে গেছি দুই ভুবনে। বীণা খালা ফ্লোরিডায়, আমি ঢাকায়। ওয়েস্ট পামবিচের মনোরম লেকের ধারে বীণা খালার ছবির মতো বাড়ি। আমি নিউইয়র্ক লস অ্যাঞ্জেলেস ডালাস আটলান্টা যাই আসি, ফ্লোরিডায় যাওয়া হয় না। বীণা খালা খুবই মন খারাপ করেন। সে অতি মায়াবী মানুষ। কবিতা লেখে, রবীন্দ্রনাথের গান করে। কবিতার বই বেরিয়েছে, কায়সার হক, ফখরুল আলম, এসব জাঁদরেল অনুবাদক তাঁর কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি অনুবাদেও তাঁর বই বেরিয়েছে। ডালাসে গেছি, আমাকে বললেন, আয় আমার এখানে। তোকে হেমিংওয়ের বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাব।

হেমিংওয়ে আমার স্বপ্নের লেখক। তাঁর বাড়ি দেখব? তিনি যে বাড়ির মাটিতে হেঁটেছেন, যে ঘরে ঘুমিয়েছেন, যে ঘরে বসে লিখেছেন সেই বাড়ি দেখব? যে শহরের রাস্তা দিয়ে তিনি হেঁটে গেছেন, যে শহরের ক্যাফেতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখেছেন, সেই শহরে যাব? কিছু না ভেবে ডালাস থেকে ফোর্ট লটারডেল এয়ারপোর্টে গিয়ে নামলাম। বীণা খালা তার বর মিন্টু চৌধুরী আমাকে রিসিভ করল। দুদিন পরের এক আলোকিত দিনে, সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরোলাম আমরা। গাড়িতে ছজন মানুষ। বীণা খালা, মিন্টু চৌধুরী। তাদের দুই পুত্র শান্তনু, অনিন্দ্য। অনিন্দ্যর বন্ধু সবুজও আমাদের সঙ্গী হয়েছে। ড্রাইভ করছে শান্তনু।

গাড়ি চলছে। কার কী মনের অবস্থা জানি না, আমার মন চলে গেছে হেমিংওয়ের লেখার জগতে। বারবার মনে পড়ছে ‘ইন্ডিয়ান ক্যাম্প’ গল্পটির কথা। দুদিন ধরে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ইন্ডিয়ান তরুণী। নিচের বাংকে শুয়ে আছে সে, স্বামী শুয়ে আছে ওপরের বাংকে। তিন দিন আগে কুড়োল চালাতে গিয়ে সে তার পা কেটে ফেলেছে। কাটা পা নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে ধূমপান করছে বাংকে শুয়ে। ডাক্তার বাবা অপারেশনের আয়োজন করছেন। তাঁকে সাহায্য করছে জর্জ আর অন্য ইন্ডিয়ানরা। নিক দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সে একটি মানবশিশুর জš§ দেখবে। কাজটা ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। কাটাছেঁড়া সেলাই ইত্যাদি চলল। ওপরের বাংকে তরুণীটির স্বামীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। তার আগে মানবশিশু কীভাবে জন্মায়, জন্মের সময় মাথা কোন দিকে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি নিককে বাবা বুঝিয়েছেন। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে শিশু না জন্মালে অপারেশনের দরকার হয়, বলেছেন। শিশুটিকে জগতের আলোয় আনার পর ডাক্তার উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বললেন, এবার গর্বিত পিতাটির একটু খবর নিতে হয়। ওপরের বাংকে সে কি ঘুমিয়ে পড়ল? ওপরের বাংকে শোয়া স্বামীটির কম্বল ধরে টান দিলেন। তাঁর হাত ভিজে গেল রক্তে। দেখা গেল স্বামী লোকটি ক্ষুর দিয়ে নিজের মাথাটা ধর থেকে আলাদা করে ফেলেছে কোন ফাঁকে। কী ভয়ংকর গল্প! নিক জানতে চাইল, বাবা, ‘ওই ভদ্রলোক নিজেকে কেন ওভাবে হত্যা করলেন?’ ‘আমি বলতে পারব না নিক। তবে আমার মনে হয় ভদ্রলোক বোধ হয় নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলেন না।’ ‘মৃত্যু কি খুব কঠিন, বাবা?’

‘না, আমার মনে হয় খুব সহজ এবং সুন্দর নিক। তবে এ সমস্তই নির্ভর করে তুমি কীভাবে গ্রহণ করবে।’ ফেরার সময় নৌকোয় বাবার সঙ্গে বসে হ্রদের জলে হাত ভিজাতে ভিজাতে নিক নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবল, ও কোনো দিনই মারা যাবে না। জীবন-মৃত্যুর এরকম অনুভূতির গল্প পৃথিবীতে কমই লেখা হয়েছে। ওই যে ডাক্তার বাবা বলেছিলেন, মৃত্যু খুব সহজ এবং সুন্দর, ব্যাপারটা নির্ভর করে কে কীভাবে তা গ্রহণ করছে। হেমিংওয়ের ডাক্তার বাবা ক্ল্যারেন্স হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। হেমিংওয়ে নিজে আত্মহত্যা করেন, তাঁর ভাই ও বোন আত্মহত্যা করেন। হেমিংওয়ের নাতনি অভিনেত্রী ও মডেল মার্গো হেমিংওয়েও আত্মহত্যা করেন। তাঁদের পরিবারই ছিল আত্মহত্যাপ্রবণ, মৃত্যুকে চূড়ান্তভাবে উপলব্ধি করা পরিবার।

ফ্লোরিডা থেকে ঘণ্টা চারেক ড্রাইভ করে ‘কী ওয়েস্ট’ নামের সমুদ্রঘেরা শহরে হেমিংওয়ের বাড়ি। কী ওয়েস্ট হচ্ছে পশ্চিমে আমেরিকার শেষ সীমান্ত। এজন্যই শহরটির নাম ‘পশ্চিমের চাবি’ কি না কে জানে। ‘কী ওয়েস্ট’ যাওয়ার রাস্তাটি অসাধারণ। কোথাও বনভূমি কিংবা লেক, কোথাও সমুদ্র। সাত মাইল লম্বা একটা ব্রিজ আছে। সেভেন মাইলস ব্রিজ। সেই ব্রিজের এক পাশে আটলান্টিক আরেক পাশে গালফ অব মেক্সিকো। ‘কী ওয়েস্টে’ ঢুকে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। এই সেই মহান লেখকের শহর? আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ওই যে সামনের সমুদ্র, ওই সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া এক বৃদ্ধকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন তাঁর পৃথিবী কাঁপানো উপন্যাস ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’। ‘কী ওয়েস্টের’ পাশে আটলান্টিক। আটলান্টিকের নব্বই মাইল ওপারে কিউবা। এই সমুদ্রে হেমিংওয়ে মাছ ধরেছেন, সাঁতার কেটেছেন। এই শহরের ক্যাফেতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যাফেতে বসেও লিখেছেন। সেই ক্যাফে এখনো আছে। হেমিংওয়ের বাড়িতে ঢোকার আগেই আমি মোটামুটি অভিভূত। তখনো জানি না সেই মহান লেখকের বাড়িতে কোন বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বাড়ি থেকে কয়েক পা ফেললেই আটলান্টিক। গভীর আনন্দে মাছ ধরতে পারবেন, শুধু এ কারণেই ‘কী ওয়েস্টের’ বাড়িতে এসে উঠেছিলেন তিনি। এই মাছ ধরার অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছিল তাঁর চিরকালীন লেখা ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’। কিউবার গালফ স্ট্রিমের বিরাট মার্লিন শিকারের কল্পনা জাগিয়ে দিয়েছিল কী ওয়েস্টের সমুদ্রে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা। হেমিংওয়ের মাছ ধরার নৌকোটির নাম ছিল ‘পিলার’।

১৯৩৭ সালে ‘কী ওয়েস্টের’ পটভূমিতে তিনি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন ‘টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট’। ২১ জুলাই ১৮৯৯ ইলিনয়ের ওকপার্কে জন্মেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ১৯২১ সালের ৯ মার্চ হাডলির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জ্যাক নামে তাঁদের এক পুত্রসন্তান জন্মায়। এই জ্যাকের কন্যা হচ্ছেন মডেল অভিনেত্রী মার্গো হেমিংওয়ে, পরবর্তী জীবনে যিনি আত্মহত্যা করেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে বসবাস শুরু করেন হেমিংওয়ে। এখানে তাঁর পরিচয় হয় পাউলিন পেফিফার সঙ্গে। এই ভদ্রমহিলা হেমিংওয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্যারিসে বসবাসের সময় সেখানকার সাহিত্য মহলে পরিচিত হন হেমিংওয়ে। জেমস জয়েস, এজরা পাউন্ড, গারটুর্ড স্টেইন, জন ডর্স পাসো, এমন সব লেখক-কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর। কী ওয়েস্টের রোমাঞ্চকর অনুভূতির কথা ডর্স পাসোই হেমিংওয়েকে প্রথম বলেছিলেন। ১৯২৮ সালের এপ্রিলে হেমিংওয়ে প্রথম কী ওয়েস্টে আসেন। সঙ্গে দ্বিতীয় স্ত্রী পাউলিন। পরিকল্পনা ছিল ছসপ্তাহের বেশি কী ওয়েস্টে তাঁরা থাকবেন না। কয়েকদিনের মধ্যেই স্থানীয় কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো হেমিংওয়ের। পরবর্তীকালে এই মানুষগুলোই হেমিংওয়ের আজীবনের বন্ধু হয়ে যান। জর্জ ব্রুকস, চার্লস থমসন, ক্যাপ্টেন ব্রা সাউনডার্স ও স্লোপি জো রাসেল। ১৯২৮ সালের নভেম্বরে আবার ‘কী ওয়েস্টে’ ফিরে আসেন হেমিংওয়ে। সাউথ স্ট্রিট ১১০০ তে ছোট একটা বাড়ি ভাড়া নেন এবং এই বাড়িতে বসে ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ উপন্যাসটির ঘষামাজার কাজ শুরু করেন। ১৯২৯ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয় উপন্যাসের কাজ। এ বছরই ক্যানসাস সিটিতে জানুয়ারির ২৮ তারিখে জন্মায় তাঁর পুত্র পেট্রিক। পেট্রিক এবং ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ এর জš§ একই মাসে। ১৯৩০ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপে গ্রীষ্মযাপন করে আবার কী ওয়েস্টে ফেরেন হেমিংওয়ে। শুরু হয় তাঁর কী ওয়েস্টের জীবন। সকালবেলা লেখা, দুপুরবেলা সমুদ্রে মাছ ধরা, সন্ধ্যাবেলা কী ওয়েস্টের উদ্যাম জীবন। ১৯৩১ এর গ্রীষ্মটি দ্বিতীয় স্ত্রী পাউলিনকে নিয়ে স্পেনে কাটাতে যাবেন, যাওয়ার আগে পাউলিনের চাচা আট হাজার ডলার দিয়ে কোরাল স্টোনের একটি ম্যানশন কিনে উপহার দিলেন পাউলিন এবং হেমিংওয়েকে। বাড়ির নম্বর ৯০৭, হোয়াটহেড স্ট্রিট। এই পুরনো বাড়িতে এসে তাঁরা উঠেছিলেন ১৯৩১ সালের নভেম্বরে। পরে বাড়িটি নিজেদের মতো করে রেনোভেসান করে নেন। এটাই কী ওয়েস্টের সেই বিখ্যাত বাড়ি।

১৯৩১ সালের ১২ নভেম্বর পাউলিনের দ্বিতীয় পুত্র গ্রেগোরি জš§গ্রহণ করে। ১৯৩৭-৩৮ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ কাভার করার জন্য বান্ধবী মার্থা গেলহর্নের সঙ্গে স্পেনে চলে যান হেমিংওয়ে। এ মহিলা পরবর্তীকালে হন হেমিংওয়ের তৃতীয় স্ত্রী। ১৯৪০ সালে হেমিংওয়েকে ডিভোর্স করেন পাউলিন এবং দুই শিশুপুত্র নিয়ে কী ওয়েস্টের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৫১ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এ বাড়িতেই ছিলেন পাউলিন। ১৯৪৬ সালে তৃতীয় স্ত্রী মার্থাকে ছেড়ে মেরিকে চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন হেমিংওয়ে। ১৯৬১ সালের ২ জুলাই শটগানের গুলিতে তিনি আত্মহত্যা করেন। এই হচ্ছে হেমিংয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী।

এবার কী ওয়েস্টের বাড়িটির ইতিহাস বলা যাক। ১৮৫১ সালে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন জাঁদরেল জাহাজ ব্যবসায়ী আসা এফ, টিফট। বাড়ির নির্মাণশৈলী স্প্যানিশ কলোনিয়াল স্টাইলের। দোতলা বাড়িটির দেয়াল কোরাল পাথরের। বাড়িটিতে পাউলিন সিলিং ফ্যান লাগিয়েছিলেন। ইউরোপিয়ান এনটিকস দিয়ে সাজিয়েছিলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে বেড়াতে গেছেন সেই সব দেশের স্যুভেনির ছিল বাড়িভর্তি। নানা ধরনের ফুলের গাছ, পামবিচ পাতাবাহার ইত্যাদির ঝাড়ে বাড়িটিকে মনোরম করে তুলেছিলেন পাউলিন। বিশাল বাড়িটির চারদিকে উঁচু দেয়াল। হেমিংওয়ে কিউবায় চলে যাওয়ার পর তাঁর পরিবার বাড়িটির দেখাশোনা করত। মিসেস বার্নিস ডিসকন ১৯৬১ সালে বাড়িটি কিনে নেন। হেমিংওয়ের মৃত্যুর পর মিউজিয়াম হিসেবে জনসাধারণের জন্য যখন বাড়িটি খুলে দেওয়া হয় তখন, ১৯৬২ সালে ভদ্রমহিলা বাড়ি ছেড়ে যান। ১৯৬৮ সালে কী ওয়েস্টের এই বাড়ি রেজিস্টার্ড ন্যাশনাল হিস্টোরিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিতি পায়।

গাড়ি পার্ক করতে হলো বেশ দূরে। তারপর বাড়িতে যাওয়ার জন্য লাইন দিলাম আমরা। নয় ডলার করে টিকিট। বাড়িটি সাবেকি আমলের। যেমন ছিল ঠিক তেমনই রেখে দিয়েছে আমেরিকান সরকার। মিউজিয়াম বানিয়েছে। বহু বিদেশি ঢোকার জন্য লাইন দিয়ে আছে। হেমিংওয়ের কারণে কী ওয়েস্ট এখন টুরিস্ট সিটি। বাড়িতে ঢুকে আমার কেমন ঘোর লেগে গেল। হেমিংওয়ে বিড়াল ভালোবাসতেন। এ কারণে প্রচুর বিড়াল রাখা হয়েছে বাড়িতে। সারা বাড়িতেই দেখছি বিড়াল। কোনোটা আয়েশি ভঙ্গিতে হাঁটছে, কোনোটা অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। ঝোপঝাড়ের ছায়ায় আরামছে ঘুমাচ্ছে কোনো কোনোটা। বাড়িভর্তি বিড়াল দেখে আমার মনে পড়ল তাঁর সেই বিখ্যাত গল্পটির কথা। ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ মনে করেন, এ রকম নিখুঁত গল্প একমাত্র গুরু হেমিংওয়েই লিখতে পারেন। গল্পটি হেমিংওয়ের নিজেরও খুব পছন্দ ছিল। এই বাড়িতে একজন জার্মান মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচ.ডি করছেন হেমিংওয়ের ওপর। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি শুনে আমি খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার জার্মানিতে যাওয়ার পর এক বিকেলে হামিদুল আমাকে হাইডেলবার্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বাড়িতে। তিনি হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন। ছোট্ট সুন্দর একটা বাড়িতে থাকেন। তাঁর জার্মান স্ত্রী সুন্দর বাংলা বলেন। আমাদের শিঙ্গাড়া আর সমুচা ভেজে খাইয়েছিলেন। অলোকরঞ্জন কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘নূরজাহান’ বইটা পড়েছেন। বিকেলটা আমরা খুব আনন্দে কাটিয়েছিলাম। ফেরার সময় অলোকরঞ্জন আমাকে তাঁর একটি কবিতার বই উপহার দিলেন। বইয়ের নাম ‘কোনও কোনও উপভাষায় বৃষ্টি পড়ে’। হেমিংওয়ের বাড়িতে পরিচয় হওয়া হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির হেমিংওয়ে গবেষক মহিলাটিকে আমি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কথা বললাম। তিনি তাঁকে চিনলেন। অলোক বাবু যে গ্যাটে পুরস্কার পেয়েছেন সেই তথ্যও তাঁর জানা। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ যে কত বিচিত্রভাবে হতে পারে এ ঘটনাটি তার প্রমাণ। কোথায় হেমিংওয়ের বাড়ি, কোথায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কোথায় আমি আর কোথা থেকে পরিচয়ের সূত্রধর সেই জার্মান মহিলা! আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যে হেমিংওয়ের বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। সেই ফাঁকে আমার মনে পড়ছে তাঁর আণবিক বোমার মতো শক্তিশালী একেকটি উপন্যাসের কথা, গল্পের কথা। বাংলাদেশেই তো অনুবাদ হয়েছে তাঁর কতগুলো উপন্যাস। দ্য সান অলসো রাইজেস, লস্ট জেনারেশন নিয়ে লেখা। বাংলাদেশে অনুবাদ হয়েছিল ‘তবুও সূর্য ওঠে’ নামে। ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, হেমিংওয়ের যুদ্ধবিরোধী এপিক। বাংলা অনুবাদে নাম হলো ‘আর যুদ্ধ নয়’। অনুবাদক অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ অনুবাদ করেছিলেন মনীষী আবুল ফজল। হেমিংওয়ের শ্রেষ্ঠকর্ম ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র দুটো বাংলাদেশি অনুবাদ পড়েছি আমি। প্রথমটি বেরিয়েছিল পাকিস্তান আমলে। অনুবাদক ফজলে লোহানীর অগ্রজ বিখ্যাত অভিনেতা ফতেহ লোহানী। তিনি বাংলা নাম করেছিলেন ‘সমুদ্র সম্ভোগ’। দ্বিতীয় সংস্করণ পাওয়া যায় এখন বাজারে। ‘সমুদ্র সম্ভোগ’ নাম বদলে ইংরেজি নামটাই রাখা হয়েছে পরের সংস্করণে। এখন আবার ফেরা যাক হেমিংওয়ের ‘কী ওয়েস্টের’ বাড়িতে। এক সময় এলাম তাঁর লেখার রুমে। রুমটি দোতলায়। আসবাবপত্র, লেখার টেবিল, ল্যাম্প, বুক শেলফ, শেলফের ভেতরকার বই যা যেখানে ছিল অবিকল সেভাবেই সেখানেই রেখে দেওয়া হয়েছে। ভুলেও হাত দিয়ে কেউ কিছু ধরেনি। স্বপ্ন দেখার চোখ নিয়ে আমি সব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। এক সময় মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম হেমিংওয়ের লেখার টেবিলের অদূরে রাখা বুক শেলফটির সামনে। শেলফটা মাঝারি সাইজের, সাবেকি আমলের, তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু আমার আগ্রহ, এই মহান লেখক কী ধরনের বই রাখতেন তাঁর হাতের কাছে তাই দেখা। শেলফের প্রায় সব বইয়েরই এমন অবস্থা, নাম পড়া যায় না। তবু চেষ্টা আমি চালিয়ে যাচ্ছি। দুয়েকটা ইংরেজি বইয়ের নাম উদ্ধার করতে পারলাম। এই উদ্ধার কাজ চালাতে চালাতে এক সময় শরীরের ভেতর দিয়ে যেন বিদ্যুতের একটি ঝলক বয়ে গেল আমার। এ কী? কী দেখছি হেমিংওয়ের বুক শেলফে? ঠিক দেখছি তো? নাকি চোখের ভুল! বিভ্রম! আমি ফ্যাল ফ্যাল করে দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে আছি। প্রথমে বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। অক্ষরগুলো বাঁকাচোরা, অনেকটা আরবি হরফের মতো। একটু খেয়াল করে বুঝতে হয়, লেখাটা বাংলা। বইটা বাংলা বই। ‘বুঢ়া ও সাগর’। ‘ড়’ না ‘ঢ়’। অর্থাৎ ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র বাংলা অনুবাদ। অনুবাদকের নামটি পড়া যাচ্ছে না। ১৯৫২ তে প্রথম প্রকাশিত হলো ‘দি ওল্ডম্যান দ্য সী’। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সারা পৃথিবী কেঁপে উঠল। সেই কম্পন ভারতবর্ষে এসেও লেগেছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা অনুবাদ হয়ে গিয়েছিল বই। নিশ্চয় আক্ষরিক অনুবাদ হয়েছিল। এ জন্যই বাংলা নামটা অমন, বুড়া বানানটা ‘ঢ়’ দিয়ে। অনুবাদক সেই বই শ্রদ্ধাভরে পাঠিয়েছিলেন হেমিংওয়েকে। হেমিংওয়ে সযত্নে বইটি রেখে দিয়েছিলেন তাঁর শেলফে। কী বিস্ময়কর ব্যাপার! হেমিংওয়ের শেলফে বাংলা বই! নিজ চোখে না দেখলে আমি হয়তো বিশ্বাসই করতাম না। বীণা খালা, ওর বর আর ছেলেরা সবাই বইটি দেখে আমার মতোই বিস্মিত। ওরা আগে একবার এই বাড়িতে এসেছে কিন্তু কারও চোখেই বাংলা বইটি পড়েনি। আমার চোখেই পড়ল, কী আশ্চর্য!

‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ প্রকাশের পরের বছর ১৯৫৩-তে এই বইয়ের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন হেমিংওয়ে। ১৯৫৪-তে পেলেন নোবেল পুরস্কার। তাঁর পুরো নাম ছিল আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে। ১৯৩০ সালে নাম থেকে ‘মিলার’ বাদ দিলেন তিনি। বিস্ময়কর এক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। আত্মকেন্দ্রিক, বহির্মুখী। দুহাতে খরচ করতেন। শিকার পছন্দ করতেন, স্পেনের ষাঁড়ের লড়াই ছিল প্রিয়। প্রবল স্বাস্থ্যের অধিকারী, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। মদ্যপান এবং নারীসঙ্গ, দিনের পর দিন সমুদ্রে মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, এই ছিলেন তিনি। দুই দুবার বিমান দুর্ঘটনায় পড়েও বেঁচে যান। চার চারটি বিয়ে করেছিলেন। চোখের দৃষ্টি ছিল ক্ষীণ। বিশাল বপুর তুলনায় পশ্চাৎদেশ ক্ষীণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হয়ে চলে গিয়েছিলেন ইতালিতে। যুদ্ধে মারাত্মভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে থাকেন। সেই হাসপাতালে প্রেমে পড়েন রেডক্রসের নার্স অ্যাগনেস ভন কুরোওস্কির। কিন্তু মেয়েটি তাঁকে বিয়ে করে না। কারণ তার মনে হয়েছিল ছেলেটি বয়সে ছোট। গা থেকে এখনো কৈশোরের গন্ধ যায়নি। এসব ১৯১৮ সালের কথা। জুলাইয়ের ৮ তারিখে তিনি আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে আসেন মিশিগানে। তারপর থেকে শুরু হয় তাঁর প্রকৃত লেখালেখির জীবন, সাংবাদিকতার জীবন। হেমিংওয়ের জীবনের এই অংশটি নিয়ে চমৎকার একটি সিনেমা হয়েছে। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয়ী রিচার্ড এটেনবোরো তৈরি করেছেন সিনেমাটি। ১৯ বছর বয়সী হেমিংওয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন চার্স ওডোনেল। অ্যাগনেস চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্যান্ড্রা ব্লুক। ছবির নাম ‘ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’। নিজের ওই সময়কার জীবন নিয়েই হেমিংওয়ে লিখেছিলেন তাঁর মাস্টারপিস ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’। ‘ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ অপূর্ব প্রেমের ছবি। হেমিংওয়ের ‘দ্য স্নোজ অব কিলিমনজারো’ গল্পটি নিয়েও ছবি হয়েছিল। গ্রেগোরি প্যাক অভিনয় করেছিলেন। বহু আগে সেই ছবি আমি দেখেছি। গল্পটি শুরু হয়েছিল এভাবে, ‘কিলিমনজারো বরফে ঢাকা পর্বত। ১৯,৭১০ ফুট উঁচু। আফ্রিকার উচ্চতম পর্বত। এর পশ্চিমের শৃঙ্গের নাম নগজি নগাই, ঈশ্বরের ঘর। এই শৃঙ্গের কাছাকাছি এক ধরনের চিতাবাঘ বাস করে। এত উঁচুতে চিতাবাঘ কীভাবে বাস করছে এবং কী খুঁজছে, তা কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি আজ পর্যন্ত।’

হেমিংওয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিককার সমুদ্রতীরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। এই সমুদ্রের ৯০ মাইল ওপারে হাভানা। হাভানার কাছের এক গ্রাম কোহিমার। ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র নিঃসঙ্গ বুড়ো জেলে সান্তিয়াগো বাস করত সেই গ্রামে। হেমিংওয়ের অমর সৃষ্টি সান্তিয়াগোর কথা সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়েছিল। সে বলেছিল, ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু পরাজিত হতে পারে না কখনো। হেরে যাওয়ার জন্য জš§ হয়নি মানুষের’।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর